নন্দাদেবী শৃঙ্গে বরফের নিচে লুকানো আছে পারমাণবিক বোমা!

(নন্দাদেবী শৃঙ্গে বরফের নিচে লুকানো আছে পারমাণবিক বোমা!)
বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতের হিমালয়-সংলগ্ন উত্তরাখণ্ড রাজ্যে দু’সপ্তাহ আগে হিমবাহ ভেঙে যে বরফ, পানি আর পাথরের ঢল নেমেছিলো, তার কারণ কী? এ কথা যদি আড়াইশ’ পরিবারের ছোট্ট গ্রাম রাইনির লোকদের জিজ্ঞেস করেন, তাহলে এক অদ্ভূত জবাব শুনতে পাবেন আপনি।
গত ৭ই ফেব্রুয়ারী হিমবাহ ধসের ঘটনায় ৫০ জনেরও বেশী লোক নিহত হন। তবে এর কারণ সম্পর্কে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সেই বিচিত্র ধারণা প্রচলিত আছে কয়েক প্রজন্ম ধরেই। তারা মনে করেন, সেখানে বরফের নিচে লুকিয়ে রাখা আছে কিছু পারমাণবিক অস্ত্র এবং সেই বোমাগুলোর কোনো একটি বিস্ফোরিত হয়েই ওই ধসের ঘটনা ঘটেছিলো।
বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, চামোলি জেলায় হিমালয়ের নন্দাদেবী শৃঙ্গের কাছে হিমবাহের একটি অংশ হঠাৎ ভেঙে পড়েছিলো এবং তার ফলে অলকানন্দা ও ধৌলিগঙ্গা নদীতে আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি হয় যা অনেক বাড়িঘর ও স্থাপনা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু রাইনির লোকজনকে যদি আপনি এ গল্প বলতে যান – তাহলে দেখবেন অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করছে না।
‘আমাদের মনে হয় লুকানো বোমাগুলোর একটা ভূমিকা আছে। শীতকালে একটা হিমবাহ কিভাবে ভেঙে পড়তে পারে? আমরা মনে করি সরকারের উচিত ব্যাপারটার তদন্ত করা এবং বোমাগুলো খুঁজে বের করা,’ বলছিলেন সংগ্রাম সিং রাওয়াত, রাইনির গ্রাম প্রধান।
তাদের এই ধারণার পেছনে আছে স্নায়ুযুদ্ধের যুগের এক বিচিত্র কাহিনি।
চিনের বিরুদ্ধে নজরদারি করতে ভারত-মার্কিন গোপন তৎপরতা: উনিশশ’ ষাটের দশকে এই এলাকাটিতে কিছু বিচিত্র গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা ঘটেছিলো। এতে জড়িত ছিলো তৎকালীণ কিছু শীর্ষ পর্বতারোহী, ইলেকট্রনিক স্পাইং সিস্টেম চালানোর জন্য তেজষ্ক্রিয় পদার্থ এবং কিছু গুপ্তচর। সে সময় চিন পারমাণবিক বোমা এবং ক্ষেপণাস্ত্রের মালিক হবার জন্য নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলো। আর তার ওপর নজর রাখতে ১৯৬০’র দশকে ভারতের সাথে সহযোগিতা করেছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
তারা চিনের পারমাণবিক পরীক্ষা এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের ওপর নজরদারি করতে হিমালয় এলাকায় পরমাণু শক্তিচালিত কিছু যন্ত্র স্থাপনের কাজে ভারতের সাহায্য নিয়েছিলো।
এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লেখালিখি করেছেন পিট তাকেডা – যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘রক এ্যান্ড আইস ম্যাগাজিনের’ একজন প্রদায়ক-সম্পাদক।
‘স্নায়ুযুদ্ধের যুগের সন্দেহবাতিক তখন চরমে উঠেছে। কোনো পরিকল্পনাকেই তখন পাগলামি বলে উড়িয়ে দেয়া হতো না, যতো অর্থই লাগুক তা পেতে অসুবিধা হতো না এবং এ জন্য কোনো পন্থা নিতে কেউ দ্বিধা করতো না, বলছিলেন তিনি।
