রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী টমটম বিলুপ্ত প্রায়, তার স্থান দখল করেছে অটোরিক্সা 

নিজস্ব প্রতিবেদক: সময়ের পরিক্রমায় সব কিছুই বিলীন হয়ে যায়।এভাবে যুগে যুগে সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে।আবির্ভাব ঘটেছে সভ্যতার। এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী টমটমের নগরী রাজশাহী এখন অটো রিক্সার দখলে। নগরীতে এখন হাজার হাজার অটোরিকশা।
রাজশাহীর শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্রই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অটো। সিটি কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী ২০০৮ সাল থেকে রাজশাহীতে অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়। নগরীতে এখন প্রায় ২০ হাজারের অধিক অটো চলাচল করছে। নগরীতে অটোই এখন চলাচলের বাহনে পরিণত হয়েছে। এখন নিত্য-নতুন প্রশস্ত সড়ক হচ্ছে। এরপরও অটোরিকশা ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় লাল-সবুজে ভাগ হয়ে নগরীতে চলছে দুই বেলায় দুই রঙের অটোরিকশা।
একজন সমাজ বিশ্লেষক বলেন, স্বাধীনতা উত্তরকালে এ অঞ্চলের প্রধান বাহন ছিল ঘোড়াগাড়ি (টমটম)। আদি অবস্থা থেকে মানুষ যখন সভ্যতার আলো জ্বালাতে শিখেছিল তখন থেকেই তারা নিজেদের প্রয়োজনে বিভিন্ন জীব-জন্তুর ব্যবহার করতে শিখে। ওইসব জীব-জন্তুর মধ্যে ঘোড়া অন্যতম। আধুনিক যন্ত্রযান আবষ্কিারের আগে ঘোড়া ছিল মানুষরে অন্যতম প্রাচীন বাহন।
সে যুগে ঘোড়ার পিঠে চড়ে মানুষ দেশে-বিদেশে ছুটে বেড়াত। খুব সাহসী বিশ্বস্ত ও প্রভুভক্ত পোষ্যপ্রাণি হিসেবে ঘোড়া রণক্ষেত্রে ব্যবহার হত। রাজা-বাদশারা অশ্বারোহী সৈন্য রাখতেন। ইতিহাসের সেই পথ ধরেই ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী শহরে ঘোড়ায় টানা গাড়ি টমটমের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। টমটম হল এক ঘোড়ায় টানা দুই চাকার গাড়ি বিশেষ। টমটম ওয়ালাদের সে সময় কোচোয়ান বলা হতো।
বৃদ্ধ টমটমচালক আব্দুল খালেক। তার বাড়ি নগরীর কাঁঠালবাড়িয়া। তিনি বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, আমি প্রায় ৬০ বছর থেকে এই টমটম চালাই। এমন এক সময় ছিল যখন রাজশাহীর প্রধান বাহন ছিল টমটম। নগরীর তেঁতুল তলা (রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের পাশে), সোনাদিঘি মোড়ে, সাহেববাজার (বড় মসজিদ) জিরো পয়েন্টে, রেলগেটে, হড়গ্রাম বাজার ঢালুর মোড়ে ছিল টমটম স্ট্যান্ড (ঘোড়ার আড্ডা)।
তিনি বলেন, সে সময় শহরের পথঘাট এতটা উন্নত ছিল না। গ্রাম্য পথগুলোর কথা তো ভাবাই যায় না। বর্ষার সময় পথিককে জুতা-স্যান্ডেল হাতে নিয়ে মালকোচা মারতে হতো। তেমনি গরমের সময় রাস্তাগুলো থাকতো ধূলায় ভরা। তাই তখন টমটম যাত্রাতে ছিল সুবিধা। সে সময় এ সব স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন পবার বায়া ও নওহাটা, গোদাগাড়ী, তানোর, মোহনপুর, পুঠিয়া, চারঘাট টমটম চলাচল করত। মোটরযানের অভাব থাকায় তৎকালীন মহকুমা শহর চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, নওগাঁ ও বগুড়া জেলায় যেত টমটম। বিভিন্ন স্থান থেকে ধান-চাল, শাক-সব্জি,এমনকি ছাগল মোরগ-মুরগি শহরে এনে বিক্রি করতেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। আর নগরীর পঞ্চবটি হতে তালাইমারী পর্যন্ত ছিল টমটমচালকদের বসবাস। এমনকি খড়বোনা এলাকায় গাড়োয়ান পাড়া ছিল।
