খুলনাস্থ ভারতীয় ভিসা আবেদনকেন্দ্রে সংকটের যেন শেষ নেই

 

খুলনা ব্যুরো: দাকোপ থেকে কেএম আজগর হোসেন সাব্বির নামের এক ব্যক্তি ট্যুরিষ্ট ভিসার আবেদন জমা দেয়ার জন্য এসে সকাল সাড়ে আটটায় লাইনে দাঁড়ান নগরীর বয়রাস্থ ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রে। সাড়ে ১১টার দিকে তিনি হাতে পান আবেদন জমা দেয়ার জন্য শর্ট স্লিপ। এরপর অফিসে ঢুকে অপেক্ষার পালা।
মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টায় যখন তার সাথে কথা হচ্ছিল তখনও তার সামনে একশ’ সিরিয়াল। কখন ডাক পরবে সেই অপেক্ষায় থাকা সাব্বিরকে মাঝে-মধ্যে অফিসের বাইরে আসতে দেখা যাচ্ছিল। কথা হলে তিনি জানান, ভেতরে প্রচন্ড গরম। এসিতে কাজ করছে না। তাই তিনি একটু হাফ ছাড়ার জন্য বাইরে আসছেন আবার ভেতরে যাচ্ছেন।
আসগর হোসেন সাব্বিরের ন্যায় আরও অনেককে স্লিপ নিয়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। কেউ কেউ ভেতরে ঢুকতে চাইলে কর্তব্যরত গার্ড বলছেন, ‘ভেতরে গিয়ে লাভ নেই, এখনও অনেক দেরি।’ দুপুর ১২টার পরও যখন ভিসা আবেদন কেন্দ্রের বাইরে দীর্ঘ লাইন তখন সেখানে কর্মরত পুলিশকে স্লিপ প্রিন্ট করে এনে লাইনের লোকদের মধ্যে সরবরাহ করতে দেখা যায়। অর্থাৎ স্লিপধারীরাই কেবল গতকাল আবেদন জমা দেয়ার সুযোগ পাবেন। কিন্তু কতক্ষণ লাগবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই কারও কাছে।
আবেদন জমা দিতে গিয়ে কেউ বের হলেই কিছু লোকের হৈ-হুল্লোর শুরু হয়। ‘কি ভাই, কি হয়েছে ? আবেদন জমা নেয়নি ? আসেন এদিকে আসেন’। এভাবে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় রাস্তার বিপরীত দিকের একটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের পাশের গলিতে। সেখানে গজিয়ে ওঠা একাধিক ফরম পূরণ কেন্দ্রে নিয়ে করা হয় দেন-দরবার। এমন একজনকে গতকাল দেনদরবার করতে দেখা যায় মেইন রাস্তার ওপর বসেই। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে একজন কলেজ শিক্ষককে জনৈক ব্যক্তি বললেন, ‘আমরা আপনাকে করোনার ভ্যাকসিন সনদ তৈরি করে দেবো, আসেন এদিকে আসেন’।
এভাবে নানা সংকটের মধ্যদিয়েই জমা দিতে হয় ভারতীয় ভিসা আবেদন ফরম। খুলনা মহানগরীর বয়রার নতুন এ ঠিকানায় বিগত দু’সপ্তাহ ধরে ঘুরে মিলেছে এমন নানা চিত্রবিচিত্র দৃশ্যপট।
ডুমুরিয়ার চুকনগর থেকে ভিসা আবেদন জমা দিতে আসা এক নারী তার স্বামীর ২০১১ সালে শুরু করা একটি ব্যাংক হিসাব থেকে স্টেটমেন্টসহ জমা দিতে আসলেও তার আবেদন জমা নেয়া হয়নি। বলা হয় বিগত ছয়মাসের লেনদেন লাগবে। অথচ ওই হিসাবে লেনদেন ছিল পাঁচ মাসের এবং টাকা জমা ছিল এক লাখেরও বেশি।
খালিশপুরের বিআইডিসি রোড থেকে আসা মো: হাবিব নামের এক ব্যক্তিকে সম্প্রতি ফিরিয়ে দেয়া হয় আবেদন ভুল বলে। কিন্তু কি ভুল সেটি উল্লেখ না করে বলা হয় ডলারের পরিবর্তে ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ যেতে। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ গেলেও আবেদন জমা নেয়া হয়নি। এরপর তিনি আর যাননি।
জাতীয় পরিচয়পত্রে ঠিকানা খুলনা থাকলেও পাসপোর্টে স্থায়ী ঠিকানা যশোর থাকায় সম্প্রতি সুস্মিতা ঘোষ নামের এক ছাত্রীর আবেদনও জমা নেয়া হয়নি। যদিও তার আবেদনপত্রে স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ ছিল।
আব্দুল্লাহ আল মামুন নামের এক ব্যক্তি আবেদন জমা দিতে আসেন কয়রার মদিনাবাদ এলাকা থেকে। কিন্তু তার ব্যাংক স্টেটমেন্ট ছিড়ে রাখা হয় ৮ নম্বর কাউন্টার থেকে। সেখানে কর্মরত কল্লোল নামের এক ব্যক্তি ওই স্টেটমেন্ট ছিড়ে রাখলেও এর কারণ তিনি জানাননি। তাছাড়া আবেদনকারীর সাথে খারাপ আচরণ করেন বলেও অভিযোগ করা হয়।
