রাজশাহী মহানগরী ও অন্যান্য টিকাদান কেন্দ্রে টিকা নিতে মানুষের ঠাসাঠাসি

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রথমে মানুষের মধ্যে অজানা ভীতির  কারণে ও কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ-প্রচারের জন্য করোনা টিকা গ্রহণে অনীহা দেখা দিলেও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে টিকাদান কেন্দ্রে মানুষের উপচে পড়া ভীড়।
রাজশাহী মহানগরের তিনটি কেন্দ্রে করোনাভাইরাসের টিকা দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল ও সামরিক হাসপাতালে সাধারণ মানুষের টিকা নেয়ার সুযোগ নেই। শুধু রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে সাধারণ মানুষ টিকা নিচ্ছেন। এখানে সকাল থেকেই শুরু হচ্ছে মানুষের ঠাসাঠাসি।
গণটিকা কর্মসূচি শুরুর পঞ্চম দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টায় রামেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, টিকাদান কেন্দ্রের পুরো এলাকাজুড়ে মানুষের ভিড়। স্বাস্থ্যকর্মী, সাধারণ মানুষ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরাও এখানে টিকা নিচ্ছেন। বুথে যাওয়ার আগে টিকা কার্ড জমা দেয়া এবং টিকা নেয়ার সময় আলাদা দুটি লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে সবাইকে। তাতে একজন অপরজনের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। লাইন ছাড়াও অনেকে দাঁড়িয়ে আছেন ঠাসাঠাসি করে।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী, আনসার সদস্য এবং রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবীদের কোনরকম চেষ্টাও দেখা যায়নি। কারণ, সেখানে এত সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হয়েছেন যে সেখানে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করাও সম্ভব নয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা ধারণা করেননি এত মানুষ টিকা নিতে আসবেন। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি মানুষ টিকা নিতে আসায় এতো ভিড়।
টিকা নেয়ার জন্য অনলাইনে নাম নিবন্ধনের পর একটি এসএমএস-এর মাধ্যমে টিকা গ্রহণের দিন ও কেন্দ্র জানিয়ে দেয়ার কথা। এরপর নিবন্ধন করা ব্যক্তি গিয়ে টিকা নেবেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার হাসপাতালে টিকা নিতে আসা অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এসএমএস-এর জন্য অপেক্ষা করেননি।
নিবন্ধনের পরই টিকা কার্ড নিয়ে এসেছেন কেন্দ্রে। তারাও টিকা পাচ্ছেন। এ কারণে কেন্দ্রে ভিড় আরও বাড়ছে। টিকা নিতে গিয়ে একজন বৃদ্ধ বলেন, আগে যাদের করোনা হয়নি, এখানে টিকা নিতে এসেই মনে হচ্ছে তারা করোনায় আক্রান্ত হবেন। তিনি বলেন, বড় ফাঁকা কোন স্থানে গণটিকা দেয়ার ব্যবস্থা করলেই ভাল হতো। ছোট এই জায়গাটিতে এত মানুষের আসলেই দাঁড়ানোর জায়গা হবে না।
রামেক হাসপাতালের পরিচালনা অফিসের সামনে একটি ছোট ওয়ার্ড ও ওয়ার্ডের করিডোরে নয়টি টিকাদান বুথ স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি নারীদের জন্য। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতিটি বুথের সামনেই শতাধিক মানুষের ভিড় দেখা গেছে। যারা টিকা নিতে গিয়েছিলেন তারা প্রথমে লাইনে দাঁড়িয়ে ওয়েবসাইট থেকে নামানো টিকাদান কার্ড রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে জমা করছিলেন। পরে সেই কার্ডের একটি অংশ ছিড়ে নিচ্ছিলেন স্বেচ্ছাসেবকরা। এরপর তারাই কার্ড জমা দেয়া ব্যক্তিকে জানিয়ে দিচ্ছিলেন কোন বুথে গিয়ে তিনি টিকা নেবেন।
এরপর টিকাকার্ডের একটি অংশ নিয়ে আবার লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছিল। সেটি আবার বুথে গিয়ে জমা দিতে হচ্ছে। এরপর নাম ধরে স্বাস্থ্যকর্মী যাকে ডাকছেন তিনি গিয়ে টিকা নিচ্ছেন। টিকা নিতে আসা সবাই বুথ ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন। স্বাস্থ্যকর্মী ও আনসার সদস্যরা মাঝে মাঝে তাদের দূরে সরে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করলেও তা কোনো কাজে আসেনি। কারণ একে অপরের থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়াবার মতো পর্যাপ্ত জায়গা সেখানে ছিলো না। তাছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন টিকা নেয়ার জন্য নাম ধরে ডাকছিলেন তখন দূরে থাকলে তা শোনাও যাচ্ছিল না।