তিনি বলেন, এখন টমটমের চাহিদা নেই বললেই চলে। ভাড়া পাওয়া যায় না। শখ করে কেউ কেউ টমটমে চড়েন। আরেক টমটম চালক নাজিম সাত্তার বলেন, এখন কোন আচার অনুষ্ঠান ছাড়া কেউই আর ঘোড়ার গাড়ি বা টমটম ভাড়া নেন না। তাই টমটম চালকরা দারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। আবার অনেকে অন্য পেশায় চলে গেছে। তাই কমতে কমতে নগরীতে এখন মাত্র ৪ খানা টমটম কোনভাবে টিকে আছে।
রাজশাহীতে এক সময় ভারতের উত্তর প্রদেশের বালিয়া অঞ্চল থেকে আগত দোসাদ বর্ণের হিন্দুরা টমটম চালাতেন। এখন তাদের আর দেখা যায় না। টমটমই ছিল তাদের উপার্জনের অবলম্বন। তখন টমটমে করে বরযাত্রী যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। বরযাত্রার জন্য লাল, নীল, হলুদ, বাহারি রঙের কাগজ কেটে সাজানো হতো টমটম গাড়ি। ঘোড়াকেও পরানো হতো লাল ফিতা বা লাল কাগজের মালা। ফিরতি পথে বর-কনেকে সামনের দিকে পাশাপাশি বসিয়ে ঘরে আনা হতো। গ্রাম বাংলার নানি-দাদিরা টমটমে চড়ে স্বামীর ভিটায় প্রথম যাত্রার স্মৃতি আজও আওড়ায়। রোদ মাথায় করে যাত্রীরা টমটম চলার দুলুনিতে মেঠোপথে ঘোড়ার খুরের ছোপ ছোপ ছান্দসিক আওয়াজে সুখ-দুঃখের গল্পও পাড়ত।
বতমানে এই যান্ত্রিক যুগে রাজশাহীর সেই ঐতিহ্যবাহী যান প্রায় বিলুপ্তির পথে। লেখক ইবনে গোলাম সামাদ তার রাজশাহীর ইতিবৃত্ত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আমার মনে পড়ে আমি যে স্কুলে পড়তাম তার একজন শিক্ষক রাজশাহীর টমটম নিয়ে একটা গান বেঁধেছিলেন। গানটা গাওয়া হয়েছিল আমাদের স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী উৎসবে। তিনি বলেন, আজও মনে পড়ে গানটার কিছুটা অংশ “রাজশাহীর টমটম রে ভাই রাজশাহীর টমটম। বায়া নওহাটা যাবেন এখুনি রেডি পাবেন, শেয়ারে গেলেই হবে, পয়সা কিছু কম। পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে ,আরামে ঘাড় বেঁকিয়ে চলবে যে গম গম।” প্রফেসর ড. সাইফুউদ্দীন চৌধুরী বলেন, দেশ স্বাধীনের প্রাক্কালে রাজশাহীতে টমটমের সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। তৎকালীন প্রধান যানবাহন হিসেবে গ্রাম থেকে শহরে এবং শহর থেকে গ্রামে যাত্রীসমেত ধান, চাল, গম, ডাল, আলু, পটল, কপি, বেগুন ইত্যাদি মালামাল বহনে টমটম গাড়ি ব্যবহার হত।
টমটম মিস্ত্রি খোকন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই রাজশাহী শহরের অবস্থা বদলাতে থাকে। আশির দশকে প্রথম ভাগে মহকুমাগুলো জেলা ও থানাগুলো উপজলোয় উন্নীত হওয়ায় রাজশাহী শহরের সাথে যোগাযোগের প্রসার ঘটতে শুরু করে। পাকা রাস্তার সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেইসাথে বাড়ে যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা। পৌরসভা সিটি র্কপোরশনে উন্নীত হওয়ার ফলে নব্বই দশকের শুরু থেকেই রাজশাহী মহানগরে লাগে পরিবর্তনের হাওয়া। রাস্তা-ঘাটের প্রসারসহ শুরু হয় বিটুমিন-ইট-পাথরের শক্ত ঢালাই। পাশাপাশি গ্রামের পথগুলোতে ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ ও পাকাকরণের কাজ বেড়ে যায়। কয়েক বছরের মধ্যেই রাজশাহী মহানগর ও পার্শ্ববর্তী থানাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। এর ফলে পথে পথে টমটমের কাঠের চাকার বদলে নামে রাবারের চাকার ঢল।
