সিয়াম সাধনায় আত্নিক পরিশুদ্ধতা অর্জন

মোঃ রেদোয়ান হোসেন: অন্তরাত্নার নিষ্কলুষ পরিশুদ্ধতা মানে আত্মশুদ্ধি তথা আত্মার পরম পরিশুদ্ধতা।আমরা জানি,মানুষের সকল পাপাচার সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে মানব আত্নাই প্রধান নিয়ামকের কেন্দ্রভুমি হিসেবে কাজ করে।আর ঠিক ভালো কাজগুলোও সে আত্মার মাধ্যমে হয়ে থাকে।অমর আত্না বিষয়ে মহান আল্লাহর বাণী- ক্বুল্লির্ রুহু মিন্ আমরি।
অর্থাৎ ” বলুন,আত্না আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে।” (বনী ইসরাঈলঃ৫) আর সে আত্মার পরিশুদ্ধতার জন্য হাতিয়ার হিসেবে মোক্ষম ভুমিকা পালন করে রমজানে সিয়াম সাধনা করা।মুলত সাওম ‘ত্বাকওয়া’ এর মাধ্যমেই আত্নিক পরিশুদ্ধতা অর্জনের শিক্ষা দেয়।এ বিষয়ে আল্লাহ তাআ’লা পবিত্র কুরআনে বলেন-” তোমাদের উপর সাওম ফরজ করা হয়েছে।যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি, যাতে তোমরা ত্বাকওয়া অর্জন করতে পার।” (বাকারাঃ১৮৩)
ইসলামে ত্বাকওয়ার বিশেষত্ব রয়েছে। ‘ত্বাকওয়া’ মানে হচ্ছে খোদাভীতি তথা পরহেজগারিতা অবলম্বন,যা সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের জন্যই ক্ষুধা-তৃষ্ণা কাতর হয়েও যাবতীয় পানাহার এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে।আর এটা বান্দাকে শয়তানের কুমন্ত্রণা হতে আত্বাকে ঢালের মতো করে এমনভাবে বাঁচায় যাতে বান্দার মনের মানসিক ও আত্নিক কলুষতা এবং মলিনতা দূর করে করে ফেলে।
এ কারণে রাসুল (সা.) বলেছেন – “রোজা ঢালস্বরূপ।” তবে প্রশ্ন হতে পার কিভাবে এই আত্বিক কলুষতা দূর হয়?হ্যাঁ রমজানের অর্থ যেখানে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া সেখানে উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কামারেরা হাপর দিয়ে যেমন লোহার ময়লা ধ্বংস করে সাওমও তেমনি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে আত্নার ময়লা ধ্বংস করে আত্মাকে খাঁটি ও বিশুদ্ধ করে।
রমজানে বান্দার নেক আমল অন্যান্য মাসের চেয়ে বেশি হয়।নিয়মতান্তিক নেক কাজগুলোর জন্য রমজান মাসকে মুমিনের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের মাসও বলা হয়ে থাকে।আর নেক কাজের ফলাফল হিসেবে আল্লাহ বলেন-“নিশ্চয়ই নেককাজ বদ কাজকে মুছে দেয়।” যেমন বান্দার মনের মধ্যে যদি লোভ,হিংসা,বিদ্বেষ,ক্ষোভ,ঘৃণা,অহংকার প্রভৃতি থাকে তবে সেটা পরিনত হয় নির্মল ভালোবাসা,সততা, সহমর্মিতা ইত্যাদি সদগুণাবলিতে।স্বাভাবিকভাবে আত্নার কুপ্রভৃতির বশেই বান্দা মিথ্যাচার,গীবত,অশালীন কথাবার্তা বলে বা ঝগড়া করে থাকে।
কিন্তু সিয়াম পালন করা অবস্থায় এসব না করার বিধান আত্নার পরিশুদ্ধতার জন্য সবচেয়ে বেশি কার্যকরী।যেমনটি রাসুল (সা.) বলেছেন-“যে ব্যাক্তি মিথ্যা,অশ্লীল কথা ও কাজ পরিহার করতে পারলোনা তার রোজা উপবাস থাকা ছাড়া আর কিছুইনা।”
অনেক সময় দুনিয়ার মোহে এবং অন্তরাত্মার খারাপ চিন্তার কারণে বান্দা লোক দেখানোর জন্যই ভালো কাজ করে।এমনকি কিছু ইবাদতও শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য করে থাকে।শরীয়াতের পরিভাষায় একে ‘রিয়া’ বলা হয়।কিন্তু সাওম পালন এমন এক ইবাদত যা দুনিয়ার কাউকে দেখানোর মাঝে কোনো হাকীকত নেই।তাই রাসুল (সা.) বলেছেন- ” সাওমে কোনো রিয়া বা লৌকিকতা নেই।
“বস্তুত সাওম সম্পুর্ণ আত্বিক ব্যাপার হওয়ায় বান্দার মনে একমাত্র আল্লাহকে ভয় রেখেই যাবতীয় পানাহার,পাপচার ও অনাচার থেকে বিরত থাকা হয়।এভাবে সাওমের মাধ্যমে বান্দার লোক দেখানোর কাজের খারাপ অভ্যাস বিদূরিত হয়।
