ওদের বাঁচান, ওরাও মানুষ!

মো. আমানুল্লাহ আমান: আজ ১০ই অক্টোবর, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। সুস্থভাবে বাঁচতে শরীর ও মন উভয়ই ভাল রাখা জরুরি। বিষণ্নতা ও উদ্বেগের কারণে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আর তা ছয় মাসের বেশি স্থায়ী এবং স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের ব্যত্যয় ঘটলে তাকে মানসিক রোগ বলে ধরা হয়। বিশ্বে বেড়ে চলেছে মানসিক রোগীর সংখ্যা। অল্পবয়সীদের জন্য তা একটু বেশিই চিন্তার। যদিও দেশে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য নীতি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতিবছর ১০ লাখ মানুষের আত্মহত্যার ঘটনায় ৯০ শতাংশের জন্য দায়ী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এটির প্রধান উপসর্গ ‘বিষণ্নতা’ ২০৩০ সাল নাগাদ গ্লোবাল ডিজিজ বার্ডেনের শীর্ষে পৌঁছতে পারে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন মানুষ মানসিক ও স্নায়বিক সমস্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ। আর বৃটিশ জার্নাল ল্যানসেট-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধের তথ্যমতে, বিশ্বে মানসিক রোগীর সংখ্যা ১০০ কোটি। অর্থাৎ প্রতি ৮ জনে একজনের রয়েছে মানসিক রোগ।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ২০৩০ সাল নাগাদ মানসিক রোগের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার লোকসানের মুখে পড়বে। সবকিছু বিবেচনায় গত বছরের মে মাসে ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি-২০২২’ অনুমোদনের পর ৪ জুন গেজেট প্রকাশ করে সরকার। নীতির চতুর্থ উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হয়, ‘পুনর্বাসনের মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের আরোগ্য লাভের জন্য সহযোগিতা করা।’ কিন্তু নীতির যথাযথ ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করা হচ্ছে কি না- এটিই আজ প্রথম প্রশ্ন। কেননা, দেশের বিশেষায়িত মানসিক হাসপাতালে সুস্থদেরও রাখার অভিযোগ নতুন নয়!
এই ধরুণ, রাজশাহী নগরীর রাজারহাতা এলাকার শহিদুল ইসলামের কথা। ২৯ বছর বয়সী এ শ্রমিকের বর্তমান আবাস মানসিক হাসপাতাল, পাবনা। গত ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে তালাবদ্ধ চার দেয়ালের মাঝে একপ্রকার ‘বন্দী’ জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাকে। কথাবার্তা স্বাভাবিক তার। কয়েকটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান দলীয় প্রধানের নাম বলে দিলেন অনায়াসে। কিন্তু কেন তিনি মানসিক হাসপাতালে? উত্তরে শহিদুল জানালেন, তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। যোগ দিতেন মিছিল-মিটিংয়ে। রাজনৈতিক কারণে শত্রুতা করে তাকে মানসিক হাসাপাতালে রেখে যাওয়া হয়েছে। রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজে ডিগ্রি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন তিনি।
৪৫ বছর বয়সী মোবারক মণ্ডলের বাসা পাবনার চাটমোহর উপজেলায়। রিকশা চালিয়ে কোনোমতে সংসার চালাতেন। সপ্তাহ দুয়েক আগে সড়কে তাকে একটি মোটরসাইকেল ধাক্কা দিলে বুক ও হাতে আঘাত পান। আহত অবস্থায় তার বড়ভাই ওষুধ কিনে দেয়ার কথা বলে নিয়ে যান মানসিক হাসপাতালে। সেখানে ছোটভাইকে ভর্তি করেই তিনি লাপাত্তা। ওয়ার্ডে শয্যার (বেড) পাশে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়ছেন মোবারক। সুস্থ হয়েও বাসায় যাওয়ার কোনো উপায় পাচ্ছেন না তিনি।
নওগাঁর পোরশা উপজেলার আনোয়ার হোসেন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে বিবিএ সম্পন্ন করেছেন। তার বাবা পোরশার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। শুধুমাত্র গালাগাল করার কারণে গত ১ অক্টোবর থেকে মানসিক হাসপাতালে বদ্ধ জীবন কাটছে আনোয়ারের। বাবা নিজেই রেখে গেছেন তাকে।
আর ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ইলিয়াস আলী তো ইংরেজিতেই কয়েক বাক্যে কথা বললেন অবলীলায়। গলার সুরও চমৎকার। গান শোনানোর পর ইলিয়াস জানালেন, তার বাবা বিএনপি করেন। আর চাচারা সম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে। জোরপূর্বক তার বাবার সম্পত্তি নেয়ার চেষ্টা করছিলেন চাচারা। ফলে তিনি এক চাচার গায়ে হাত তোলেন। সেজন্য তাকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর মানসিক হাসপাতালে রেখে গেছেন পরিবারের সদস্যরা। যদিও প্রেমে ব্যর্থতার ভিন্ন ঘটনাও রয়েছে তার জীবনে।
তবে তাদের এসব কথা সঠিক নয় বলে দাবি পাবনা মানসিক হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের। বলেন, ‘ওরা অসুস্থই। ওদের কথায় কর্ণপাত করা যাবে না।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানসিক রোগীদের কী এমন স্বাভাবিক আচরণ হয়?
শুধুমাত্র শহিদুল, মোবারক, আনোয়ার কিংবা ইলিয়াস নয়; এরকম আরও অসংখ্য জীবন্ত চরিত্র এখন তালাবদ্ধ পাবনার হেমায়েতপুরে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসাপাতালে। জানালার গ্রিল ধরে প্রতিদিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন বাইরে। অপেক্ষা করেন আর ভাবেন, ‘আজ হয়ত আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে। এ বুঝি আমার লোক আসলো!’ কিন্তু না! দিন ফুরিয়ে রাত নামে, সপ্তাহ পেরিয়ে মাস আসে; তবু দেখে মেলে না স্বজনের! চোখের জল মুছতে মুছতে চাপাকষ্ট বুকে নিয়ে শুয়ে পড়েন বিছানায়।
তবে অপরিচিত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ পেলেও খুব খুশি হন তারা। কথা বলেন মন খুলে। আমাদের দেখেও এগিয়ে আসলেন জানালার ধারে। দুঃখ-কষ্টের গল্প আর অতীতের স্মৃতিচারণ করলেন স্বেচ্ছায়। সবশেষ আমাদের মুঠোফোনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দু-এক মিনিট করে কথা বলার আবদার করলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধের কারণে সেটা সম্ভবকর হলো না। তারা খুব করে আকুতি জানালেন বদ্ধ ঘর থেকে মুক্ত করে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের আজকের দিনে একই অনুরোধ আমারও, ওরা সম্ভবত সুস্থ। ওদের বাঁচান, ওরাও তো মানুষ!
লেখক: মো. আমানুল্লাহ আমান, সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠাতা, স্বপ্নবাজ (স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন)। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.