হেলিকপ্টার সার্ভিস

রাবি প্রতিনিধি: বিচিত্র সব শখ নিয়ে মানুষের জীবন। শখ মেটানোর জন্য মানুষ যেমন সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে বাসরঘর সাজিয়েছে, মন্ত্রী পরিষদের সভা বসিয়েছে, তেমনি চাঁদে গিয়ে পতাকাও টাঙিয়েছে।
মানুষ শখ করল, মহাকাশে মূলার চাষ করা হবে। তাতেও মানুষ সফল হলো। এখন মানুষের শখ চাঁদে এবং মঙ্গলগ্রহে মূলার চাষ করা এবং কিছু মানুষকে সেখানে পাঠিয়ে মূলাসহ অন্যান্য চাষে উদ্বুদ্ধ করা। অদ্ভুত সব শখ!
ছোট বেলায় যখন কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করত, বড় হয়ে তুমি কি হবে? আমরা কেউ বলতাম ডাক্তার হবো, কেউ বলতাম উড়োজাহাজ চালাব, কেউ বলতাম পিং পং গাড়ির ড্রাইভার হবো ইত্যাদি ইত্যাদি।
শুধু আমরা নয় আমাদের বাবা মায়েদেরও শখের কমতি ছিল না। আর কমতি ছিল না বলেই নাটরের স্কুল শিক্ষক এক বাবা নূরুল ইসলামের শখ ছিল, ছেলে বড় হলে হেলিকপ্টারে বিয়ের আয়োজন করবে। কারণ ছোটবেলায় আকাশে বিমান বা হেলিকপ্টার উড়তে দেখলেই ছেলে বায়না ধরত বিমানে চড়ার।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কয়েকমাস আগে প্রকৌশলী ছেলে হারুন অর রশীদ বাদশা নিজের এবং বাবার শখ পূরণ করেন হেলিকপ্টারে বিয়ের মাধ্যমে। মফস্বল গ্রামের লোকজন হেলিকপ্টারে বিয়ে বেশ আনন্দ নিয়ে উপভোগ করে। হেলিকপ্টারে বউ আনার খবর প্রায় দেখা যায় বৃহত্তর সিলেটে।
আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের জন্য এ শখটি পূরণ অসম্ভব হলেও অসাধারণ মানুষদের জন্য এটি ডাল-ভাত পর্যায়ের। কারণ অসাধারণ মানুষের অনেকে এসব যানবাহন ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রোগ্রামে হাজির হয়। সামর্থ্য বা প্রয়োজন না থাকলেও ব্যবস্থা হয়ে যায়। শুধু শখ বা ইচ্ছে প্রকাশ করলেই হয়।
শখে হোক বা কিছুটা প্রয়োজনে হোক আমারও অল্প সময়ের জন্য হেলিকপ্টারে চড়ার সুযোগ হয়েছিল। সময়টা হবে ১৯৯৮ সাল। তখন আমি উচ্চশিক্ষার জন্য জাপানে। সুপারভাইজার জানালেন ফিল্ড ওয়ার্কে যেতে হবে। ফিল্ড ওয়ার্কের বিষয় ছিল আকাশ থেকে সোরলাইন বা সমুদ্ররেখার (পানি ও মাটির মিলনরেখা) পরিবর্তন দেখা।
যদিও গজ ফিতা দিয়ে এ পরিবর্তন আমরা ভূমি থেকে মাপ-জোপ করেছি। যা হোক, ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য আমরা প্রায় সাত-আট জন ছাত্রছাত্রী সমুদ্রের সৈকতে হেলিপ্যাডের কাছে উপস্থিত হলাম। হেলিকপ্টার আমাদের একজন একজন করে নিয়ে আকাশে উড়াল দিল।
আমি সিটে বসার সাথে সাথে পাইলট বললেন, প্লীজ টেক ইউর সিটবেল্ট এন্ড হেডফোন। পাইলটকে ফলো করলাম। দু’ আসন বিশিষ্ট ছোট হেলিকপ্টার। হেলে দুলে সমুদ্ররেখা বরাবর যানটি চলা শুরু করলো। পাইলট একবার জাপানিজ ভাষায় জানতে চাইলো, ভয় পাচ্ছি কিনা? বহুল ব্যবহূত জাপানিজ ভাষায় বললাম, ওয়াকারানাই (জানি না)।
আসুন, হেলিকপ্টার সমন্ধে একটু জেনে নিই। ’হেলিকপ্টার’ ইংরেজি শব্দ যা এসেছে গ্রিক শব্দ ’হেলিক্্র’ থেকে। পাল করনু নামে একজন ফ্রান্স সাইকেল মেকার ১৯০৭ সালে প্রথম হেলিকপ্টার আবিস্কার করেন। তাঁর আবিস্কৃত হেলিকপ্টার ভূমি থেকে ১ ফুট উচ্চতায় উঠতে এবং ২০ সেকেন্ড ভেসে থাকতে সক্ষম ছিল।