মাহে রমজান নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য উপযুক্ত একটি সময়।সব মানুষেরই মনে রিপুর তাড়নায় জৈবিক চাহিদা ও যৌনাকাঙ্ক্ষার কামনা বাসনা চরিতার্থ করার প্রবল ইচ্ছা থাকে।কিন্তু সাওমের কারনে বৈধ স্ত্রীর সাথেও যৌনবাসনা পূর্ণ করার সুযোগ না থাকায় কতটুকু রিপু দমন করতে হয় তা সহজে অনুমেয়।রিপুর তাড়না দূর করতে রাসুল (সা.) বলেছেন- “যে ব্যাক্তি বিবাহে অসমর্থ সে যেন বিয়ে করে।” বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে এর নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে মানব চক্ষুর অন্তরালে পাপাচারের পথ অনেকটাই সহজ হয়েছে।
আর এই সুযোগে শয়তানের প্ররোচনায় যুবক-যুবতীরা সবচে বেশি নিজেদের চরিত্র বিসর্জন দিচ্ছে।কিন্তু রমজানের দৃঢ় আত্মসংযমে রিপু দমন চর্চা হওয়ার মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠন হয় এবং অত্নরাত্না পবিত্র হয়ে উঠে।
রমজান মাসের একটি বিশেষ দিক হলো রোজাদার বান্দার মনে ক্ষুধা-তৃষ্ণার অনুভূতিবোধ জাগ্রত হয়।এতে ধনী লোকেরা ক্ষুধিত দরিদ্র লোকদের কষ্টগুলো আত্মিকভাবে উপলব্ধি করে।আর এ উপলব্ধি থেকেই ধনীরা দরিদ্রের প্রতি  সহানুভূতিশীল হয় এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।রাসুল (সা.) বলেছেন – ওয়াশাহ্ রুল মুওয়াছাতি।অর্থাৎঃ “এ মাস সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস।
“এতে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল লোকেরা ইসলামের বিধান মেনে দরিদ্র প্রতিবেশী, আত্মীয়,অসহায় ও এতিমের খোঁজ খবর রাখে এবং দান সাদকা করে।সহযোগিতার এ মহৎ প্রচেষ্টাকে মানবমনে স্থায়ী করার জন্য রাসুল (সা.) অত্যন্ত যত্ন সহকারে রোজাদরকে ইফতারে উৎসাহিত করে বলেন-” যে ব্যাক্তি এ মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গুনাহ মোচন করা হবে এবং তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি অবধারিত।” প্রকৃতপক্ষে সাওমের কারনে  এ দান বান্দার মন থেকে কার্পণ্যতা স্বভার দূর করে হৃদ্যতাপূর্ণ মানসিকতা তৈরী করে।
সাওম পালনের মাধ্যমে অন্তরে খোদাভীতি তৈরী হওয়ায় বান্দা নেতিবাচক কাজের চিন্তা না করে সৎকর্মের চিন্তাই বেশি করে।এসময় আল্লাহর প্রতি ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার ফলে চিন্তাগত পরিশুদ্ধতা অর্জন হয়।এতে রোজদার রমজানের হক আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতিদানের জন্য মনেপ্রাণে প্রত্যাশী হয়ে থাকে।কারণ হাদীসে কুদসীতে মহান আল্লাহ পাক বলেন- “আদম সন্তানের প্রতিটি আমল নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম ব্যতিক্রম।এটা অবশ্যই আমার জন্য,আমিই এর প্রতিদান দেব।”(বুখারী,হাদিস নং- ১৯০৪)বান্দার সারাজীবনের পাপিষ্ঠ মনেরমধ্যে নেকআমলের বীজ গ্রথিত করতে হলে সিয়াম সাধনা মহৌষধ হিসেব কাজ করে।
রমজানে বান্দাকে ব্যাপক ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়।যে ধৈর্য কলুষমুক্ত অত্নরাত্বা গঠনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। রাসুল (সা.) বলেছেন- “এ মাস ধৈর্যের মাস,আর ধৈর্যের বিনিময় হচ্ছে জান্নাতের পরম সুখ।” আমরা দেখি বান্দা ধৈর্যধরে সারাদিন রোজা রেখে ইফতার সামনে নিয়ে সময়ের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে,ক্লান্ত দেহ নিয়ে তারাবীহ নামাজ আদায় করে।
এছাড়াও সেহরী খাওয়া,জামায়াতে নামাজ আদায়,কুরআন তেলাওয়াত নফল নামাজ,ইতেক্বাফ,দোয়া ও জিকির প্রভৃতি আনুষ্ঠানিক ইবাদতসমুহ বান্দা ধৈর্য সহকারে পালন করে।এ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে রোজাদার সারাবছর পাপাচার থেকে বিরত থাকতে পারে ও আল্লাহর প্রতি ইবাদতে ঝুঁকে পড়ে।
এভাবেই সাওম মানুষের অন্তরের কুপ্রভৃত্তি,পাপ পঙ্কিলতাসহ সকল কালিমা মুছে দিয়ে আত্নাকে পরিশুদ্ধ করে যাতে বান্দার আত্না পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হয়ে উঠে। তদুপরি সাওমের মাধ্যমে আত্নিক পরিশুদ্ধতার পাশাপাশি বান্দা জান্নাত প্রাপ্তির উপযোগীরুপে গড়ে উঠে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নোয়াখালী প্রতিনিধি ইব্রাহিম খলিল। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.