বিটিসিআন্তর্জাতিকডেস্ক: ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিলের ঘটনা। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় এবং লাক্সারিয়াস জাহাজ টাইটানিক ক্যাপ্টেন অ্যাডওয়ার্ড জন স্মিথের নেতৃত্বে সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। এর এক বছর আগে ১৯১১ সালের ৩১ মে টাইটানিক প্রথম সমুদ্রে ভাসানো হয়। আর সে দৃশ্য দেখতে সে সময় প্রায় ১ লাখ লোক জড়ো হয়েছিল।
কেমন ছিল টাইটানিক?
ইংল্যান্ডের লিভারপুল ডকে নির্মাণ করা হয়েছিল এই জাহাজ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভিআইপি কিংবা প্যাসেঞ্জার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবার মধ্যেই টাইটানিক নিয়ে উত্তেজনার কমতি ছিল না। এক্সাইটমেন্ট কেনই বা হবে না, সেই সময়ে এমন বিলাসবহুল জাহাজতো আর ছিল না। আজ থেকে প্রায় ১১০ বছর আগে ওই টাইটানিক বানাতে খরচ পড়েছিল ৭.৫ মিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানের ৪ শ’ মিলিয়ন ডলারের সমান বলা যায়। শিপের ভেতরে যে ফ্যাসিলিটি আর ডেকোরেশন ছিল, তা ফাইভ স্টার হোটেল থেকে কোনো অংশে কম না।
স্টেইন্ড গ্লাসের তৈরি জানালা, অরনেট ওড প্যানেলিং, ২ টি বড় গ্র্যান্ড স্টেয়ারকেস, হিটেড সুইমিংপুল, টার্কিশ বাথ, ইলেক্ট্রিক বাথ, জিম, স্কোয়াশ কোর্ট, ৪ টি রেস্টুরেন্ট, একটি লাইব্রেরি, বাগান, এমনকি স্যালনও ছিল। আর এর আলোকসজ্জার জন্য ১০ হাজার বাল্ব সংযোজন করা হয়েছিল।
যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ছিল ৩ হাজার ৩ শ’ জনেরও বেশি। এতো বিপুল সংখ্যক যাত্রী ও তাদের মালামাল নিয়ে ঘণ্টায় ২৭ মাইল বেগে ছুটতে পারতো টাইটানিক। আর সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি তা হলো, টাইটানিকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। হোয়াইট স্টার লাইন কোম্পানি দাবি করেছিল যে, এটি এমন এক জাহাজ যা কখনোই ডুববে না। অর্থাৎ, এতোটাই সেইফ টাইটানিক! এমনকি জাহাজের ডিজাইনার থমাস এন্ড্রুও দাবি করেছিলেন, টাইটানিক আনসিংকেবল।
কেন বলা হয়েছিল টাইটানিক কখনো ডুববে না?
