নতুন বিশ্বব্যবস্থার ডাক ব্রিকসের: স্বপ্ন সফল হওয়া কতটা সম্ভব?

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ব্রাজিল, রাশিয়া ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা—এই পাঁচ দেশকে নিয়ে গঠিত ব্রিকস। ২০০৬ সালে ব্রিক গঠনের রূপরেখা তৈরি হয়েছিল। তারপর ২০০৯ সালের ১৬ জুন তা বাস্তবে রূপ পায়। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা এই আন্তর্জাতিক জোটে যোগ দেয়। তারপর গোষ্ঠীর নাম সংশোধিত হয়ে ব্রিকস হয়েছে। কিন্তু ওখানেই শেষ। বিগত ১৩ বছরে আর কোনো দেশই যোগ দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেনি এই গোষ্ঠীতে। তবে এবার শোনা যাচ্ছে, ১৯ থেকে ২৫টি দেশ ব্রিকসে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এবারের সম্মেলনে জোটটি মূলত পশ্চিমের দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা বিশ্বে নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছে। কিন্তু সেটা কতটা সম্ভব?
পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চায় ব্রিকস: কেপটাউনে দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের প্রথম দিনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বলেন, এই জোট থেকে অবশ্যই একটি জোরালো বার্তা দিতে হবে যে বর্তমান বিশ্ব বহুমেরুভিত্তিক, এখানে নতুন ভারসাম্য তৈরি হচ্ছে এবং পুরোনো পথে নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যাবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন, তার মূলে রয়েছে অর্থনীতির কেন্দ্রীভবন এবং এর ফলে অনেকগুলো দেশ অল্প কয়েকটি দেশের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরা ব্রিকসকে বহুমেরুভিত্তিক এক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে অপরিহার্য বলে বর্ণনা করে বলেন, এটি উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রয়োজনের প্রতিফলন ঘটাবে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, সৌদি আরবসহ এক ডজনেরও বেশি দেশ এই জোটে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী মা ঝাও শু বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো এবং বিকাশমান বাজার অর্থনীতির দেশগুলোকে সহায়তা দিতে ব্রিকস জোটকে সম্প্রসারিত করা যেতে পারে।
সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব?: ব্রিকস জোট বিশ্বে ক্ষমতার নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে যে কীভাবে পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্য মোকাবিলা করবে জোটটি। তবে জোট গঠনের শুরুতে এর বিরোধিরা তেমন পাত্তা না দিলেও এখন ঠিকই গুরুত্ব দিচ্ছে। মূল সদস্যদের মধ্যে ভিন্নতা সত্ত্বেও ব্রিকস গ্রুপ আজ একটি শক্তিশালী সত্তা, যা একসঙ্গে বিশ্বের প্রায় ২৮ শতাংশ এলাকা দখল করে এবং এর জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশের (৩২০ কোটির বেশি) আবাসস্থল। ব্রিকসকে দেখা হয় শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট ‘জি সেভেন’-এর বিকল্প হিসেবে। একসঙ্গে ব্রিকস দেশগুলো বৈশ্বিক তেলের ২৫ শতাংশের বেশি এবং ইস্পাত তৈরিতে ব্যবহূত লোহা আকরিকের ৫০ শতাংশ উত্পাদন করে। তারা বিশ্বব্যাপী ভুট্টার ৪০ শতাংশ এবং বিশ্বব্যাপী গমের ৪৬ শতাংশ উত্পাদন করে। এই একীভূত শক্তির ফলে ব্রিকস দেশগুলো তাদের উপস্থিতি এবং প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে বেড়েছে।
ব্রিকস গ্রুপের সদস্যদের জাতীয় স্বার্থ এগিয়ে নেওয়া এবং স্বায়ত্তশাসন লাভ করা। এটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমা আধিপত্যের মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধের পটভূমিতে এবং চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার পটভূমিতে ব্রিকস গ্রুপ সম্প্রসারণের গতি বাড়ছে।