নারীদের জন্য নির্ধারিত একটি বুথে ভিড় কম থাকায় অনেক পুরুষকেও সেখানে গিয়ে টিকা নিতে দেখা গেছে। এছাড়া নারীদের আরেকটি বুথে ভিড় বেশি থাকায় পুরুষদের অন্য একটি বুথে নারীদেরও টিকা নিতে দেখা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত টিকা নিয়ে অধিকাংশ মানুষই বাড়ি ফিরেছেন হাসিমুখে। অনেকেই ছবি তুলে এই সময়টি বন্দি করে রেখেছেন তার মুঠোফোনে, শেয়ার করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আহ্বান জানাচ্ছেন অন্যকে টিকা দেয়ার জন্য।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানি বিটিসি নিউজকে বলেন, তাদের ধারণার থেকে বেশি মানুষ টিকা নিতে আসায় যে ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তারা করেছিলেন তা কাজে আসছে না। তিনি বলেন, ওয়েবসাইটে টিকা নেয়ার নিবন্ধন করার সময় রাজশাহী শহরের ভেতর তিনটি কেন্দ্র পাচ্ছেন। কিন্তু বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল ও সামরিক হাসপাতালে অন্য পেশার মানুষ টিকা নেয়ার সুযোগ পাননি। অনলাইনে তাদের রামেক হাসপাতালই পছন্দ করতে হয়েছে। বিজিবিও এখানে আসছে। সেজন্য বাড়তি চাপ এসে পড়েছে আমাদের ওপর। তবে চাপ সামলাতে বাড়তি ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানি বলেন, চারটি বুথ স্থাপন করে টিকাদান কেন্দ্র চালু করা হলেও বুথ বৃদ্ধি করে নয়টি করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে আরও বুথ বাড়ানো হবে যেন মানুষের ভোগান্তি কমে আসে।
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার বিটিসি নিউজকে জানান, টিকা প্রয়োগের প্রথম দিন গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিভাগে টিকা নিয়েছিলেন ৩ হাজার ৭৫৭ জন। দ্বিতীয় দিনে টিকা নিয়েছিলেন ৫ হাজার ৬৪২ জন। তৃতীয় দিনে টিকা নেন ১৩ হাজার ১১৪ জন। আর চতুর্থ দিনে টিকা নিয়েছেন ১৭ হাজার ৯৭১ জন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিভাগের আট জেলায় টিকা নিয়েছেন ২৩ হাজার ১৮০ জন। এর মধ্যে শুধু রাজশাহী মহানগরে টিকা নিয়েছেন ২ হাজার ৮৪৯ জন। এর মধ্যে পুলিশ হাসপাতালে ৪৭০, সামরিক হাসপাতালে ৬০ জন এবং রামেক হাসপাতালে ২ হাজার ৩৩৯ জন টিকা নিয়েছেন। প্রথম চার দিনে সামরিক হাসপাতালে টিকা নিয়েছেন ১১৯ জন, পুলিশ হাসপাতালে নিয়েছেন ৪৪৮ জন এবং রামেক হাসপাতালে নিয়েছেন তিন হাজার ৪৩৮ জন। প্রথম পাঁচ দিনে রাজশাহী বিভাগের ৬৩ হাজার ২৬৪ জন মানুষ টিকা গ্রহণ করেছেন। যত দিন যাচ্ছে মানুষের মাঝে টিকা নেয়ার আগ্রহ তত বাড়ছে।
টিকাদান কেন্দ্র হিসেবে ঠিক করা হলেও সামরিক ও পুলিশ হাসপাতালে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার না পাওয়ার বিষয়ে রাজশাহীর সিভিল সার্জন কাইয়ুম তালুকদার গণমাধ্যমকে  বলেন, প্রথম দিকে এই দুটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ টিকা নিতে আসা মানুষদের ফিরিয়ে দেয়ার পর আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। সামরিক হাসপাতাল আমাদের জানিয়ে দিয়েছে যে তারা বেসামরিক কেউকে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেবে না। তবে পুলিশ হাসপাতাল রাজি হয়েছে। সেখানে যদি সাধারণ মানুষকে টিকা নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে হাসপাতালে চাপ কমবে। তবে রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানিয়েছেন, পুলিশ ছাড়া অন্য কাউকে টিকা নেয়ার সুযোগ তারা তাদের হাসপাতাল থেকে দেবেন না।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার (১১ ই ফেব্রুয়ারী) অনলাইনে নাম নিবন্ধনের সময় রামেক হাসপাতাল পছন্দ করলে নিবন্ধন না হওয়ার কথা অনেকে জানিয়েছেন। আর কেন্দ্র পছন্দের তালিকায় সংক্রামক ব্যধি হাসপাতালেরও নাম দেখা গেছে। রামেক হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল ও সামরিক হাসপাতালে নিবন্ধনের সুযোগ না পেয়ে অনেকে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল পছন্দ করেই নিবন্ধন করেন। কিন্তু সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে করোনার টিকাকেন্দ্র চালুর বিষয়টি কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি।
সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আঞ্জুমান আরা, সিভিল সার্জন ডা. কাইয়ুম তালুকদার ও রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস বিটিসি নিউজকে জানিয়েছেন, নাম নিবন্ধনের সময় অনলাইনে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল টিকাকেন্দ্র হিসেবে বেছে নেয়ার সুযোগ কেন আসছে তা তারা জানেন না। রামেক হাসপাতালও পছন্দ করতে না পারার বিষয়ে ডা. আঞ্জুমান আরা বলেন, হাসপাতালে সাত হাজার ব্যক্তিকে টিকা দেয়া হবে বলে কথা ছিল। সে কারণে এই হাসপাতাল পছন্দ করার সুযোগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে বিষয়টি তিনি নিশ্চিত নন। ডা. সাইফুল ফেরদৌস বলেন, অনলাইনের ওয়েবসাইটের কোন কিছু তারা নিয়ন্ত্রণ করেন না। তাই কেন নাম নিবন্ধন হচ্ছে না তা তিনিও জানেন না। তবে এটি কারিগরি ত্রুটি হতে পারে বলে তিনি ধারণা করেন।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য মোট ৩১ হাজার ডোজ টিকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আর মহানগর ও জেলার ৯ উপজেলার জন্য বরাদ্দ ১ লাখ ৮০ হাজার ডোজ টিকা। এই টিকা ৯০ হাজার জনকে দেওয়া যাবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মোঃ মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.