তপু বসু নামের এক আবেদনকারী আসেন বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে। তারও ব্যাংক স্টেটমেন্ট ছিড়ে রেখে আবেদন ফেরত দেয়া হয়।
এভাবে যাদের আবেদন ফেরত দেয়া হয় তাদেরকে অবশ্য আগেই অনলাইনে টাকা জমা দিতে যেতে হয়। প্রতিটি আবেদনের জন্য ৮২৪টাকা জমা দিতে হলেও যেসব ব্যবসায়ী টাকা জমা দিয়ে দেন তারা ৮৫০ টাকা নিয়ে থাকেন। অর্থাৎ একবার আবেদন গ্রহণ না করা হলেও ওই টাকা গচ্চা যায়।
আবেদন জমা দিতে কেন্দ্রে প্রবেশের পরও অপেক্ষমান কক্ষের ব্যাপারেও বিরূপ মন্তব্য করেন অনেকে। সেখানে প্রচন্ড গরমে বসার উপায় থাকে না অনেকের। অনেক সময় অসুস্থ লোকজন সেখানে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে গিয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসি থাকলেও তা প্রায় অকেজো। অনেককেই ঘামতে দেখা যায়। কিন্তু অনেকটা অসহায় অবস্থায়ই অপেক্ষা করতে থাকেন তারা।
ভিসা আবেদনকেন্দ্রের ভেতরে-বাইরে এমন নানা সংকট থাকলেও সবচেয়ে বড় সমস্যা সৃষ্টি করে এক শ্রেণির কথিত দালাল। যারা টিকা সনদ থেকে শুরু করে অনেক কাগজপত্রই তৈরি করে দেন নিজেদের কম্পিউটার থেকে।
সরেজমিনে গিয়ে সেখানের বিশ্বাস ইনভেস্টিগেশন সেন্টারের পেছনের দু’টি ভবনের একাধিক প্রতিষ্ঠানেই এমনটি দেখা গেছে। আবার যেসব আবেদনকারী টাকা জমা দিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে চান তাদেরকে ধরে ওইসব কথিত দালাল গোপনে ওইসব ঘরে নিয়ে আবেদনে ভুল রয়েছে এমনটি বলে তাদের কাছ থেকে অবৈধ অর্থ হাতিয়ে নেয় এমন অভিযোগও রয়েছে। বিগত দু’সপ্তাহে এমন নানা চিত্র দেখা গেছে সরোজমিনে পরিদর্শনকালে।
বিশেষ করে ভিসা আবেদনকেন্দ্রের দোতলার সাথে কেন্দ্রের কোন সম্পর্ক না থাকলেও অনেকেই সেখানে গিয়ে প্রতারিত হন এমন অভিযোগও রয়েছে। অনেক আবেদনকারী মনে করে থাকেন কেন্দ্রের দোতলার প্রতিষ্ঠান থেকে ফরম পূরণ করলে বাড়তি সুযোগ পাওয়া যাবে। এজন্য অনেকেই সেখানে গিয়ে ফরম পূরণ করিয়ে থাকেন। আবার আবেদন করার জন্য সম্প্রতি সেখানে গেলে কর্মরত একজন এ প্রতিবেদককে গর্ব করেই বললেন, ‘আপনি এসেছেন কোন জায়গায় বুঝতে হবে, ভিসার ব্যাপারে আপনার চিন্তা করতে হবে না’। অর্থাৎ ওই প্রতিষ্ঠানের সাথে আবেদন কেন্দ্রের গোপন সম্পর্ক রয়েছে এমন দাবিও অনেকের।
এভাবে খুলনাস্থ ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রে যেন সংকটের শেষ নেই। আবার সেখানে অবস্থানরত কথিত দালালদের সাথে অনেক সময় পুলিশেরও বেশ সখ্যতা দেখা যায়। প্রায়ই দুপুরের পর কখনও পোশাক পরা অবস্থায় আবার কখনও সাদা পোশাকে গিয়ে ওইসব দালালদের সাথে গোপনে কথা বলতে দেখা যায়।
এ ব্যাপারে কেএমপির সোনাডাঙ্গা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মো: মমতাজুল হক বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, কেডিএ এভিনিউতে থাকা অবস্থায় সেখানে দালালদের দৌরাত্মের ব্যাপারে অনেক অভিযোগ ছিল। কিন্তু নতুন জায়গায় যাওয়ার পর তিনি এমন অভিযোগ এখনও পাননি। তবে অভিযোগ আসলে অবশ্যই পুলিশী তৎপরতা বৃদ্ধি করা হবে। অবশ্য, ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র বর্তমানে একটি নিরাপত্তাহীন স্থানে করা হয়েছে বলেও তিনি শিকার করেন। এমনকি এ ব্যাপারে তিনি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পত্রও লিখেছেন।
ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রের এমন নানা সংকটের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষীয় কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রের সুপারভাইজার সাথী সাহা বলেন, সকল প্রকার তথ্য দেয়া নিষেধ আছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর খুলনা ব্যুরো প্রধান এইচ এম আলাউদ্দিন এবং মাশরুর মুর্শেদ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.