২০১৪ সালে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিকল্প হিসেবে নতুন উন্নয়ন ব্যাংক চালু করে এবং নতুন সদস্যদের জন্য তাদের দরজা খুলে দেয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশ, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও উরুগুয়ে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে শেয়ার গ্রহণ করেছে। প্রস্তাবিত ব্রিকস সদস্যদের মধ্যে রয়েছে ইরান, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক, মিশর, সৌদি আরব এবং অন্যান্য অনেক দেশ।
ডলারের আধিপত্য কমবে?: এত দিন খুব জোরদার না হলেও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সেই চেষ্টা বাড়ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল-ফাত্তাহ আল-সিসি সম্প্রতি নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের একটি চুক্তি অনুমোদন করেছেন, যাতে মিশর এতে যোগ দিতে পারে। ব্রিকস গ্রুপের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে মিশরের যোগদান রাষ্ট্রীয় বাজেটকে দেশের আমদানি মেটাতে মার্কিন ডলার খোঁজার চাপ থেকে মুক্তি দেবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা ও পালটা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েছে মুদ্রাবাজারে। অনেক দেশ আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের বিকল্প হিসেবে নিজেদের মুদ্রা ব্যবহারের চেষ্টা করছে।
চীন, ভারত ও তুরস্কের মতো বড় অর্থনীতির দেশ রাশিয়া থেকে রুবলে তেল ও গ্যাস কিনছে। এমনকি ইউরোপীয় দেশগুলোও রুবলে রাশিয়াকে অর্থ পরিশোধে বাধ্য হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পর রাশিয়া সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করে থাকে। ডলারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে ইরান, চীন, ব্রাজিল, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সিঙ্গাপুরসহ ১৮টি দেশের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনের চুক্তি করেছে ভারত।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদ ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের স্ট্র্যাটেজিস্ট ডেভিড উ বলেছেন, ‘রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ডলার নিয়ে অনেক দেশ ভাবতে শুরু করেছে। রাশিয়া ডলারের বদলে রুবলে লেনদেনের চেষ্টা করছে। চীনও বৈদেশিক বাণিজ্যে ইউয়ান ব্যবহারের চেষ্টা করছে, কারণ তারাও চিন্তা করতে শুরু করেছে, কোনো দিন যদি তাদের অবস্থা রাশিয়ার মতো হয়, তখন কী হবে? ফলে অনেক দেশ নিজেদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প ব্যবহারের চেষ্টা করছে। সৌদি আরব থেকে ইউয়ান ব্যবহার করে তেল কেনার বিষয়ে আলোচনা করছে চীন। এর মধ্যেই তারা ফ্রান্সের টোটাল এনার্জির সঙ্গে ইউয়ানে লেনদেন শুরু করেছে। গত মার্চ মাসে ব্রাজিল ও চীন একটি যুক্তি করেছে, যে চুক্তির বলে দুই দেশের বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তিতে পরস্পরের মুদ্রা ব্যবহার করা হবে। ইরান, ভেনেজুয়েলা ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোয় পণ্য বিনিময়ে ২০১৮ সালে সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এক্সচেঞ্জ স্থাপন করেছে চীন। বর্তমান বিশ্বে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের অবস্থান প্রায় ৭০ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে ইউরো, পাউন্ড, অস্ট্রেলিয়ার বা কানাডার মুদ্রা, ইয়েনের অবস্থান। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কের গবেষণায় দেখা গেছে, ইউরোপের দেশগুলোয় ইউরো ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হলেও অন্য অঞ্চলে এর ব্যবহার অনেক কম। ফলে সম্ভাবনা থাকলেও ডলারের বিপরীতে সেটি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। এক্ষেত্রে চীন একটি বিকল্প হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু নিজেদের অর্থনৈতিক নীতির কারণেই চীন সেটা চায় না।
ডলার হঠানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কোনো দেশ যদি তার মুদ্রাকে ডলারের বিপরীতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে তাকে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবের বড় ঘাটতি মেনে নিতে হবে। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.