এরদোয়ানের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ভূমিকম্প

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে ওঠতে পারেনি তুরস্ক। বিশাল এলাকা জুড়ে ধ্বংসের ছাপ রেখে গেছে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প। প্রতিদিন বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। সংখ্যাটি এখন ৫০ হাজার ছুঁইছুঁই করছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের বিধি না মেনে তৈরি ইমারতগুলো। এ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে জনমনে। বিষয়টি ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পথে বাধা হয়ে উঠতে পারে।
এরদোয়ান বলেছেন, ‘এখন ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময়। জাতীয় সংহতি গড়ার এখনই সময়।’ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে তিনি কথাগুলো বলেন। ১৪ মে দেশটিতে নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই হিসাবে এখন সেখানে পুরোদস্তুর নির্বাচনি প্রচারাভিযানের সময়। কিন্তু প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প বদলে দিয়েছে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নকে পুঁজি করেই এরদোয়ান এ পর্যন্ত কয়েকটি নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছেন। তবে এবার সেই ইস্যু তিনি কতটা কাজে লাগাতে পারবেন, তা বলা কঠিন। ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) এ নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতাই শনিবার জানান, সন্দেহভাজন ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণকারী হিসেবে ১০টি প্রদেশে ১৩১ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে ১১৩ জন। তাঁদের মধ্যে একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের প্রধানও রয়েছেন। ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্ট দিয়ে দেশত্যাগের অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।

পরিবেশমন্ত্রী মুরাত কুরুমের দেওয়া তথ্যমতে, মোট ১ লাখ ৭০ হাজার স্থাপনা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধসে পড়েছে প্রায় ২৫ হাজার ভবন।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে তুরস্কের ইজমিতে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের ওপর প্রাণহানি ঘটেছিল। এরপর বিশেষ যোগাযোগ কর প্রবর্তন করে প্রেসিডেন্ট বুলেন্ত ইচেভিতের সরকার। সাধারণভাবে এটি ভূমিকম্প কর নামেই পরিচিতি পায়।
যদিও সাময়িকভাবে এটি চালু হয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটা আর উঠিয়ে নেওয়া হয়নি। দেশটির জনগণকে এখনো সেই করের বোঝা টানতে হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের কাজে কর থেকে পাওয়া অর্থ খরচ করার কথা ছিল। তবে সেটা সেভাবে খরচ হয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

ভূমিকম্পের আগে নির্বাচনী প্রচারের প্রধান ইস্যু ছিল দুর্বল অর্থনীতি এবং শরণার্থী। ভূমিকম্পের পর ইস্যুগুলো হারিয়ে না গেলেও বিধিমালা না মেনে ভবন তৈরি, উদ্ধার অভিযান ও ত্রাণ তত্পরতাই সামনে চলে এসেছে। ভূমিকম্পের দুই দিন পর এরদোয়ান সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কারামানমারাস পরিদর্শন করেন।

তিনি উদ্ধার তৎপরতায় ত্রুটির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ ধরনের বিপর্যয়ের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে তৈরি থাকা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। এবারের ভূমিকম্পও ছিল ’৯৯-এর প্রায় কাছাকাছি মাত্রার। তবে এটি হয়েছে অনেক সময় ধরে। আবহাওয়া বৈরী থাকায় মানুষ প্রাথমিক ধাক্কার পর ঘরবাড়ি ছেড়ে বের হয়ে কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে।
এই সময় দ্বিতীয় ধাক্কায় অনেক ভবন ধসে পড়ে বা আংশিক ধসে যায়। ফলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আগের বারের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। ২০১৮ সালে এমন আইন পাশ হয়, যাতে ভূমিকম্প বিধি মানা ছাড়া ভবনগুলো ভেঙে ফেলার হাত থেকে রক্ষা পায়। বিষয়টি বিরোধী পক্ষ নির্বাচনের প্রচারাভিযানকালে প্রাধান্য দিলে তা এরদোয়ানকে বেকায়দায় ফেলতে পারে।
‘তুরস্কের রাষ্ট্রকাঠামোর বিভিন্ন পর্যায়ে এখন গোষ্ঠীতন্ত্রের প্রভাব আছে এবং এর জন্য যথেষ্ট সামাজিক মূল্য গুনতে হচ্ছে’—বলছিলেন জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির স্কুল অব অ্যাডভান্স ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের লিসেন হিন্টস। তিনি মনে করেন, ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সমস্যার আংশিক মানবসৃষ্ট। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার ফলে অন্তত ১০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে। অনেককে এখন রাস্তায় ঘুমাতে হচ্ছে। ধসে পড়া বাড়িঘর থেকে সংগ্রহ করা কাঠ পুড়িয়ে তারা শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। উদ্ধারকারী দল দ্রুত পাঠানো হয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে।

আঙ্কারাভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইউসুফ এরিম টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেছেন, ‘প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ যে হারে হয়েছে, সেটা তুরস্কের উদ্ধার সক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি।’ ১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পের পরও ঠিক এরকম অভিযোগ উঠেছিল। ঐ ঘটনার জেরে শেষ পর্যন্ত ইচেভিত সরকারের বিদায় ও এরদোয়ানের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হয়।
এরদোয়ান তুরস্ককে নতুন করে তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি নতুনভাবে তৈরি করেছেনও বটে। তবে তার সুফল পেয়েছে কেবল ক্ষমতাসীন ও এলিট শ্রেণি। বর্তমান বিপর্যয় কি তাহলে এরদোয়ানের বিদায় ও নতুন কারো আগমণের পথ তৈরি করে দেবে—এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের মে মাসের নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.