ট্রাফিক পুলিশের সুখ-দুঃখ

নাসিম উদ্দীন নাসিম: (নাটোর থেকে): নাটোরের বড় হরিশপুর বাইপাসমোড়। একজন ট্রাফিক পুলিশ কনষ্টেবল হাত ইশারায় একটি মাইক্রোবাস থামালেন। তারপর কাগজপত্র দেখাতে বললেন চালককে। পাশেই কেতাদুরস্ত ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে আছেন একজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা। তার হাতে কাগজপত্র পৌঁছে দেয়ার পর তিনি সেগুলো খতিয়ে দেখে ছেড়ে দিলেন গাড়িটি।

সড়ক পথে চলার এটা চিরচেনা দৃশ্য। তো আজ হরিশপুর ওই মোড়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য আমি দাঁড়িয়ে থেকে দৃশ্যটি দেখার পর মনে হলো প্রখর রোদ আর অঝোর ধারার বৃষ্টিও তাদের দায়িত্বে ছেদ ঘটায় না। আবার নেই রাত-দিন।

নাগরিক জীবনে তাদের লক্ষ্য একটাই- কাজ। যানজট মুক্ত করতে তাদের প্রাণপণ চেষ্টা। তারা ট্রাফিক পুলিশ। তাদের হাতের ইশারায় গাড়ি থামে। আবার সচল হয় গাড়ির চাকা। দেশের সড়কে যানজটমুক্ত করতে যাদের এত কসরত, তাদের জীবনের চাকা কেমন আমি জানবো এবং লেখার চেষ্টা করবো। …রোদ-বৃষ্টি, ধুলো-বালি আর শব্দ দূষণ ট্রাফিক পুলিশের নিত্যসঙ্গী।

দিন-রাত রাস্তায় থাকার কারণে নানা রোগে ভুগছেন তারা। এরমধ্যে সাইনোসাইটিস, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা লেগে থাকে সারাবছরই। যানবাহনের তীব্র হর্নের কারণে শ্রবণ সমস্যায়ও ভোগেন অনেকে।

ট্রাফিক শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণেও আছে নানা বিড়ম্বনা। গাড়িচালক ও পথচারীদের বেশিরভাগেরই রয়েছে আইন না মানার প্রবণতা। আইন মানাতে গেলেই নানা ধরনের হুমকি-ধমকির মুখোমুখি হতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। তারপরও এসব সামাল দিয়েই দায়িত্ব পালন করেন তারা।

নাটোর ও রাজশাহীর বিভিন্ন সড়কে দায়িত্ব পালনরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের দুঃখ-কষ্টের নানা কথা। যখন যেখানে প্রয়োজন ছুটে যাই পেশাগত জীবন প্রসঙ্গে নামপ্রকাশে অনইচ্ছুক একজন সার্জেন্ট বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি পুলিশ।

জনগণের সেবায় নিজের জীবনকে ঢেলে দিয়েছি। ব্যক্তিগত জীবন আমার কাছে মুখ্য না। জনগণের সাহায্য করাই আমার একান্ত নেশা ও পেশা। যখন যেখানে আমার প্রয়োজন হয় তখন সেখানেই ছুটে যাই। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে খুব কষ্ট হতো।

কিন্তু এখন মানসিক ও শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ অভ্যস্ত হয়ে গেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে কাজ করতে হয়। চেইন অব কমান্ড মেনেই প্রতিটি পা ফেলতে হয়। আমরা যেমন নিজেদের ইচ্ছায় ছুটি কাটাতে পারি না, তেমনি কোনো কাজও করতে পারি না।

পুলিশের রুলস-রেগুলেশন যা আছে তা মেনেই কাজ করতে হয়।’ পুলিশ সদস্যকে গড়ে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাফিক পুলিশের কয়েকজন সদস্য জানান, কনস্টেবল ও সার্জেন্টরা দিনে আট ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করলেও ইন্সপেক্টর থেকে ওপরের কর্মকর্তারা ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেন।

তারা আরও জানান, ট্রাফিক পুলিশের কোনও ছুটি নেই। কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি নেই। শুধু কি তাই? দিন-রাত পরিশ্রমের পরও তাদের জন্য কোনও ধন্যবাদও নেই।

দুর্ঘটনাসহ নানা ঝুঁকির মধ্যে ব্যস্ততম সড়কে কাজ করেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। এরপরও তাদেরকেই যানজটের জন্য নিত্য সাধারণ মানুষের গালমন্দ শুনতে হয়। সড়কে যানজট না থাকলে সেই কৃতিত্ব আর তাদের ভাগ্যে জোটে না।

ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট ও ইন্সপেক্টররা বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, রাস্তায় দায়িত্ব পালনের সময় আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেও সমস্যা। প্রায় প্রতিদিনই প্রভাবশালীরা উল্টো পথে যাতায়াত করেন। কাগজপত্রসহ নানা কারণে যানবাহন আটকালেই শুরু হয়ে যায় তদবির।

প্রভাবশালীরা হুমকি-ধামকি দেওয়া শুরু করেন। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চাকরি খাওয়ারও হুমকিও দেন তারা। দিতে থাকেন নানা অপবাদ। মামলা করলে বলা হয় ‘ঘুষ’ না দেওয়ায় মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলা না করলে বলা হয় ‘ঘুষ’ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, কর্মক্ষেত্রে যথাযথ মূল্যায়ন না থাকায় ও সুযোগ-সুবিধা কম পাওয়ায় অনেক ট্রাফিক সার্জেন্টই দায়িত্ব পালনের চেয়ে অসৎ উপায়ে অর্থ-উপার্জনে বেশি আগ্রহী হন বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অযথাই গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র চেক করার নামে কতিপয় সার্জেন্ট পয়সা কামানোর ধান্ধায় থাকেন।

পেশাগত ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন মূল্যায়ন না থাকায় অনেকটা হতাশা থেকেই এমনটা ঘটছে বলে জানিয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সদস্য। ট্রাফিক পুলিশের অনেক সমস্যা রয়েছে। যা বলে শেষ করা যাবে না। এছাড়া, যারা রাস্তায় কাজ করেন তাদের বিড়ম্বনা আরও বেশি। ট্রাফিক আইন ভাঙার প্রবণতা প্রায় সবার মধ্যেই কাজ করে। যত অপবাদই থাকুক ট্রাফিক পুলিশকে রাস্তায় কাজ করে যেতে হয় প্রতিনিয়ত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্রাফিক সার্জেন্ট বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, ১৯৯৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষে সার্জেন্ট (এসআই) হিসেবে ট্রাফিক পুলিশে যোগ দেন। অদ্যাবধি একই পদে বহাল আছেন। মেধা থাকার পরও দীর্ঘদিনেও কোনও পদোন্নতি পাননি তিনি। ফলে চরম হতাশা কাজ করছে মনে।

তিনি জানান, এ জন্য দায়িত্ব পালনেও উৎসাহ তেমন নেই। মেধার মূল্যায়ন না হলে পেশার প্রতি শ্রদ্ধা কমে যায়। শুধু আমি না অনেক সার্জেন্টের মধ্যে এই হতাশা কাজ করছে বলে জানান তিনি। অন্য এক সার্জেন্ট জানান, ২০০৪ সালের ব্যাচে সার্জেন্ট হিসেবে যোগ দেন তিনি। একই ব্যাচে যিনি এএসআই হয়ে কাজ করতেন, তখন তিনি তাকে স্যার সম্বোধন করতেন।

পরে তিনি এসআই হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ভাই বলে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি পদোন্নতি পেয়ে ইন্সপেক্টর হন। এখন তাকেই উল্টো স্যার বলতে হয় তার। এই হলো অবস্থা। ট্রাফিক পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা আরোও জানান, চাওয়া মাত্র কাগজপত্র দেখাতেও অনীহা চালক ও মালিকের। আইনের দুর্বলতার কারণে যানবাহনের চালকরাও থাকেন বেপরোয়া। আইন না মানাকে তারা গর্বের কাজ বলে মনে করেন।

এমন বহুমুখী সংকটের মধ্যেই দায়িত্ব পালন করে যেতে হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের। ট্রাফিক একজন কনস্টেবল বলেন, ‘আমাদের কষ্টের কি শেষ আছে ভাই ? একটু পানি খাওয়ার জন্যও সরতে পারি না। একটু সরলেই রাস্তায় গাড়ির জট লেগে যায়।

গায়ে পুলিশের পোশাক, কিন্তু ধুলোবালির কারণে বেশিরভাগ সময়েই তা অপরিষ্কার ময়লা থাকে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে সরকারিভাবে বেশি পোশাকও দেওয়া হয় না। ফলে ময়লা পোশাক পরেই ডিউটি করতে হয়।’ , ‘একজন টিআই জানান ,আমরা দিনে ১৫-১৬ ঘণ্টা ডিউটি করি— এটা ঠিক। কিন্তু পুলিশে যখন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.