মিঠাপুকুরে আওয়ামীলীগ নেতা কর্তৃক বিধবা ভাতার টাকা আত্মসাত নিয়ে তোলপাড়


রংপুর ব্যুরো: রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ ইউনিয়নে এক অসহায় বিধবাকে সরকার প্রদত্ব ২৫ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে ২০ হাজার টাকা আত্মসাত করেছেন এক আওয়ামীলীগ নেতা। এ ঘটনায় ইউএনওকে ভূক্তভোগি বিধবা অভিযোগ দেয়ার পর তোলপাড় সৃষ্টি হলে ঘটনা সামাল দিতে মঙ্গলবার সন্ধায় সালিশী বৈঠকে লিখিত করে ১৩ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছে ওই আওয়ামীলীগ নেতা। বাকী টাকা আগামী ২ জুলাইয়ের মধ্যে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।

মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে দেয়া ভুক্তভোগি উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের শালাইপুর গ্রামের মৃত ছালেহা মৃত আমির উদ্দিনের স্ত্রী ছালেহা বেওয়ার লিখিত আবেদন সূত্রে জানা গেছে, ছালেহা বেওয়াকে কয়েক মাস আগে বিধবা ভাতা দেয়ার নাম করে ২ হাজার টাকা নেন ওই ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক একই এলাকার আব্দুল লতিবের পুত্র মুকুল মিয়া। গত ৩ জুন মুকুল মিয়া বিধবা ছালেহা বেওয়াকে বিধবা ভাতার বইসহ টাকা দেয়ার কথা বলে বৈরাগীগঞ্জে অবস্থিত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পায়রাবন্দ শাখায় নিয়ে যান। সেখানে টিপসই নেয়ার পর মুকুল মিয়া ছালেহা বেওয়াকে ৫ হাজার টাকা এবং বিধবা ভাতার বই দিয়ে বাড়িতে যেতে বলে। পরে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ছালেহা বেওয়া জানতে পারেন তার নামে ২৫ হাজার ৫০০ টাকা ব্যাংক থেকে তোলা হয়েছে। বিষয়টি ছালেহা বেওয়া আওয়ামীলীগ নেতা মুকুল মিয়াকে জানিয়ে বাকী ২০ হাজার ৫০০ টাকা দাবি করলে মুকুল মিয়া বৃদ্ধা ছালেহা বেওয়াকে বাকী টাকা দিতে অস্বীকার করে এবং বেশি বাড়াবাড়ি করলে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি করার হুমকি দিতে থাকে। এক পর্যায়ে ঈদের আগে গত ১৪ জুন বিষয়টি জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে তার নামে উত্তোলিত ২০ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধারের দাবি জানিয়ে লিখিত আবেদন করে। ইউএনও লিখিত অভিযোগ গ্রহন করে বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেন উপজেলা সমাজ সেবা অফিসারকে। এরই মধ্যে বিষয়টি সামাজাকি যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।

স্থানীয়রা জানান, ঘটনাটি প্রকাশ হয়ে পড়লে আওয়ামীলীগ নেতা মুকুল মিয়া একই গ্রামের বাসিন্দা কলেজ শিক্ষক আব্দুল বাতেনের মাধ্যমে বিষয়টি সমঝোতার জন্য চেষ্টা করে। এরই অংশ হিসেবে মুকুল মিয়া কৌশলে ছালেহা বেওয়ার জামাই জোবেদ আলী সমঝোতার জন্য রাজি করান। এক পর্যায়ে মঙ্গলবার আসরের নামাজের পর শালাইপুর ডোবারপাড়া মোড়ে এই বিষয়ে শত শত মানুষের উপস্থিততে সালিশ বৈঠক হয়। সালিশ বৈঠকে সাদা কাগজে লেখালেখির মাধ্যমে মুকুল মিয়া তাত্ক্ষনিক বিধবা ছালেহা বেওয়াকে ১৩ হাজার টাকা প্রদান করেন এবং বাকী ৭ হাজার ৫০০ টাকা আগামী ২ জুলাই দেয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। এসময় তিনি ছালেহা বেওয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেন, এ ধরনের কোন কাজ আর করবেন না।

ছালেহা বেওয়ার জামাই জোবেদ আলী জানান, লিখিত অভিযোগ করার পর আমাকে ওরা খুব চাপ দিচ্ছিল মিমাংসার জন্য। ওরা সরকারীনেতা, আমরা গরীব মানুষ। ওদের চাপের মুখে সালিশে বসতে রাজি হই। মুকুল মিয়া সেখানে ১৩ হাজার টাকা দিয়েছেন বাকী টাকা এলাকার কলেজ শিক্ষক আব্দুল বাতেন দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি বলেন, সালিশে যে কাগজে লেখালেখি হয়েছিল সেটি সালিশের পরে মুকুল মিয়া সমাজসেবা অফিসারকে দেয়ার কথা বলে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমার বিধবা শাশুড়ীর হকের টাকা এভাবে মেরে দেয়ায় আমরা খুব দু:খ পেয়েছিলাম।

