সুদিন হারিয়েছে নাটোরের ঐতিহ্যের মৃৎশিল্প

বিশেষ (নাটোর) প্রতিনিধি: শৌখিনতা বাঙালির সঙ্গেই সম্পৃক্ত। রঙ আর নকশার সম্মিলনে ঐতিহ্যের এসব স্মারক যুগে যুগে নানা আনুষ্ঠানিকতায় সমৃদ্ধ করেছে বাঙালি সংস্কৃতি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমা আর জীবনের বৈচির্ত্যহীন আবর্তে ফিকে হয়ে যাচ্ছে শৌখিন শিল্প উপকরণ মাটির তৈরি তৈজসপত্র।
উত্তরের জেলা নাটোরে ছিল পাল সম্প্রদায়ের বসবাস। কয়েক দশক আগেও নাটোর শহরতলীর তেবাড়িয়া পালপাড়ায় বাস করতেন ২৮ পাল কারিগর। কর্মনৈপূণ্যে তারা প্রতিদিন তৈরি করতেন মাটির হাঁড়ি, টব, সানকি, কুপির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র।
এসব পণ্য বিক্রি হতো নাটোর ও আশপাশের জেলার হাটবাজারে। উৎসব পারবণসহ সারাবছরই মানুষ কিনতেন এসব সামগ্রী। তৈরি আর বিক্রির মধ্যে জীবন-জীবিকা ভালোভাবেই নির্বাহ করতেন মৃৎ কারিগররা।
কিন্তু সেই সুদিন হারিয়েছে কয়েক যুগ আগে। এক ঘর দুই ঘর করে কমতে কমতে পাল পরিবারের সংখ্যা নেমেছে ৮এ। বেঁচে নেই নিপুণ হাতের সেই মৃৎ কারিগরদের অনেকেই। নিত্যজীবনে কাঁচ, প্লাস্টিক আর এলুমিনিয়ামের তৈজসপত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে এখন। আর তাতেই সুদিন হারিয়েছি ঐতিহ্যের মৃৎশিল্প। তাই হাঁড়ি, সানকি, টবের পরিবর্তে এখন মৃৎ কারিগররা তৈরি করছেন শৌচাগারের পাট।
কিছুটা চাহিদা থাকায় এ পাট তৈরি আর বিক্রি করেই জীবনযাপন করছেন মৃৎ কারিগররা। মৃৎশিল্পের হারানো সুদিন ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় একে একে পেশা পরিবর্তন করেছেন দক্ষ কারিগররা।
মৃৎ কারিগররা জানান, মাটির তৈরি নিত্য প্রয়োজনীয় তৈজসপত্রের বদলে এখন তৈরি করছেন শৌচাগারের পাট। তিনটি পৃথক আকারের (২৮, ৩২ ও ৩৪ ইঞ্চির) মাপে তৈরি এসব পাট ১২০-১৬০ টাকায় বিক্রি করে সংসার চালান তারা। এতেও নতুন সঙ্কট হিসেবে দেখা দিয়েছে মাটির অভাব। আবাদি জমি খননে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকায় পাট তৈরির মাটি পাওয়া যাচ্ছে না চাহিদামতো।
এক ট্রলি মাটি কোনোভাবে মিললেও ৮০০ টাকার পরিবর্তে দাম দিতে হচ্ছে দেড় হাজার টাকা। কয়েক বছর আগেও এক ট্রলি মাটি দিয়ে ৩০০ শতাধিক পাট তৈরি সম্ভব হলেও এখন ২৪০টির বেশি তৈরি করা যায় না।
মৃৎশিল্পী তাপস পাল বলেন, এখন আর হাঁড়ি ও সানকি বাজারে বিক্রি হয় না। এখন দইয়ের জন্যছোট সাইজের হাঁড়ি তৈরি করি। তবে পরিশ্রম অনুযায়ী লাভ হয় না।
মৃৎশিল্পী সুশান্ত পাল বিটিসি নিউজকে বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা মাটি না পাওয়া। প্রশাসন আবাদি জমি কাটা বন্ধ করেছে। মাটি পেতে কষ্ট হচ্ছে। প্রশাসন আমাদের মাটির ব্যবস্থা না করেলে অদূর ভবিষ্যতে এ শিল্পকে আর বাঁচানো যাবে না।
মৃৎ কারিগর কার্তিক পাল বলেন, এখন আর মাটির তৈরি জিনিস মানুষ কেনে না। এছাড়া মাটিও পাওয়া যায় না ঠিকমতো, দামও বেশি। ফলে নিরুপায় হয়ে পাট তৈরি করি।
মৃৎশিল্পের দূরাবস্থায় বিকল্প পেশা হিসেবে চানাচুর ভেজে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালান অর্চনা দাস। তিনি বলেন, তিন মেয়ের পড়ালেখা ও ভরণ-পোষণের অর্থ জোগাড় করতে অনিচ্ছা সত্বেও এই কাজে বাধ্য হয়েছি। জীবন তো চলে না।
নাটোর এনএস সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খসরু আলম বিটিসি নিউজকে বলেন, মৃৎশিল্প সম্পৃর্ণ পরিবেশ বান্ধব আর বাঙালির ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। মৃৎশিল্পীদের সামাজিক মর্যাদা, মূল্য ও ভর্ত‚কি দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে এই শিল্প সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।
নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী বিটিসি নিউজকে বলেন, শৌখিন মৃৎশিল্প এখন তার কদর ও জৌলুস হারিয়েছে। এটি খুবই দুঃখ জনক, যে হাত একসময় মাটি দিয়ে দৃষ্টিনন্দন জিনিসপত্র তৈরি করত এখন তা শৌচাগারের পাট তৈরি করে। তাদের পেশা টিকিয়ে রাখার জন্য সহমর্মিতা ছাড়া আপতত কিছু করার সুযোগ নেই।
জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ বিটিসি নিউজকে বলেন, নাটোরের ঐতিহ্যবাহী এ মৃৎশিল্প টিকিয়ে রাখতে সাধ্যমতো কারিগরদের পাশে থাকবে প্রশাসন। তাদের পণ্য উৎপদানে কাঁচামালের সমস্যা থাকলে আবেদনের প্রেক্ষিতে তা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ (নাটোর) প্রতিনিধি মো. নাসিম উদ্দিন নাসিম। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.