চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন নন্দিত শিক্ষাবিদ ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
বিটিসি নিউজ ডেস্ক: বাবার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন নন্দিত শিক্ষাবিদ ও জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। স্বাস্থ্যবিধি মেনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়।
আজ শুক্রবার (১৫ মে) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে শেষ নিদ্রায় শায়িত হলেন তিনি।
এর আগে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) থেকে ড. আনিসুজ্জামানের মরদেহ আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
মৃত্যুর আগে ও পরে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের শরীর থেকে সংগৃহীত নমুনায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়। ফলে তার দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আল মারকাজুল ইসলাম। করোনায় মৃতদের যে প্রক্রিয়ায় দাফন করা হয় তা সবগুলো মেনেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ শিক্ষককে শেষ বিদায় জানানো হয়।
উল্লেখ্য, গতকাল বৃহস্পতিবার (১৪ মে) রাজধানী ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ড. আনিসুজ্জামান। মৃত্যুর আগে ও পরে তার শরীর থেকে সংগৃহীত নমুনায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়। সে কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তার জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়।
মৃত্যুকাল স্ত্রী সিদ্দিকা জামান, ২ মেয়ে রুচিবা ও শুচিতা এবং ১মাত্র ছেলে আনন্দ জামানসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও গুণগ্রাহীকে রেখে গেছেন।
বাংলা একাডেমির সভাপতি আনিসুজ্জামানের বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। হৃদরোগ, কিডনি ও ফুসফুসে জটিলতা, পারকিনসন্স ডিজিজ এবং প্রোস্টেটের সমস্যার পাশাপাশি শেষ দিকে তার রক্তেও ইনফেকশন দেখা দিয়েছিল।
অসুস্থতা বাড়তে থাকায় গত ২৭ এপ্রিল তাকে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ৯ মে তাকে নেয়া হয়েছিল ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক, ভাষাসংগ্রামী, মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী, সংবিধানের অনুবাদক, দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রবর্তী মানুষ।
জাতির বিবেকসম এ মানুষটি ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন আনিসুজ্জামান। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
এই ভূখন্ডে ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদবিরোধী নানা আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণআদালতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ডঃ কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তার গবেষণা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আনিসুজ্জামান শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তাকে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক প্রদান করা হয়। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।
এছাড়া তিনি ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে ২বার আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক লাভ করেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ পেয়েছেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।
আনিসুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে ‘স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন’, ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ স্মারকগ্রন্থ’, ‘নারীর কথা’, ‘মধুদা, ফতোয়া’, ‘ওগুস্তে ওসাঁর বাংলা-ফারসি শব্দসংগ্রহ’ ও আইন-শব্দকোষ অন্যতম।
বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, অলক্ত পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছেন।
জাতীর নক্ষত্র অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.