রাজশাহীতে অনুমোদনহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, দেখার কেউ নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক:  রাজশাহীকে বলা হয় শিক্ষা নগরী। অথচ অনুমোদন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাজশাহী জেলার বিভিন্ন আবাসিক ভবন ও বাজার এলকাসহ যত্রতত্র বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে উঠছে নাম সর্বস্ব স্কুল-কলেজ।

এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শিক্ষকসহ শিক্ষার মান ও পরিবেশ নিয়ে আছে বিস্তর অভিযোগ। অথচ অনুমোদনহীন এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করছে খোদ অনুমোদিত স্কুল-কলেজ।

এদিকে রাজশাহীতে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তদারকিতে চারটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকলেও প্রকাশ্য এই অনিয়মের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন কর্তৃপক্ষকেই ব্যবস্থা নিতে দখা যায়নি।

অনুমোদনহীন এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি করিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা প্রতারিত হচ্ছেন। অভিভাবকরেদ দাবি, দ্রুত সময়ের মধ্যে মানহীন ও অনুমোদনহীন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা না গেলেও তাদের অন্তত সরকারি নিয়মনীতির অধিনে এনে নিয়মিত তদারকি করা হোক।

রাজশাহী জেলা শিক্ষা অফিস, জেলা প্রথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এবং রাজশাহী অঞ্চলের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষ অধিদপ্তর এই চারটি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকির পাশাপাশি শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের মান উন্নয়নে কাজ করছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের দেয়া হিসেবে, রাজশাহী জেলায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের অনুমোদিত স্কুলের সংখ্যা ১হাজার ৫৫৮টি। যার মধ্যে প্রথমিক পর্যায়ের অনুমোদন প্রাপ্ত স্কুলের সংখ্য ১হাজার ৫৭টি এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন প্রাপ্ত মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলের সংখ্যা ৫০১টি। তবে অনুমোদনহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন হিসাব নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে।

এদিকে রাজশাহী নগরীসহ ৯টি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে বিভিন্ন আবাসিক ও বাজার এলাকার ছোটবড় ভবনগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে দুই হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বছরের শুরুতে ভর্তি মৌসুম হওয়ায় বিভিন্ন মোড় ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ব্যানার ও সাইবোর্ডের মাধ্যমে প্রকাশ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের চটকদার বিজ্ঞাপন শোভা পাচ্ছে।

আকর্ষণীয় সুযোগ পাবার লোভে অভিভাবকদের অনেকেই না বুঝে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদের ভর্তি করছেন। স্কুলগুলো তাদের শিক্ষার্থীদের ভালো ফলের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন।

রাজশাহী অঞ্চলের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন প্রাপ্তির ক্ষেতে সরকারের দেয়া বেশ কিছু নিয়ম আছে। তার মধ্যে আছে নিজস্ব ভূমি থাকা যেখানে ক্লাসরুমের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠ থাকবে।

একটি স্কুল থেকে অন্যটির দূরত্ব হবে শহর ও উপজেলা ভেদে এক থেকে দুই কিলো মিটারের মধ্যে। শিক্ষকদেরও থাকতে হবে নুন্যতম যোগ্যতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ। শিক্ষা কারিকুলাম হতে হবে অনুমোদিত। তবে অনুমোদনহীন স্কুলগুলো এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। এদিকে রাজশাহী শিক্ষা অধিদপ্তরসহ জেলা শিক্ষ অফিস, শিক্ষা বোর্ড ও প্রথমিক শিক্ষা অফিসের পক্ষ থেকে স্থানীয় স্কুলগুলোর জন্য পরিদর্শন নিয়োগ দেয়া থাকলেও তাদের অনুমোদনহীন এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন বা তদারকিতে কোন ভূমিকা দেখা যায় না।

অনুমোদনহীন এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও সচেতন সমাজের অধিকাংশের দাবি, শুরুতে চটকদার কথা ও প্রলোভন দেখিয়ে সন্তানদের এসব স্কুলে ভর্তির জন্য অনুনয় বিনয় করা হয়। পরবর্তিতে যখন স্কুলে ভর্তি করা হয় তখন দেখা যায় স্কুলগুলোতে শিক্ষার মান আশানুরূপ নয়। শিক্ষকেরাও দক্ষ নয়। আবার সার্বিক পরিবেশ বিবেচনায় দেখা যায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মনোবিকাশ বা শ্বারীরিক বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ নেই।

