জাতির কল্যাণে আরও কিছুদিন তার বেঁচে থাকা প্রয়োজন ছিল – দুলু


প্রেস বিজ্ঞপ্তি: দেখতে দেখতে একটি বছর চলে গেল। এই এক বছরে অনেক আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং দেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ীসহ অনেককে হারিয়েছি। তাদের মধ্যে অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম ভাই। দেশ ও জাতির কল্যাণে নুরুল ইসলামের আরও কিছুদিন বেঁচে থাকাটা বড়ই প্রয়োজন ছিল।
তার সঙ্গে আমার পরিচয় তিন দশক আগে। ’৮০-র দশকে নাটোরের সুগার মিলের পাশে যমুনা ডিস্টিলারি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় ঢাকা থেকে নাটোরের যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না, তাই তিনি নাটোরে খুব কমই যেতেন। কিন্তু তার পরিবারের যারা এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের মাধ্যমেই নুরুল ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ বা পরিচয়। আমি সে সময় স্থানীয়ভাবে জেলা ছাত্রদলের নেতৃত্বে ছিলাম। ওই সময়ে এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী জোরদার আন্দোলন চলমান ছিল।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের অংশ হিসেবে বড় সভা-সমাবেশ উপলক্ষ্যে জাতীয় নেতারা নাটোর সফরে গেলে বা বিশেষ করে বড় কোনো অনুষ্ঠান হলে নুরুল ইসলাম ভাইকে আমরা জানাতাম, ঢাকার মতিঝিলে সেনাকল্যাণ ভবনে তার সেই অফিসে দেখা করতে বলতেন। আর কেন জানি নাটোর থেকে সুদূর ঢাকায় পাড়ি দিয়ে এই দেখা করার দায়িত্বটা পড়ত আমার ওপর। যখনই দেখা করতে তার অফিসে যেতাম, প্রায়ই দুপুরে তার সঙ্গে খাবার খেতে হতো।
জেলা শহরের একজন ছাত্রনেতার প্রতি এত সহমর্মিতা এবং সম্মান আমাকে বিমুগ্ধ করত। তিনি এত অর্থবিত্তের মালিক হওয়া সত্ত্বেও মোটা চালের ভাত খেতেন। আমি কৌতূহলী হয়ে একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাই আপনি মোটা চালের ভাত খান? তখন উনি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন যে, দেশের বেশির ভাগ মানুষই তো মোটা চালের ভাত খায়, দেশের বেশির ভাগ মানুষের যখন সরু চালের ভাত খাওয়ার সামর্থ্য হবে তখন না হয় আমিও খাব।
আর আমি তো সপ্তাহে একদিন বিভিন্ন প্রজেক্টে শ্রমিকদের সঙ্গে বসে দুপুরের খাবার খাই, মোটা চালের ভাতে অভ্যস্ত থাকার কারণে শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে আমাকে খাবারের অভিনয় করতে হয় না, আমি এনজয় করি, শ্রমিকরাও খুশি হয়, আনন্দ পায়, এটা কম কী? আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম যে, সাধারণভাবে জীবনযাপনের অন্তর্নিহিত দর্শনের গভীরতা কত সুদূরপ্রসারী।
এক সময় আমাদের সম্পর্কটা কাছাকাছি চলে আসে, ঘুচে যায় সামাজিকতার দূরত্ব, বয়সের ব্যবধান। কী অবলীলায় তিনি আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আসনে সমাসীন হয়ে যান, আমি বুঝতেও পারিনি। পড়ন্ত বিকালে অফিসে কাজের চাপ কমে এলে অনেক গল্পই করতেন। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের গল্প, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের স্বদেশ, নিজের জীবনযুদ্ধের চড়াই-উতরাই, পরিবারে একজন দায়িত্ববান স্বামী, স্নেহ-ভালোবাসায় আপ্লুত একজন পিতার গল্প, আরও কত কী।
নুরুল ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে যখন তার স্ত্রী সালমা ইসলামের বিবাহ হয় তখন ভাবি ছিলেন এইচএসসি অধ্যয়নরত একজন মেয়ে, নুরুল ইসলাম ভাইয়ের উৎসাহে তিনি এমএ পাশ করেন, এলএলবি পাশ করে সুপ্রিমকোর্টের একজন স্বনামধন্য আইনজীবী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে এমপি এবং প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত হন। তার একমাত্র ছেলে শামীম ইসলামকে এইচএসসি পর্যন্ত ক্যাডেট কলেজে পড়াশোনা করিয়ে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন।
শামীম ইসলাম লন্ডনে ছয় বছর পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসেন। তার তিন কন্যা সারীয়াত তাসরীন সোনিয়া, মনিকা নাজনীন ইসলাম ও সুমাইয়া রোজালিন ইসলাম উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। এই মহান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ভাই ও তার স্ত্রী সালমা ইসলাম তাদের পুত্র-কন্যাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত সন্তান এবং সুযোগ্য উত্তরাধিকার বিনির্মাণের কাজটি অত্যন্ত সুনিপুণ হাতে সম্পন্ন করে দায়িত্বশীল পিতামাতার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
১৯৭৪ থেকে ২০২০ সাল-মাত্র ৪৬ বছরে তিনি ৪১টি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।
পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন শিল্পপতি হিসাবে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। তিনি কোনো ব্যাংকের টাকা মেরে দেননি, কোনো ব্যাংকে তার এক টাকাও খেলাপি ঋণ ছিল না। একজন দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী হিসাবে তার সব অর্থ, মেধা ও পরিশ্রম দেশেই বিনিয়োগ করেছেন। তিনি খেলাপি ঋণ এবং বিদেশে টাকা পাচারের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন।
