আমি করোনায় মরবো না মামা, আমি মরবো খিদায়

নাটোর প্রতিনিধি: “আমি তো করোনায় মরবো না আমি মরবো খিদায়। কারন এখন রাস্তায় মানুষ বের হয় কম সারাদিনে আমি যে টাকা রিক্সা চালিয়ে পাই তা দিয়ে চাল কিনতে পারবো না, পারবো না ডাল কিনতে, পারবো না আমার ছোট মেয়েটার জন্য কিনতে খাবার ,পারবোনা মামা আপনার মামীর ঔষধ কিনতে। বাসা ভাড়া দিতে। আমাদের তো করোনা হবে না আমাদের হবে না খেয়ে থাকার রোগ।” যাকে বলে,মৃত্যুক্ষুধা।

দ্রব্যমূল্যের এমন অস্বাভাবিক অবস্থার শিকার এমনই এক শ্রমজীবি। নাটোর শহরের ভাড়ায় অটো রিকশা চালান কুদ্দুস মিয়া কান্না জড়িত কন্ঠে আক্ষেপে কথাগুলো বলছিলেন ।

একদিন সকাল সন্ধ্যা অটো চালিয়ে মহাজনকে ৪ শ ৫০ টাকা জমা দিলে অবশিষ্ট থাকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এই টাকা দিয়েই চলে তিন সদসের সংসার। একদিন কাজে না গেলে সংসারে চুলা জ্বলেনা ।।

এমনই জানা অজানা হাজারো শ্রমজীবি মানুষের খাবার কেনার সুযোগ হারিয়ে বেঁচে থাকার সংশয়ে আদরের অসুস্থ পরিবার নিয়ে রাত্রি যাপন হচ্ছে শুধু আমাদের একার গোটা দু’মাসের দ্রব্য কিনে ফ্রিজ কিংবা খাটের নিচে জমা করে রাখায়।

অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরতে পারলেই অদেখা করোনার ভাইরাসের ভয়ের মধ্যেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে শ্রমজীবী মানুষ।

বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস এর তান্ডবে লন্ডভন্ড শুধু শিক্ষা, জনজীবনই নয় প্রভাব পড়েছে চাহিদা-যোগানের মূল কেন্দ্র “অর্থনীতি” তে।

সাজানো গোছানো সভ্যতা যেনো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কোন এক অদেখা মরণ নেশার আতঙ্কে।

আজকের এই অনিন্দ্য সুন্দর সভ্যতা,সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান শ্রমজীবী মানুষের তৈলাক্ত ঘামে। সেই তিলেতিলে সভ্যতা তৈরি করার কারিগরদের মুখে যেনো আজ বিষাদে ঠেকে গেছে, কোন এক অজানা বিষাক্ত সাপ ছোবলের অপেক্ষায় বসে আছে, সুযোগ পেলেই যেনো কামড়ে ধরবে, তেমনি বিষাক্ত সাপের মতো ধ্বংসলীলায় মেতে উঠছে করোনা ভাইরাস।

বিশ্বব্যাপী সকল শ্রেণীপেশার মানুষেরা কারোনা আতঙ্কের মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে, বাংলাদেশেও এই আতঙ্ক আগের চেয়ে আরো বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের অধিকাংশ অর্থনীতিনির্ভর খাতগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

দেশের স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার গুলো ও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরেও আজ থেকে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ।

এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্যের দাম অবিশ্বাস্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের ভ্রাম্যমাণ আদালত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চোখে পড়েছে সকলের। অনেকগুলো গণমাধ্যমেও এ নিয়ে খবর ছাপানো হয়েছে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেভাবে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাতে করে উন্নত কোন রাষ্ট্রের সমস্যা তৈরি না হলেও আমাদের দেশের জন্য এটি খুবই দৃষ্টিকটু এবং দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস। দীর্ঘদিন ধরে আরাম- আয়েশে বসে বসে খাওয়া তো দূরে থাক দেশের শতকরা ৮০ভাগ মানুষ এক সপ্তাহ টানা কাজ করতে না পারলে না খেয়ে মরতে হবে।

আজ পড়ন্ত বিকেলে শহরের তেবাড়িয়হাট এলাকায় দিন মজুর শ্রমিক গুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুবই আশ্চর্য হয়েছি।পাশাপাশি তাদের বিষন্ন মুখ দেখে হৃদয়ের গভীরে এক অদৃশ্য ব্যথা অনুভব করেছি।

এগিয়ে গিয়ে একজনের সাথে কথা বলতেই জানতে পারলাম গত তিনদিন ধরে তাদের হাতে কোন কাজ নেই। সকালে ঠিকমতো নাস্তা করেও বাসা থেকে বের হতে পারেনি। বাড়ির পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কথা জিজ্ঞেস করতেই যেন চোখের জল গড়িয়ে পড়বে এমন অবস্থা!

তারপরেও এই দুরবস্থা খুব শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে বলে তাদেরকে আশ্বস্ত করে কিছুটা তফাতে এসে দাঁড়িয়ে থাকলাম। খুবই ইচ্ছে হলো লোকগুলোর জন্য কিছু একটা করতে!

চারিদিকে কোটি কোট টাকার লুটপাট মাটি থেকে দৃষ্টিসীমার কিছুটা উপরে! তা দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো এই মানুষগুলোকে দেশের নাগরিক হিসেবে গণনা করা হয়তো! তারা কি এই সমস্ত প্রার্থীদের ভোট দিতে পারবে!