সাতটি প্লুটোনিয়ম ক্যাপসুল: চিন তার প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায় ১৯৬৪ সালে। তার বছরখানেক পরের কথা। উনিশশ’ পঁয়ষট্টি সালের অক্টোবর মাসে একদল ভারতীয় ও আমেরিকান পর্বতারোহী সাতটি প্লুটোনিয়াম ক্যাপসুল এবং নজরদারির যন্ত্রপাতি নিয়ে নন্দাদেবী শৃঙ্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।
প্লুটোনিয়াম ক্যাপসুলগুলোর ওজন ছিলো প্রায় ৫৭ কেজি। এর সাথে ছিলো দু’টি রেডিও কমিউনিকেশন সেট, আর একটি ছয় ফুট লম্বা এ্যান্টেনা।
কথা ছিলো যে – পর্বতারোহীরা সেগুলো নিয়ে ২৫,৬৪৩ ফিট উঁচু নন্দাদেবী শৃঙ্গের ওপর স্থাপন করবেন। এই শৃঙ্গের অবস্থান চিন সীমান্তের কাছেই। কিন্তু দলটির যখন শৃঙ্গের কাছাকাছি এসে গেছেন – তখনই বাধলো বিপত্তি। হঠাৎ শুরু হলো প্রচণ্ড তুষার ঝড়।
পর্বতারোহী দলটি তাদের যাত্রা বন্ধ করতে বাধ্য হলো। যন্ত্রপাতিগুলো একটা মাচার মতো প্ল্যাটফর্মের ওপর রেখে তারা তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে এলেন।
একটি সাময়িকীর রিপোর্ট অনুযায়ী, তারা এগুলো রেখে এসেছিলেন পর্বতের গায়ে একটা খাঁজের মধ্যে।
‘আমরা নেমে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম – না হলে অনেকেই মারা পড়তো,’ বলেন ভারতীয় পর্বতারোহীদের নেতা এবং সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কর্মী মনমোহন সিং কোহলি।
ডিভাইসগুলো উধাও হয়ে গেলো: পরের বছর বসন্তকালে পর্বতারোহীরা আবার ফিরে এলেন। তারা ভেবেছিলেন, যন্ত্রপাতিগুলো খুঁজে বের করে তা শৃঙ্গে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তারা সেখানে পৌঁছে দেখলেন, যন্ত্রপাতিগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে।
এরপর ৫০ বছরেরও বেশি পার হয়ে গেছে। নন্দাদেবী শৃঙ্গে একাধিক দল আরোহণ করেছেন। কিন্তু ক্যাপসুলগুলোর কি হলো -তা আজও কেউ জানেন না।
তাকেডা বলছেন, হয়তো সেই হারানো প্লুটোনিয়াম কোনো হিমবাহের নিচে চাপা পড়ে আছে, হয়তো ভেঙেচুরে ধুলোয় মিশে গেছে , এবং ভাসতে ভাসতে তা গঙ্গার উৎসমুখের দিকে যাচ্ছে।
অবশ্য বিজ্ঞানীরা বলেন, এটা অতিরঞ্জিতও হতে পারে। এটা ঠিক যে প্লুটোনিয়াম হচ্ছে পারমাণবিক বোমার একটা প্রধান উপাদান। কিন্তু ব্যাটারিতে আসলে প্লুটোনিয়াম-২৩৮ নামে একটা আইসোটোপ বা বিশেষ ধরনের প্লুটোনিয়াম ব্যবহৃত হয়। এর ‘হাফ লাইফ’ (যতোদিন একটা আইসোটোপ তার তেজষ্ক্রিয়তা অর্ধেক হারিয়ে ফেলে) হচ্ছে ৮৮ বছর।
এই অভিযান নিয়ে নানা রকম গল্প: নন্দাদেবী নিয়ে একটি বই লিখেছেন ব্রিটিশ লেখক হিউ টমসন। তিনি লিখেছেন, স্থানীয় লোকেরা যাতে সন্দেহ না করে সে জন্য আমেরিকান পর্বতারোহীদের চামড়ার রঙ তামাটে করার ক্রিম লাগাতে বলা হয়েছিলো।
