থাইল্যান্ডে সামরিক এলিটরা কি বিরোধীদের সরকার গঠন করতে দেবে?

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পাকিস্তানের মতোই থাইল্যান্ডের শাসনকাজে সেনাবাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ, নেতৃত্ব পছন্দ না হলেই অভ্যুত্থান ঘটানোর মত ইতিহাসের কারণে সেখানে দেখা দিয়েছে নতুন সরকার গঠনে অনিশ্চয়তা।
নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে এক দশক ধরে চলা সামরিক শাসকের আশীর্বাদপুষ্টদের প্রত্যাখ্যান করলেও, জনগণের পছন্দের নতুন নেতৃত্ব আদৌ গঠন হবে কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
তাই নির্বাচনে জয়ী হয়েও সরকার গঠনে প্রধান দুই দল ফেউ থাই পার্টি ও মুভ ফরওয়ার্ড পার্টিকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে সংস্কারবাদী মুভ ফরওয়ার্ড পার্টির নেতা পিটা লিমজারোয়েনরাত বলছেন, ফেউ থাই পার্টির সঙ্গে মিলে একটি জোট সরকার গঠন করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী তিনি।
দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান, মিয়ানমারের মতো সামরিক শাসকের দেশ হিসেবে পরিচিত থাইল্যান্ড। ১৭৮২ সাল থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত রাজতন্ত্র ছিলো দেশটিতে। ১৯৩২ সালে বিদ্রোহীরা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।
এরপরের কয়েক দশক রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেনাবাহিনী বেশ কয়েকবার অভ্যুত্থান ঘটায় থাইল্যান্ডে। রাজপরিবার সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলকে স্বীকৃতি দিয়ে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছে প্রতিবারই।নির্বাচনী সংস্কৃতির গলা টিপে অনির্বাচিতরা থাইল্যান্ডের ক্ষমতায় বসে মূলত রাজপরিবারের যোগসাজশেই।
আর প্রতিবার অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার দোহাই দেয়া হয়। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাপিপাসু সামরিক-বেসামরিক একটি আমলাচক্রের সঙ্গে রাজপরিবারের ঐতিহাসিক মৈত্রী কাজ করছে দেশটিতে।
তবে সেনাবাহিনীকে রাজ পরিবারের এই সমর্থনও নিজ স্বার্থেই।বিশ্লেষকরা বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকশিত হতে দিতে চায় না রাজপরিবার। সেই লক্ষ্যে সবসময় কিছু রাজনীতিবিদ ও সামরিক কর্মকর্তাকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে পাশে রাখে তারা।
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২০০৬ সালে থাকসিন সিনাওয়াত্রা আর ২০১৪ সালে সরানো হয় ইংলাক সিনাওয়াত্রার সরকারকে। এই দুই সরকারের ভিত্তিই ছিলো দেশটির দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যাপক সমর্থন। থাকসিনের সময়েই থাইল্যান্ডে নির্বাচিত বেসামরিক সরকার প্রথমবারের মতো মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছিলো।
কিন্ত রাজ পরিবারকে ঘিরে থাকা অভিজাততন্ত্রকে সন্তুষ্ট রাখতে না পারায় সরে যেতে হয় তাকে।নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এভাবে নাজেহালের শুরু থাইল্যান্ডের ইতিহাসের প্রথম স্বচ্ছ নির্বাচন থেকেই।
১৯৭৩ ও ১৯৭৬ সালের দুটো নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও জনপ্রিয় নেতা সেন প্রামোজকে রাজনীতি থেকেই বিদায় নিতে হয়। অথচ জন্মগতভাবে রাজপরিবারেরই সদস্য ছিলেন তিনি।জনগণের সার্বভৌমত্ব রাজপরিবারের কর্তৃত্বের ওপর ছায়া বিস্তার করলেই দেশটিতে সামরিক শাসনের গুঞ্জন শুরু হয়।
এই প্রক্রিয়াতেই ২০১৪ সালে ক্ষমতা নেন জেনারেল প্রাউত চান-ওচা। বিতর্কিত এক প্রক্রিয়ায় এই ‘জেনারেল’ পরবর্তীতে ‘প্রধানমন্ত্রী’ হয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমাতে নেন নানা পদক্ষেপ। তবে এবারের নির্বাচন বদলে দিয়েছে প্রাউত চান-ওচার সব হিসাবনিকাশ।
থাইল্যান্ডে চার বছর পর হওয়া সাধারণ নির্বাচনে সামরিক বাহিনীপন্থিদের যে ভরাডুবি হবে, জনমত জরিপেই তার ইঙ্গিত মিলছিল। এ কারণেই সবার চোখ ছিল পেতোংতার্ন সিনাওয়াত্রার দলের দিকে। ধারণা করা হচ্ছিল, ১৭ বছর আগে ক্ষমতাচ্যুত থাকসিন সিনাওয়াত্রার মেয়ের দল পুয়ে থাই সবচেয়ে বেশি আসনে জিতে সরকার গঠনের দাবিদার হবে।
কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে রোববারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভ করে পিটা লিমজারোয়েনরাতের মধ্য-বামপন্থি ‍মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি।দেশটির রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের স্বপ্ন সঞ্চার করা পিটা লিমজারোয়েনরাতের জন্ম ১৯৮০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। ব্যাংককের থাম্মাসাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, হার্ভার্ড থেকে স্নাতকোত্তর এবং পরবর্তিতে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাজনীতিতে যোগ দেয়ার আগে পিটা মূলত ‘টিম পিটা’ নামে পরিচিত ছিলেন।পিটা নিজের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন ২০১৯ সালে। সে বছর তিনি ফিউচার ফরওয়ার্ড পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনীতিবিদ হিসেবে পিটা প্রধানমন্ত্রী প্রাউত চান-ওচার শাসনের অন্যতম সমালোচক।
প্রাউতের শাসনামলকে ‘হারানোর দশক’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে জনগণের কাছে নিজেকে ‘দিন বদলের দূত’ হিসেবে তুলে ধরেছেন ৪২ বছর বয়সি এ রাজনীতিবিদ।বিরোধী এমপি থাকাকালে পার্লামেন্টে দেয়া ক্ষুরধার বক্তব্যের জন্য আগেই থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে ‘উদীয়মান তারকা’ খ্যাতি পেয়েছিলেন পিটা।
রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমানো এবং রাজতন্ত্র সংশ্লিষ্ট আইনের সংস্কারের মতো তার দলের সাহসী সব প্রতিশ্রুতি পিটার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে এপ্রিলে ব্লুমবার্গকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পিটা বলেছিলেন, থাইল্যান্ডের রাজপরিবারের সদস্যদের সমালোচনা নিষিদ্ধ করে করা আইনের বিলুপ্তি, একচেটিয়া ক্ষমতার পথ বন্ধ করা ও বিকেন্দ্রীকরণ’ তার অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে।
নির্বাচনে ৫০০টি আসনের মধ্যে ১৫২টিতে জয় পেয়েছে মুভ ফরওয়ার্ড পার্টি ‘এমএফপি’। এতে এটি বৃহত্তম দলে পরিণত হয়েছে। অন্য গণতন্ত্রপন্থি দল ফেউ থাই পেয়েছে ১৪১টি আসন। দুই দল জোট বাঁধলে তাদের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব হবে।
তবে এমন কিছু হলেও ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানের পর জান্তার সংশোধিত আইনের কারণে নতুন কারও প্রধানমন্ত্রী হওয়া ঠেকিয়ে দিতে পারবে। আইন অনুসারে, ৩৭৬ জন আইনপ্রণেতার সমর্থন না পেলে যে কারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে ভেটো দিতে পারবে ২৫০ সদস্যের সিনেট।
পিটা লিমজারোয়েনরাতই থাইল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, এমন সিদ্ধান্ত কেবল ভোটে নির্বাচিত নিম্নকক্ষই নেবে না, উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্যদেরও এখানে ভোট দেয়ার সুযোগ থাকছে। আর সিনেটের সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী প্রয়ুত চান-ওচা।
তারা পরবর্তী সরকারের আমলেও পার্লামেন্টে যোগ দিতে পারবেন।মুভ ফরোয়ার্ড যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে বিজয়ী হয়েছে, সিনেটের সদস্যরা তার বিরুদ্ধে আপত্তি জানাতে পারেন, বিশেষ করে রাজতন্ত্রের অবমাননা সম্পর্কিত আইন সংশোধনের প্রস্তাবগুলোতে। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হবার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে পিটা’র।
তবে পিটা লিমজারোয়েনরাতের জন্য প্রধানমন্ত্রী হবার আরো সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে মুভ ফরোয়ার্ডকে ফেউ থাইসহ আরও কয়েকটি ছোট দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হবে। এক্ষেত্রে ভুমিজাইথাই পার্টির সমর্থন পেলে ৩৭৬ আসনের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে এমএফপি। এমনটা হলে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে দেশটির সেনাবাহিনী।
যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিরোধীদের ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকানোর ক্ষেত্রে অভ্যুত্থান ঘটানো হলে নতুন বিক্ষোভের জন্ম হতে পারে থাইল্যান্ডজুড়ে।নতুন এই ক্ষমতার পালাবদল যে মসৃণ হবে না তা অনেকটাই নিশ্চিত। মুভ ফরোয়ার্ড ও ফেউ থাই দলকে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হবে।
থাইল্যান্ডে আগামী কয়েকদিনে যে রাজনৈতিক দরকষাকষি চলবে, সামরিক বাহিনী এবং তাদের সমর্থকরা এর সুযোগ নিয়ে বিজয়ী দলগুলোর সরকার গঠনের পথ আটকে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
এমনকি আইনি মারপ্যাঁচে ফেলে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টিকে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে বলেও গুঞ্জন আছে। এর আগে ২০২০ সালে দলটির পূর্বসূরি ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টির ভাগ্যেও একই ঘটনা ঘটেছিল। আর তেমনটা হলে আরও একবার রাজতন্ত্র ও সেনা সমর্থিত দলগুলোর কাছে হেরে যাবে থাইল্যান্ডের জনগণ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.