অভিভবকেরা আরো বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, অনুমোদন না থাকায় স্কুলগুলোকে তাদের শিক্ষার্থীদের পিইসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইএসসি’র মতো পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে অনুমোদিত স্কুলোর স্বরণাপন্য হতে হয়। অনুমোদিত স্কুল বা কলেজগুলো এসকল অনুমোদনহীন স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের নিজেদের শিক্ষার্থী হিসেবে রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন দেখিয়ে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়।

অথচ অনুমোদনহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত নিবন্ধন ফি এর চাইতে কয়েকগুণ বেশি অর্থ আদায় করে থাকে। রাজশাহীর বেসরকারি বা এমপিও ভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এসব অনুমোদনহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দিচ্ছে।

রাজশাহী শহরের এমপিও ভুক্ত মাধ্যমিক পর্যায়ের একাধিক স্কুলের প্রশাসনেন সাথে কথা বলে অভিভাবকদের এমন অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলোর কর্তৃপক্ষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাননা, মানবিক দিক বিবেচনায় অনুমোদনের বাইরে থাকা স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। এতে তাদের কোন আর্থিক লাভের বিষয় জড়িত নেই। সরকারের শিক্ষা বিস্তারের যে নীতি রয়েছে সেই দিক বিবেচনায় এই শিক্ষার্থীদের সহযোগীতা করা হচ্ছে। তবে অনুমোদনহীন এসব স্কুলে বিদ্যমান শিক্ষার মানের বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি তারা।

রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোহা: মোকবুল হোসেন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, গুণগণ শিক্ষা কার্যক্রমের বিস্তারে বর্তমান সরকার বদ্ধ পরিকর। অনুমতি ছাড়া কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্পূর্ণ বেআইনি।

আমরাসহ আরো কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় স্কুল ও কলেজ মনিটরিংএ কাজ করে। তবে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা গেলে অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হতো। এক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ক্ষমতা বন্টনের বিষয়টিও জরিত।

এদিকে রাজশাহী অঞ্চলের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ড. শারমিন ফেরদৌস চৌধুরী বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, অনুমতি ছাড়া মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষ কার্যক্রম চালানো সম্পূর্ণ বেআইনি বিষয়। প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের জন্য আমাদেরকে মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শনের জন্য বলা হয়। আমরা পরিদর্শন করি।

শিক্ষপ্রতিষ্ঠানগুলো নুন্যতম শর্ত পুরণ করতে না পারায় আমরা তদের বিরুদ্ধে নিগেটিভ রিপোর্ট দেই। অনুমোদনহীন স্কুল বা কলেজে না ভর্তি হবারও পরামর্শ দেন এই শিক্ষা কর্মকর্তা।

প্রসঙ্গত, রাজশাহী জেলা প্রথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, প্রাথমিক পর্যায়ের ১হাজার ৫৭টি স্কুলের মধ্যে রয়েছে গোদাগাড়ী উপজেলায় ১৬৫টি, চারঘাট উপজেলায় ৭৩টি, দুর্গপুর উপজেলায় ৮৩টি, তানোরে ১২৮টি, বাগমারায় ২২০টি, বাঘায় ৭৪টি, পুঠিয়ায় ৯০টি, পবায় ৮৩টি, মোহনপুরে ৮১টি এবং সিটিকর্পোরেশন এলাকায় ৬০টি।

আর রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন প্রাপ্ত মাধ্যমিক পর্যায়ের ৫০১টি স্কুলের মধ্যে রয়েছে রাজশাহী নগরীতে ৬৫টি (বোয়ালিয়া থানা এলাকায় ৩০টি, রাজপাড়া থানায় ১৬টি, মতিহার থানায় ১৩টি, শাহমখদুম থানা এলাকায় ৬টি), পবা উপজেলায় ৩৭টি, বাগমারা উপজেলায় ৭৫টি, গোদাগাড়ী উপজেলায় ৬২টি, তানোর উপজেলায় ৫২টি, বাঘা উপজেলায় ৪৪টি, মোহনপুর উপজেলায় ৩৫টি, দুর্গাপুর উপজেলায় ৩৪টি, পুঠিয়া উপজেলায় ৪২টি ও চারঘাট উপজেলায় ৫৫টি।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মোঃ মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.