বিশ্বকে বিপজ্জনক করে তুলছে ‘ভূ-রাজনীতি’

(বিশ্বকে বিপজ্জনক করে তুলছে ‘ভূ-রাজনীতি’–ছবি: সংগৃহীত)
বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নেওয়ার পর বিশ্বে শান্তি ফিরে আসবে এমন আশা এখনই ছেড়ে দেওয়া উচিত। এরই মধ্যে নতুন হুমকি বিপজ্জনক উপায়ে ফিরে এসেছে। সেটি হচ্ছে বিশ্ব নিরাপত্তার নামে ‘ভূ-রাজনৈতিক’ নীতির প্রত্যাবর্তন।
গত ছয় মাসে বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একটু খেয়াল করুন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের পরেই আলাস্কায় দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন অপর পক্ষে ছিলেন তারই সমকক্ষ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। বৈঠকে জো বাইডেনের প্রশাসন ও চীনের মধ্যে প্রথম উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে দেশ দুটির কর্মকর্তারা তুমুল বাগযুদ্ধে জড়িয়েছেন।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সঙ্গে নিয়ে জার্মানির ওপর প্রবল চাপ অব্যাহত রেখেছে নর্ড স্ট্রিম টু পাইপলাইন (এ ইউক্রেনকে বাদ দিয়েই রাশিয়া সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস রপ্তানির প্রকল্প) বন্ধের জন্যে।
অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের জিনজিয়াংয়ে সংখ্যালঘু উইঘুর প্রতি দমন-পীড়ন হচ্ছে বলে চীনের প্রতি কঠোর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়। যার উত্তরে চরম প্রতিক্রিয়া জানায় চীন।
এদিকে ১৮৫০ সালে ক্রিমিয়া যুদ্ধের পর এই প্রথমবারের মতো কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়া এবং ব্রিটেনের চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। প্রায় যুদ্ধ লেগে যাওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে যায় দুই দেশ।
এ ছাড়া পুতিন এবং বাইডেনের মধ্যে প্রথম বৈঠক যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার উত্তেজনা কমাতে খুব একটা কার্যকর হয়নি। ঠিক একই ভাবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বাইডেনের প্রথম বৈঠকের সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এতক্ষণ বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া যে চিত্রগুলো দেওয়া হলো তার ভূমিকাগুলো বর্ণনা করতে “ভূ-রাজনীতি” শব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এর অর্থই হচ্ছে পুরনো ইস্যুর নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করা।
উদাহরণস্বরূপ, বলা যেতে পারে রাশিয়া তার পুরনো সোভিয়েত ঐতিহ্য বজায় রেখেই ইউরোপে জ্বালানি রপ্তানি করতে চাইছে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে। এই বিষয়টিকেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন ‘ইউরোপকে বিভক্ত করার জন্য রাশিয়ান ভূ-রাজনৈতিক প্রকল্প’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।
ভূ-রাজনীতি এমন এক ধ্রুপদী বিষয় যার ভালো এবং খারাপ দুই অর্থেই ব্যবহার রয়েছে। অনেকে কাছেই বিষটি এটি ভৌগোলিক কন্টিনজেন্সি সম্পর্কে একটি অস্পষ্ট ধারণা তৈরি করে।
অনেকের কাছে এটি ভৌগোলিক নিয়ন্ত্রণ নির্ধারণের সমান, আবার অনেকে কাছে এটি অন্তহীন সংঘাতকে উসকে দেয়। যেখানে রাষ্ট্রের সীমানা ‘মানচিত্র’ অন্তহীন সংঘাত তৈরি করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যর্থতার পর কাইজার উইলহেলমের ‘বিশ্ব রাজনীতি’ নামক উচ্চাভিলাষী তত্ত্বের ব্যর্থতার পর নতুন এক তত্ত্বের প্রয়োজন হয়। ঠিক এমন সময়ে মিউনিখ মিলিটারি একাডেমির অফিসার এবং কৌশলগত তাত্ত্বিক কার্ল হাশোফার এই ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব প্রচার চালান। ১৯০০ সালে সুইডিশ রাজনীতিবিদ জোহান রুডল্ফ কেজেলান ভূ-রাজনৈতিক শব্দ প্রচলন করেন। হাশোফার এই শব্দ লুফে নেন।
হাশোফারই প্রথম ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্বের মাধ্যমে সংঘাতকে উসকে দেন। সে সময় তার ভূ-রাজনীতি তত্ত্ব বলতে বোঝাত নিজের শক্তি সামর্থ দিয়ে অন্যের ভূমি বা দেশ দখল করা। জনগণের জীবনধারণ, সম্পদ আহরণ এবং শক্তি অর্জনের জন্য ভূমির নিশ্চয়তা বিধান করা ছিল সেকালের ভূ-রাজনীতির মৌলিক উদ্দেশ্য।
তৎকালে রাষ্ট্রকে একটি জৈবিক সত্তা বলে অভিহিত করা হয়। যার অবশ্যই ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি প্রয়োজন, না হয় পতন অনিবার্য বলে মনে করা হতো। হাসোফার মনে করতেন তিনি নতুন এক রাজনীতি বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্র একটি জৈবিক সত্তা পরিণত হবে।
১৯২০ এর শুরুতে হাশোফারের এই তত্ত্ব আন্তর্জাতিক মণ্ডলে প্রশংসা পেয়েছিল। এমনি অ্যাডলফ হিটলার তার চিন্তাভাবনার দ্বারা খুব ভালোভাবে প্রভাবিত হন, যা তিনি তার আত্মজীবনী ম্যানক্যাম্পে উল্লেখ করেছেন।
এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবমাননাকর পতনের পর রাশিয়ার রাষ্ট্র চিন্তায় ফিরে আসে ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব। নাজিবাদ গবেষক আলেকসান্দার দুগিন জানান, পুতিনের বিশ্ব-রাজনীতিতে চিন্তাভাবনায় ব্যাপকভাবে ভূমিকা রেখেছে ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব।
তবে মহামারিকালীন করনা পরস্থিতিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রাচীন আগ্রাসী ‘ভূ-রাজনৈতিক’ পদক্ষেপে আবারও বিশ্বের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নষ্ট করে দিচ্ছে। তবে অবস্থার দৃষ্টিতে এটাই মনে হচ্ছে বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রের এই আগ্রাসী মনোভাব করোনা মহামারীতে বিশ্ব যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে অনেক বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বে সর্বজনীন টিকা না দেওয়া সম্ভব হবে তা কাটবে বলে মনে হয় না। আমাদের বুঝতে হবে ‘ভূ-রাজনৈতিক’ তত্ত্বের প্রাচীন আগ্রাসী মনোভাব থেকে কিছুই অর্জন করা সম্ভব হবে না। এই তত্ত্বের মাঝেই লুকিয়ে আছে বিশ্বের ক্ষমতাধরদের চরম সংঘাত এবং সেই সঙ্গে ক্ষমতাধরদের মিথ্যাবাদী হিসেবে গড়ে ওঠার প্রবণতা।
এই ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব দিয়ে না-কোনো আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান হবে, না-কোনো সাধারণ সমস্যার সমাধান হবে। সমস্যা যে কোনো ধরনের হোক না কেন আন্তর্জাতিক অথবা সাধারণ তার সমাধানের এক মাত্র উপায় হলো সমস্যা সমাধানে আসলে কী প্রয়োজন তার দিকে মনোনিবেশ করা। #

 

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.