কতটা ক্ষতিতে তুরস্ক-সিরিয়া?

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: তুরস্ক এবং সিরিয়ায় উদ্ধার অভিযানে জীবিত মানুষ পাওয়ার সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। কেবল অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটছে। এই অলৌকিক ঘটনা দেখার অপেক্ষায় হাজারো স্বজন। তাদের আশা যে হয়তো অলৌকিকভাবেই বেঁচে যাবে তার মা-বাবা, সন্তান, বোন বা অন্য কেউ।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি কয়েকটি ভূমিকম্পে যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে দুই দেশের একাংশ। ইউনিসেফ জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত একসময় উদ্ধার অভিযান বন্ধ করে দিতে হবে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই হয়তো অনেকের লাশ দাফন হয়ে যাবে। মৃত্যুর সংখ্যা এতটা ভয়াবহ হতে পারে যা হবে খুবই বেদনার।
কতটা ক্ষতি হয়েছে দুই দেশের: যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান জে পি মরগ্যান জানিয়েছে, তুরস্কের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার যা দেশটির জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এই ক্ষতি প্রত্যক্ষ। পরোক্ষ ক্ষতির হিসাব এই মুহূর্তে পাওয়া সম্ভব নয়। ভূমিকম্পে তুরস্কের ১০টি ও সিরিয়ার চারটি প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ জানিয়েছে, ভূমিকম্পের পর এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৫৮টি আফটারশক হয়েছে। মৃতের সংখ্যা ৫০ হাজারের কাছাকাছি চলে গেছে।
এর মধ্যে তুরস্কে ৪০ হাজারের বেশি এবং সিরিয়ায় প্রায় ৬ হাজার। তুরস্ক সরকার ৩ লাখ ৮৭ হাজার বাড়ি পরিদর্শন করেছে। এর মধ্যে ৮৪ হাজার বাড়ি হয় ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ হাজারের বেশি বাড়ি যা এখনই ভেঙে ফেলতে হবে। ভূমিকম্পে তুরস্কের প্রায় ৬ হাজার ভবন পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। পাশাপাশি আরো ৭৪ হাজার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেগুলো আর বসবাসের উপযোগী নেই। এ সব ভবন থেকে ৩ লাখ ৭৪ হাজার বাসিন্দাকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ধ্বংসাবশেষের মধ্যে উদ্ধার কার্যক্রম কতদিন চলবে তার নির্দিষ্ট দিন বলা যাবে না বলে জানিয়েছে প্রকৌশলীদের একটি সংগঠন। সাধারণ মানুষও বলছেন, তুরস্কের ইতিহাসে এত বড় বিপর্যয় ঘটেনি কখনো। যারা বেঁচে আছেন, প্রায় সবারই চেনা পরিচিত বহু মানুষ আর নেই। ক্রমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তুরস্ক। বহু দেশ ত্রাণসামগ্রী এবং উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। সিরিয়ায় এ সব হিসাব দূরের কথা, প্রাথমিক ধাক্কাই তারা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অভিযোগ, ত্রাণ সেভাবে পাচ্ছে না তারা।
একটি গবেষক সংস্থা জানিয়েছে, তুরস্কের ৯৫ শতাংশ জমি ভূমিকম্পপ্রবণ। গোটা দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি অনেক বেশি। পূর্ব আনাতোলনিয়া এবং ইস্তাম্বুলের মতো বড় শহরও এর মধ্যেই পড়ে। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তুরস্কে পাঁচটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৯০০ সাল থেকে সে দেশে ৭৬টি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। তাতে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৯০ হাজার মানুষ।
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ২ কোটির বেশি। এর মধ্যে তুরস্কে ১ কোটি ৩৫ লাখ এবং সিরিয়ায় ১ কোটির বেশি মানুষ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জানিয়েছে, ক্ষতির মুখে পড়া মানুষদের মধ্যে ৭০ লাখই শিশু। ধ্বংসাবশেষের ভেতর হাজার হাজার শিশু মারা যাওয়ার আশঙ্কা করছে ইউনিসেফ।
সংস্থাটি জানায়, তুরস্কে ১০টি প্রদেশে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ৪৬ লাখ। আর সিরিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ২৫ লাখ। ইউনিসেফ আশঙ্কা করছে, সেখানে হাজার হাজার শিশু মারা গেছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, এমন হাজারো শিশু জীবিত ফিরেছে যারা আর কখনো মা-বাবাকে দেখতে পাবে না। এমন সংখ্যা অবিশ্বাস্যই হতে পারে বলে মনে করে সংস্থাটি। কেবল মৃত্যু নয়, অনেক শিশুকে আশ্রয় পেতে হয়েছে রাস্তায়। হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রার মধ্যেই মা-বাবার কোলে রাস্তায় রাত কাটাতে হচ্ছে তাদের। এর ফলে তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। তীব্র শীত, তুষার ও বৃষ্টির মধ্যে জীবন চালানোর কারণে অনেক শিশু হাইপোথারমিয়া ও শ্বাসযন্ত্রের নানা জটিলতায় ভুগছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতে হঠাৎ তাপমাত্রা অনেক কমে গেলে শিশুদের যেসব স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়, তার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো হাইপোথারমিয়া বা শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা হ্রাস। এতে মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে ভূমিকম্প কর হিসেবে ৩০০ কোটি ডলার নেওয়া হলেও তা কোনো কাজে আসেনি। অবকাঠামোর মানে উন্নতি হয়নি। ভবন নির্মাণে ব্যাপক ত্রুটি থাকলেও সরকার দেখেও না দেখার ভান করেছে। ফলে কেবল ভবনই তৈরি হয়েছে, মানসম্মত হয়নি।
সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিদ্রোহীদের নেতা হাইতাম রহমা জানিয়েছেন, সেখানে চার শতাধিক ভবন ধ্বংস হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সংখ্যা ১ হাজার ৩০০টির বেশি।
সিরিয়ার জাতীয় ভূমিকম্প কেন্দ্রের প্রধান রায়েদ আহমেদ জানিয়েছেন, ইতিহাসে এর থেকে তীব্র ভূমিকম্প হয়নি তাদের দেশে। অন্তত যবে থেকে ভূমিকম্পের মাত্রা নথিভুক্ত করা হচ্ছে, তার পর থেকে এত তীব্র ভূমিকম্প সে দেশ দেখেনি।
আশ্রয়হীনরাই যখন আবার আশ্রয়হীন: সিরিয়ার যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যে হাজার হাজার শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছিল, ভূমিকম্পের পর এখন তাদের ফিরে যেতে হচ্ছে। শরণার্থীরা তাদের নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার আশায় সিরিয়ার সীমান্তে এসে হাজির হয়েছে।
তুরস্ক বলছে, তারা এই শরণার্থীদের ছয় মাসের জন্য ফিরে যেতে দেবে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধেও পর আড়াই লাখের বেশি নাগরিক তুরস্কে চলে যান। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তাদের কিছু না বললেও দেশে ফিরতে হচ্ছে নিজের দেশে গড়া বাসভবনের অবস্থা দেখতে। তুরস্ক বলছে, তারা এই শরণার্থীদের ছয় মাসের জন্য ফিরে যেতে দেবে। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.