ইতিনি ওমিচেন নামে আরেক ফ্রান্স আবিস্কারকের হেলিকপ্টার ২ জন যাত্রী বহন করে প্রায় এক কিলোমিটার উড়তে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে আইগোর শিকোরস্কি বিশ্বে প্রথম ব্যবহারিক হেলিকপ্টার আবিস্কার এবং পাইলটেড করেন। কিন্তু ১৯৪২ সালে শিকোরস্কি হেলিকপ্টারকে যে ডিজাইন দেন তাই আজ মডার্ণ হেলিকপ্টার হিসেবে পরিচিত এবং এ জন্য রাশিয়ান এ বিজ্ঞানীকে হেলিকপ্টারের জনক বলা হয়।
হেলিকপ্টার এমন একটি যান বা পাখি যাকে সহজে পোষ মানিয়ে বাড়ির ছাদে, ফাঁকা মাঠে বা পানিতেও ল্যান্ড করানো যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি আমাদের দেশে জরুরী কাজেই বেশি ব্যবহুত হয়।
বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে এ বাহনটি আমাদের অনেকের জান-মাল রক্ষায় ব্যবহূত হয়। করোনা আক্রান্ত মানুষের সেবা করতে সম্মুখভাগে থেকে যারা আক্রান্ত হয়ে জীবন-মরণ সন্ধীক্ষণে ছিলেন সে সব বীরদের নিয়েও এ যানটি দুর-দুরান্ত থেকে ছুটাছুটি করেছে। পৌঁছে দিয়েছে উন্নত চিকিৎসার দ্বোর গোড়ায়।
যারা হার্টের রোগী তাদের অনেকে এখন ঢাকায় উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন। কিন্তু বিভাগীয় শহরগুলোর দিকে তাকালে এর একটা করুণ চিত্র পাওয়া যাবে। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষকের সম্প্রতি কার্ডিয়া এটাক এবং চিকিৎসা পরবর্তী অভিজ্ঞতা আমার কাছে মোটেও সুখকর ছিল না।
প্রফেসর ড. জাহানুর রহমান অসুস্থ হওয়ার পর রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে কার্ডিয়াক ইউনিটে ভর্তি করা হয়। একটা ইউনিটে যত রোগী থাকার কথা তার কয়েকগুণ রোগীসহ ভিজিটারদের আনাগোনায় মনে হচ্ছিল আমরা কোনো এক হাট-বাজারের মধ্যে আছি। বিশেষজ্ঞ হার্টের ডাক্তারেরও অভাব বিভাগীয় এ শহরে।
রোগের সঠিক চিত্র যখন আমরা কেউ জানতে বা বুঝতে পারছিলাম না তখন রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার কথা ভাবা হয়। সেও এক বিড়ম্বনা। বিভিন্ন পরিচিত চ্যানেল বা যোগাযোগ করেও একটা হেলিকপ্টার পেতে প্রায় সারাদিন লেগে যায়।
কারণ হেলিকপ্টার ভাড়ার জন্য টাকা পাঠানো এবং বিকেল ৪.০০টা পার হলে প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের অনুমতিসহ নানা জটিল পথে হাঁটতে হয়। আবার সবার পক্ষে প্রায় দুই আড়ায় লাখ টাকা খরচ করে রোগীকে ঢাকায় নেওয়া সম্ভব হয় না। ঠিক একই অভিজ্ঞতা হয় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুনের ক্ষেত্রেও।
এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর অনুরোধ থাকবে জরুরী রোগী বহনে হেলিকপ্টার সার্ভিসকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আরো সহজলভ্য করার জন্য। কারণ একটা বিভাগীয় শহর থেকে ঢাকায় একটা রোগী নিতে আড়ায় লাখ টাকা খরচ আমাদের এ দেশে অস্বাভাবিক বলেই আমরা মনে করি।
লেখক-অধ্যাপক আসাবুক হক, গনিত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর রাবি প্রতিনিধি মো: মুজাহিদ হোসেন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.