খোকনের মতে, বাস, মিনিবাস, ট্রাক, টেম্পু, মোটরসাইকেল, রিকশা ক্রমশ রোধ করতে থাকে ঐতিহ্যবাহী টমটমের গতি। তিনি বলেন, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বর্তমানে গুটি কয়েক টমটম রাজশাহীর প্রাচীন ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছে। নগরীর অধিকাংশ স্ট্যান্ড উঠে গেলেও পিএন গার্লস স্কুলের পাশে, কোর্ট ঢালুর মোড় ও কাঁটাখালীতে পাকা রাস্তার ধারে বসেন কয়েকজন কোচোয়ান। তারা টমটমের ঘোড়ার লাগাম ধরে বসে ভাড়ার আশায় প্রহর গুণে। তাদের বর্তমান হাল মর্মস্পর্শীও। প্রতিদিনের গড় আয় প্রায় ১২৫ টাকা যা দিয়ে তারা অবলা ঘোড়ার খোরাক যোগাড় করাই মুশকিল হয়ে ওঠে। নিজেদের সংসারও ঠিকমত চলে না। কোনরকম বেঁচে থাকা। ঘোড়ার জন্য ভূষি, বুট, লালিগুড়ের জন্য যেখানে প্রতিদিন কম করে এক শ টাকার প্রয়োজন সেখানে পঞ্চাশ-ষাট টাকাতে চালাতে হয়।
এ সম্পর্কে নগরীর তেরখাদিয়ার জয়নাল আবেদীন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, টমটমই ছিল শহর থেকে গ্রামের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম। তিনি বলেন, আমার নানা কাজিমুদ্দিন টমটম চালাতেন। তার বাড়ি ছিল নগরীর দরগাপাড়ায়।তখন টমটমের আয় দিয়েই অনেকের সংসার চলতো। কচোয়ান সমসেদ আলী টমটম চালিয়েই অনেক জমির মালিকও হয়েছিলেন। রাজশাহীতে তখন জনসংখ্যা ছিল অনেক কম। চলাচলের মাধ্যমও ছিল অতি সরল ও সীমিত। এখন নগরীতে দু-একটি টমটম দেখা গেলেও সেটি শুধু অতীতের স্মৃতি বহন করে টিকে আছে।
টমটমের যুগের সাথে এক পর্যায়ে চলাচল শুরু হয় প্যাডেল-রিকশা। প্রায় কয়েক যুগ ধরে টমটমের সাথে সহ অবস্থানে থেকে চলাচল করেছে প্যাডল রিকশা। এক পর্যায়ে রিকশাই হয়ে ওঠে প্রধান বাহন। নগরীতে প্রায় ৪০ হাজার রিকশা চলাচল করতো। পরে এসবের অবসান ঘটিয়ে রাস্তায় নামে টেম্পু। কালের আবর্তে স্বল্প খরচ আর মানুষের প্রয়োজন মিটাতে রাজশাহীর প্রধান বাহন হয়ে উঠেছে অটোরিকশা। এর সাথে যুক্ত হয় চার্জার রিকশা।
অতীতের টমটম একেবারে শেষ হলেও একমাত্র বিনোদনের খোরাক হিসেবে টিকে আছে টমটম। অটো নামের ছোট যানটি নগরবাসীকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে যে একে ছাড়া যেন মানুষের নিস্তার নেই। নগরীতে এখন প্রায় ২০ হাজারের অধিক অটো চলাচল করছে। আগের সরল সহজ চলাচলকে করে ফেলেছে কঠিন আর কঠোর। এতে যেন কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। যানজট এখন নিত্যদিনের ঘটনা। যেন দম ফেলার ফুসরৎ নেই। অটোর পিছনে অটো, মানুষের আগে পিছে অটো। সকাল বিকাল ভাগ করেও মানুষ রক্ষা পাচ্ছে না অটোজটের হাত থেকে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মোঃ মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.