এবার আসি কেন বলা হয়েছিল, ‘টাইটানিক ইজ আনসিংকেবল’? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য ফিরে যেতে হবে ১১০ বছর আগে, জানতে হবে আসলে কী ঘটেছিল আটলান্টিক মহাসাগরে? টাইটানিকের ডিজাইনার থমাস এন্ড্রু এবং নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের এই দাবির পেছনে আসলে কি কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন? এর মূল কারণ খুঁজে পাওয়া যায় টাইটানিকের নকশায়। মূলত ২ টি কারণে টাইটানিককে বলা হয়েছিল আনসিংকেবল।
প্রথমত, এই জাহাজের ভেতরে নিচের দিকে ‘ডাবল বটম হাল’ ছিল। অর্থাৎ এর মেইন যে বডি ছিল তার ২ টি লেয়ার। এই ২ লেয়ার থাকার সুবিধা হচ্ছে, নিচে একটি যদি কোন কারণে নষ্ট হয়েও যায়, তাহলে অন্য লেয়ারটির কারণে জাহাজটি ডুববে না।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, পুরো জাহাজের বডিকে ১৬টি আলাদা ওয়াটার টাইট আলাদা কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রত্যেকটি একটি আরেকটি থেকে আলাদা এবং মধ্যবর্তী যাতায়াতের দরজাগুলো ছিল ওয়াটার রেসিস্ট্যান্ট। এই রকম কম্পার্টমেন্ট টাইটানিকেই প্রথম যুক্ত করা হয়, এর আগে কখনো,কোন জাহাজে এরকম কমপার্টমেন্ট যুক্ত করা হয়নি। যদিও বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি জাহাজে এবং ডুবোজাহাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে এই কম্পার্টমেন্ট ব্যবস্থা।
কোন দুর্ঘটনায় জাহাজে পানি ঢোকা শুরু করলে ক্যাপ্টেইনের আদেশে নৌযানের যে অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শুধু মাত্র সেই অংশের কম্পার্টমেন্ট বন্ধ করে দিলে জাহাজের মধ্যে ঢোকা পানি শুধুমাত্র জাহাজের একটি কম্পার্টমেন্টকেই পূর্ণ করবে, কিন্তু জাহাজের বাদবাকি অংশে পানি ঢুকতে পারবে না। এর ফলে জাহাজে বিশাল ছিদ্র থাকা স্বত্ত্বেও তা অনায়াসে পানিতে ভেসে থাকতে পারবে। তবে টাইটানিকের ক্ষেত্রে সেই ‘ওয়াটার রেসিস্ট্যান্ট কম্পার্টমেন্ট’ কিংবা ‘ডাবল বটম হাল’ কোনো কাজে আসেনি। কেননা, ধাক্কা লেগেছিল জাহাজের সামনের অংশে ডানদিকে।
টাইটানিক অ্যান্ড কন্সপিরেসি থিওরি
এই মর্মান্তিক জাহাজডুবির ঘটনার এত বছর পরেও টাইটানিক নিয়ে কন্সপিরেসি থিওরি নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন। আর এসব পাকাপোক্ত হয় এই জাহাজডুবির ৮৭ বছর পূর্তিতে অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে যখন রবিন গার্ডনার তার লেখা বই: TITANIC : The Ship that Never Sank? -এ দাবি করেন যে টাইটানিক কখনই ডুবেনি। আর তার দাবি অনেকটাই মিলে যায় কথিত টাইটানিক এর বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের দেয়া সাক্ষ্যের সাথে।
বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের মতে ডুবে যাওয়া টাইটানিকের লোগো ছিল অন্যরকম। আর তা কোনভাবেই টাইটানিকের সাথে মিলে না।
শত বছর পরও টাইটানিকের ডুবে যাওয়া মানুষকে যেভাবে শিহরিত করে, ভবিষ্যতেও হয়তো একে নিয়ে নতুন কোনো রহস্য সৃষ্টি হবে। এর কারণেই হয়তো, ১১০ বছর পরেও ১৯১২ সালের ১৫ই এপ্রিল সেই ১৫১৭ জন যাত্রীর মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে সমুদ্রের নিচে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে টাইটানিক। সেই মর্মান্তিক ঘটনার প্রায় ৭৪ বছর পর ১৯৮৬ সালের ১৪ জুলাই সমুদ্রের নিচে টাইটানিক পুনরাবিষ্কার করেন বালার্ড।
বালার্ড টাইটানিক আবিষ্কার করার পর থেকেই মানুষ সাবমেরিনে করে সেখানে ঘুরতে যায়। এই সাবমেরিনগুলো টাইটানিকের যেসব জায়গায় ল্যান্ড করে, সেসব জায়গাতে দাগ তো পড়েছেই, অনেক জায়গায় গর্তও হয়ে গেছে। আর ঘুরতে গিয়ে মানুষ জাহাজ থেকে কয়েক হাজার জিনিস নিয়েও গেছে।
এমনকি অনেকে নিয়ে গেছে জাহাজের টুকরোও! তখন থেকেই টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণের দাবি ওঠে। পরবর্তীতে ইউনেস্কো টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষকে আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে। (সূত্র: বিবিসি)। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.