একটু বাম পাশে ঘুরে যাত্রী ছাউনীর করুণ অবস্থা দেখতে পেলাম। বসতে গিয়ে দেখলাম যেকোনো মুহূর্তে পরনের কাপড় ছিঁড়ে যাওয়াসহ দুর্ঘটনার শিকার হতে পারি। তবুও সেখানে কোনরকম বসে কিছুক্ষণ ধরে চারিদিকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম দুই-একজন ভিক্ষুক এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করছে, কখনো এর কাছে বা কখনো ওর কাছে গিয়ে হাত পাতছে। অধিকাংশ মানুষ সামর্থ্য থাকলেও ভিক্ষা দিতে চায় না।

এরই মধ্যে করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক থাকার কারণে কোন মানুষ ভিখারীর সামনাসামনি দাঁড়াবে তো দূরে থাক পাশ দিয়ে পর্যন্ত যেতে চাইছে না।

যে সমস্ত দিনমজুর মানুষ গুলো দাঁড়িয়ে আছে তাদের কাছাকাছি গিয়ে আবারো কথা বলার চেষ্টা করলাম, একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম আজকে রাতে খাওয়ার জন্য বাসায় কিছু আছে কি?

তিনি অনেকটা দীর্ঘ প্রশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলেন কারো কাছ থেকে ধার দেনা করে কোনরকম কিছু চাল নিতে পারি কিনা দেখি।

এরই মধ্যে তিনি আবার অভিযোগ করে বললেন, ভাই আমাগো দেশের কি আইবো? শুনছি অন্য দেশের সরকার তাগোরে সাহায্য দিতাছে, আর আমাগো দেশে চাইলের দাম নাকি আবারো বাইড়া গেছে?

আমিও মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলাম হ্যাঁ কিছুটা বেড়েছে!

প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে যারা নিজেদের খুব ধার্মিক দাবি করেন তাদের বলতে শুনেছি এগুলো স্রষ্টা গজব দিয়ে থাকেন, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সেই গজব তাদের উপর গিয়ে পড়ে যারা স্রষ্টার কোনভাবে কোন ধরনের লাভ না করুক অন্তত ক্ষতি করেননি।

অর্থের বিচারে সমাজের তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর মানুষগুলো বছর দুয়েক বসে বসে খেলেও তাদের সে অর্থ শেষ হবে না। কিন্তু দিনমজুর মানুষগুলোর কি অবস্থা হবে?

যারা আগামী দুইদিন বাড়ি থেকে বের হতে না পারলে কাজ করতে না পারলে ক্ষুধার তাড়নায় ছটফট করতে করতে হামাগুড়ি দিতে থাকবে। তাদের পরিবারের শিশু সন্তান কিংবা বৃদ্ধদের কি অবস্থা হবে!

সরকার তাদের কথা চিন্তা করবে কিভাবে জানিনা, ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটাল সানগ্লাসে এসমস্ত দিনমজুর মানুষগুলো কারো চোখে পড়ে না! তাদেরও বা চোখে পড়বে কেন যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি যে তাদের তিলে তিলে মারবেন এমন হুকুম সৃষ্টির পূর্বেই হয়তোবা ঠিক করে রেখেছিলেন।

করোনা ভাইরাসের ফলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে শ্রমজীবি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সকল ধরনের জনসমাগম বন্ধ করেছে করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে। আমাদের সবার সচেতনতা বৃদ্ধি করতে।

করোনা কে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে । করোনার মহামারীকে কেন্দ্র করে দেশে দেশে জনসাধারণকে সরকার ফ্রি খাদ্য সহায়তা, ফ্রি রেশন, বাড়ি ভাড়া -বিদ্যুৎ-গ্যাসের বিল মওকুফ সহ নানা সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে।

সেসব দেশের ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ নিত্যপ্রয়োজনীয় ছাড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল বিক্রি করছে। আর আমাদের দেশেরএক শ্রেনির মুনাফালোভী অসুস্থ বাণিজ্য চক্রের ঘটা করা পন্যের মূল্য বৃদ্ধির আয়োজনে শ্রমজীবী মানুষের হয়েছে দূর্ভোগ। করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ বাজারে, দোকানে উপচে পড়েছে, কথা তাদের একটাই দৈনন্দিন পণ্য যদি পড়ে না পাওয়া যায় তাই আজই গোটা দু-মাসের খাদ্যপণ্য কিনে রেখে দেই।

এমন বোকাসোকা সিদ্ধান্তই বিপাকে ফেলেছে সাধারণ শ্রমজীবী, রিক্সাচালক, গার্মেন্টস কর্মী সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের সাধারণ পেশা জীবী মানুষকে।চাল,ডাল,আলু সহ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য দিনদিন যেনো বেড়েই চলেছে চাল,ডাল,আলুর দাম কেজি প্রতি ৫-১০টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

এমনই উৎসুক পরিবেশ কে পুঁজি করে এক শ্রেনির অসাধু ব্যবসায়ী তৈরি করেছে পণ্যে কৃত্রিম সংকট।মাঝে মাঝেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য।উধাও হওয়া পণ্য ও বৃদ্ধি পাওয়া মূল্য ও অসাধু ব্যবসায়ীদের যেনো রীতিমতো শত্রু হয়ে দাড়িয়েছে মোবাইল কোর্ট”।

পুরো দেশে গত কয়েকদিনে প্রায় শত অভিযান চালিয়ে মোটাদাগে জরিমানা করেও থামানো যাচ্ছে না এমন অসুস্থ মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতাকে। করোনার চেয়ে দেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্মই যেনো দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নাটোর প্রতিনিধি খান মামুন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.