এক সময় যমুনা গ্রুপের অ্যারোমেটিক কসমেটিক্স খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। আমার অনুরোধে নুরুল ইসলাম ভাই অ্যারোমেটিক কসমেটিক্সে আমার পরিচিত অনেকেরই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, যারা এখন বর্তমানে অনেক ভালো ভালো জায়গায় অবস্থান করছেন। একদিন কথায় কথায় নুরুল ইসলাম ভাই বলেছিলেন যে, উনি একটি পত্রিকা বের করতে চান। ওই সময় একটি পত্রিকার কর্তৃপক্ষের অসৌজন্যমূলক ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে বর্তমান জনপ্রিয় পত্রিকা যুগান্তর প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সে সময় কোনো একদিন বর্তমান যুগান্তর পত্রিকার জনপ্রিয় সম্পাদক সাইফুল আলম ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সাইফুল আলম ভাই তখন ইনকিলাব পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক ছিলেন।
বর্তমানে নুরুল ইসলাম ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশন দেশে বিভিন্ন সামাজিক বৈষম্য বিলোপ এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সপক্ষে উচ্চকিত কণ্ঠে সাহসী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ এবং বিদেশে টাকা পাচারের বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থানের কারণে এ দুটি গণমাধ্যম খেলাপি ঋণ ও টাকা পাচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সংবাদ প্রচার করে থাকে।
তিনি অতীতকে ভিত্তি করে অপূর্ব সুন্দর করে ভবিষ্যতের স্বপ্ন রচনা করতে পারতেন। আমি দেখেছি ওই সময় তার অফিসের ওয়েটিং রুমে অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন, তার সঙ্গে একটু খোশগল্প করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। যারা পরবর্তী সময়ে এমপি হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন এবং এখনো তাদের বেশির ভাগই জীবিত আছেন।
পরবর্তীকালে আমিও এমপি, মন্ত্রী হয়েছি। এ সময়ে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে কিন্তু নুরুল ইসলাম ভাইয়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল। গত ৩৫ বছর আমি তাকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। ভালো কিংবা খারাপ সময় আমি যেমন তার পাশে ছিলাম, ঠিক তিনিও সব সময় আমার পাশে ছিলেন।
গুলশানে পাশাপাশি বাসা হওয়ার সুবাদে প্রায়ই তার সঙ্গে গুলশান লেডিস পার্কে একসঙ্গে হেঁটেছি, জাতীয়ভাবে পালিত বিভিন্ন উৎসবে, পার্বণে, দিবসে একসঙ্গে অনুষ্ঠান করেছি। আমার দেখা তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তিনি সব সময় সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু সত্য কথাটা স্পষ্টভাবে বলতেন। এজন্য অনেক সময় তাকে চড়া দামে অনেক মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। তবে তাকে কখনো ভেঙে পড়তে বা সত্য ও ন্যায়ের প্রশ্নে বিচ্যুতির মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করতে দেখিনি।
তার জনকল্যাণমূলক ব্যবসা চিন্তা ও অর্ধলক্ষাধিক লোকের জন্য কর্মসংস্থান তৈরির মধ্য দিয়ে দেশ এবং জাতির কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তখনো আমার সঙ্গে ফোনে তার নিয়মিত কথা হতো। স্বাস্থ্যগত অবস্থার অবনতি ঘটলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পরবর্তীকালে তার একমাত্র ছেলে শামীম ইসলামের সঙ্গে নিয়মিত কথা হতো, তখন উনি তার বাবার স্বাস্থ্যের উন্নতির কথাই বলতেন কিন্তু হঠাৎ একদিন টেলিভিশনে নুরুল ইসলাম ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ দেখলাম।
প্রবাদ আছে, পৃথিবীতে কিছু কিছু মৃত্যু নাকি পাহাড়ের মতো ভারী, আর কিছু কিছু মৃত্যু নাকি পালকের চেয়ে হালকা হয়, আমার কাছে নুরুল ইসলাম ভাইয়ের মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী মনে হয়েছিল। তার এই অসময়ে চলে যাওয়াটা আমাদের জাতীয় জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। যার কাছে স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ধরা দিত তার শূন্যতা এত সহজে পূরণ হওয়ার নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা জনকল্যাণে তার অবদান এ দেশের মানুষ কখনো ভুলতে পারবে না।
তার সুযোগ্য উত্তরাধিকার যমুনা গ্রুপের বর্তমান এমডি শামীম ইসলাম হয়তো তার পিতার দেখানো পথ এবং ঐতিহ্যকে ধারণ করবেন। নতুন প্রজন্মের প্রাগ্রসর চিন্তার মাধ্যমে নেতৃত্ব প্রদান করে যমুনা গ্রুপকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তাহলেই নুরুল ইসলাম ভাইয়ের স্বপ্ন সার্থক হবে। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার আত্মার মাগফিরাত এবং সেই সঙ্গে তার স্বপ্নের যমুনা গ্রুপের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করছি।
লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.