তাদের অভিযানের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিলো – অতো উঁচুতে উঠলে অক্সিজেনের অভাবে মানবদেহে কি প্রতিক্রিয়া হয় তা পরীক্ষা করতেই এ অভিযান। সাথে যে মালবাহী কুলিরা পারমাণবিক যন্ত্রপাতি বহন করছিলেন তাদের বলা হয়েছিলো- এতে সোনা বা ওই জাতীয় কোনো ধনরত্ন আছে।
১৯৭৮ সালের আগে এ অভিযানের কথা কেউ জানতো না: ভারতে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এই ব্যর্থ অভিযানের কথা গোপন রাখা হয়েছিলো। সে সময় ওয়াশিংটন পোস্ট এক রিপোর্টে জানায়, সিআইএ কিছু অভিজ্ঞ আমেরিকান পর্বতারোহী ভাড়া করে হিমালয়ের দু’টি শৃঙ্গে পারমাণবিক শক্তিচালিত নজরদারির যন্ত্র বসিয়েছিলো – যার লক্ষ্য ছিলো চিনের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করা।
ওয়াশিংটন পোস্টের সেই রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৬৫ সালে প্রথম অভিযানটি ব্যর্থ হয় এবং যন্ত্রপাতি হারিয়ে যায়। তবে দু’বছর পর আরেকটি অভিযানে সিআইএ’র মতে ‘আংশিক সাফল্য’ পাওয়া গিয়েছিলো।
এরপর ১৯৬৭ সালে নন্দাদেবীর কাছে নন্দাকোট নামে আরেকটি শৃঙ্গের ওপর নতুন এক সেট গুপ্তচরবৃত্তির যন্ত্রপাতি সফলভাবে বসানো হয়। এ জন্য ১৪ আমেরিকান পর্বতারোহীকে তিন বছর কাজ করতে হয়। তাদের প্রতি মাসে ১,০০০ ডলার দেয়া হয়েছিলো।
পার্লামেন্টে এ তথ্য জানান প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই: ১৯৭৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই পার্লামেন্টে জানান যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে নন্দাদেবী শৃঙ্গে পারমাণবিক শক্তিচালিত যন্ত্র বসানোর কাজ করেছে। তবে এ মিশন কতোটা সফল হয় তা দেশাই জানাননি। সে সময় দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের সামনে এর প্রতিবাদে ছোট একটি বিক্ষোভ হয়েছিলো বলে সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন গোপন দলিলপত্রে জানা গেছে।
বিক্ষোভকারীদের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিলো ‘সিআইএ ভারত ছাড়ো’ এবং ‘সিআইএ আমাদের পানি দূষিত করছে’।
যন্ত্রগুলোর ভাগ্যে কী ঘটেছে?: কেউ জানে না সেই হারানো পারমাণবিক যন্ত্রগুলোর কি হয়েছে। আমেরিকান সেই পর্বতারোহীদের একজন জিম ম্যাককার্থি তাকেডাকে বলেছিলেন, হ্যাঁ সেই যন্ত্রগুলো ধসের মধ্যে পড়ে কোন হিমবাহে আটকে গেছে। এর কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।
পর্বতারোহীরা বলেন, রাইনিতে একটি ছোট স্টেশন আছে যেখানে নিয়মিত নদীর জল ও বালুতে কোনো তেজষ্ক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। তবে এরকম দূষণের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
আউটসাইড সাময়িকীর রিপোর্টে বলা হয়, ব্যাটারির প্লুটোনিয়াম পুরোপুরি নষ্ট হতে কয়েক শতাব্দী লাগতে পারে।
‘ততোদিন হয়তো এটা একটা ভয়ের কারণ হয়েই থাকবে যে – হিমালয়ের বরফের মাধ্যমে ভারতের নদীগুলোতে তেজষ্ক্রিয় উপাদান মিশে যেতে পারে।’ (সূত্র: বিবিসি বাংলা)। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.