সালিশী বৈঠকে উপস্থিত স্থানীয় জাতীয় পার্টির নেতা ফখরুল ইসলাম জানান, সালিশী বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে ১৩ হাজার ফেরত পাওয়া গেছে। বাকি টাকা ২ জুলাইয়ের মধ্যে সালিশের আয়োজক আব্দুল বাতেন নিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি জানান, আত্মসাতকারীরা আওয়ামীলীগ নেতা হওয়ায় জোড় করে বাধ্য করা হয়েছে সালিশের মাধ্যমে টাকা ফেরত নিতে।

এ ব্যপারে সালিশী বৈঠকের আয়োজক শুকুরেরহাট ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক আব্দুল বাতেন জানান, বিধবা ভাতার টাকা আত্মসাত করার বিষয়টি খবুই অন্যায়। বিষয়টি নিয়ে লিখিত আবেদন হওয়ার পর মুকুল মিয়া ভুল বুঝতে পেরে আমাকে এসে ধরেন। আমি মঙ্গলবার সন্ধায় এলাকাবাসির সাথে আলেচনা করে সালিশী বৈঠকের মাধ্যমে লেখালেখি করে বিষয়টি মিমাংসা করে দিয়েছি। মোট আত্মসাত করা টাকার ১৩ হাজার টাকা বৈঠকে দেয়া হয়েছে। বাকী ৭ হাজার ৫০০ টাকার জন্য আমি জিম্মাদার হয়েছি। ২ জুলাইয়ের মধ্যে তা দিয়ে দেয়া হবে।

এ ব্যপারে আওয়ামীলীগ নেতা মুকুল মিয়া জানান, আমি ছালেহা বেওয়াকে বিধবা ভাতার ৫ হাজার টাকা দিয়ে বাকী টাকা নিজের কাছে রেখেছিলাম। পরে ভুল বুঝতে পেরে সালিশী বৈঠকে শত শত মানুষের উপস্থিতিতে লেখালেখি করে তাকে ১৩ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছে মুকুল দিয়েছি। বাকি টাকা ২ জুলাইয়ের মাধ্যমে আব্দুল বাতেনের মাধ্যমে ফেরত দিবো।

পায়রাবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফয়জার রহমান খান জানান, এক বিধবা মারা যাওয়ায় আমি সেখানে ওই মহিলার জন্য বিধবা ভাতা বরাদ্দ করে দিয়ে বই দিয়ে দেই। ব্যাংক থেকে ওই বিধবার বই দেখে ২৫ হাজার ৫০০ টাকাই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মকুল মিয়া যে বিধবাকে ৫ হাজার টাকা দিয়েছিল সেটি আমার জানা ছিল না। যাই হোক মুকুল দলীয় লোক। বিষয়টি ইউএনও অফিসে অভিযোগ হওয়ার পর গত পরশু দিন আমি জানতে পাওয়ার সাথে সাথেই মুকুলকে সমুদয় টাকা ফেরত দেয়ার জন্য নির্দেশ দেই। মঙ্গলবার তারা সালিশের মাধ্যমে টাকা ফেরত দিয়ে আমাকে লিখিত কপি দিয়েছে।

উপজেলা সমাজসেবা অফিসার জয়নাল আবেদীন জানান, লিখিত আবেদনটি আমি তদন্তের জন্য ঈদের আগের শেষ অফিস দিনে আদিষ্ট হই। কিন্তু সেদিন তদন্ত করতে পারিনি। ঈদের বন্ধের পর মঙ্গলবার তদন্তের জন্য নির্দেশ দেই। স্থানীয় চেয়ারম্যান আমার কাছে ৪ টা পর্যন্ত সময় নেয়। পরে বিকেলে আমার কাছে একটি সমঝোতাপত্র দেয়া হয়। বিষয়টি আমি ইউএনও স্যারকে অবহিত করেছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুন অর রশিদ জানান, লিখিত আবেদন পাওয়ার পর বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য আমি সমাজসেবা অফিসারকে দায়িত্ব দিয়েছি। পরে শুনেছিল স্থাণীয়ভাবে টাকা উদ্ধার করে দেয়া হয়েছে।

এদিকে এলাকাবাসির অভিযোগ, মুকুল মিয়া তার সম্পর্কের মামী দোলাপাড়ার মৃত আবুল কাসেমের বিধবা স্ত্রী রোকেয়া বেগমকেও একই কায়দায় ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বাকী টাকা আত্মসাত করেছেন। এছাড়াও ওই ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মিলন রায়ও একজন হিন্দু বিধবাকে একই কায়দায় ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বাকী টাকা আত্মসাত করেছেন। এ বিষয়ে তদন্ত করা ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি এলাকাবাসির। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.