ঋণী রয়ে গেলাম, তবু স্যালুট রক্তযোদ্ধাদের!


মো. আমানুল্লাহ আমান:
শৈশবে নানাবাড়ি গেলে আইসক্রিম এবং আম ও আমড়ার আচার ছিল রুটিন খাবার। সে সময় আট আনা দাম ছিল আইসক্রিমের। নানি পয়সা দিতেন, কিনে খেতাম। তবে আচার তিঁনি নিজেই তৈরি করে খাওয়াতেন। অসুস্থতা ও বয়সের ভারে বছর পাঁচেক থেকে আচার তৈরি করতে পারেন না। সম্প্রতি নানির অবস্থা এতটাই গুরুতর হয় যে, প্রায় মৃত্যুর কোলে ঢলেই পড়ছিলেন। শুরু হয় পেটের তীব্র প্রদাহ ও বুক ধড়ফড়। হার্টের রোগ ছিল আগে থেকেই। দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যাওয়ায় স্বাভাবিক চলাফেরায় অক্ষম বিগত এক দশক ধরে। সবশেষ আবারও দুঃসংবাদ!
নানি বলতে শুরু করেন, ‘হয়ত আর বাঁচবো না; আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চল, মৃত্যু হলে ওখানে গিয়েই হোক!’ এ সময় পুত্রবধূকে (মামি) দুহাজার টাকা দিয়ে বলেন, মারা গেলে এ টাকা দিয়ে আমার কাফনের কাপড় কিনে নিও। খবর পেয়ে আত্মীয়-স্বজন, এলাকার নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই বাসায় হাজির। আর কেনই বা আসবেন না, ৯০ বছর বয়সী মহিয়সী এ নারীর কর্মকাণ্ড এলাকায় যে বেশ প্রশংসিত। অর্থবিত্ত দিয়ে একাধিক মসজিদ, মাদরাসা ও গোরস্থানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়তে তাঁর অবস্থান সম্মুখসারিতে। দেশবিদেশের নামকরা লেখকদের গ্রন্থ কিনে পারিবারিক লাইব্রেরী তৈরিতে সহযোগিতা করে মধ্যবয়সীদের মাঝেও ছড়িয়েছেন শিক্ষার আলো। এলাকার অসহায় ও দুুঃস্থদের জন্য টাকা ও খাবার বিলিয়েছেন দুহাত ভরে। কেউ কিছু চাইলে, কখনো খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে দেখিনি। তাঁর এসব অবদানের কথা স্থানীয় কারও অজানা নয়।
মুমূর্ষ অবস্থায় নানিকে নিয়ে হাজির হলাম চিকিৎসকের কাছে। তার পরামর্শে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেল, হার্টের অবস্থা বেশ ক্রিটিক্যাল (ইশকেমিক হার্ট ডিজিজ)। পাথর রয়েছে পিত্তথলিতে। রোগটির নাম কোলেলিথিয়েসিস। আক্রান্ত হয়েছেন মডারেট অ্যানিমিয়া রোগেও। রক্তে হিমোগ্লোবিন মাত্র ৬.৫৯! হাসপাতালে ভর্তির পরও পা ফুলে অবস্থা জটিলের দিকে যাচ্ছিল ক্রমশ। তীব্র প্রদাহে এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারছেন না। অপারেশন ছাড়া সুস্থতার কোনো সম্ভাবনা নেই। মৃত্যুঝুঁকিও প্রবল। অপারেশনের আগেই অন্তত চার ব্যাগ রক্ত দেয়ার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক। এরপর পরীক্ষা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত। জরুরি রক্তের প্রয়োজনীয়তায় স্মরণ করলাম শুভাকাঙ্খীদের। রক্তযোদ্ধারা সংবাদটি শুনেই এগিয়ে আসলেন স্বেচ্ছায়। বেশ কয়েক দিক থেকে ফোন ও ক্ষুদে বার্তা আসতে থাকলো।
সর্বপ্রথম ব্লাড ডোনেট করে কিছুটা স্বস্তি দিলেন রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজের ইংরেজি বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সারোয়ার হোসেন। তার বাসা রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাকনহাট এলাকায়। রক্তদানের জন্য হাসপাতালে এসে নিজেই খুঁজতে থাকেন ব্লাডব্যাংক কর্ণার। এরপর তার রক্ত পেয়ে কিছুটা স্বস্তিতে স্বজনরা। সারোয়ার তৃতীয়বারের মতো রক্তদান করলেন। তিনি আজীবন পাশে দাঁড়াতে চান মুমূর্ষ রোগীদের। দ্বিতীয় রক্তদাতা রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক নার্সিং কলেজের ডিপ্লোমা কোর্সের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান। ইভিনিং শিফটে হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসে এসে তিনি রক্তের প্রয়োজনীয়তার কথা শুনেই বললেন, ‘ভাইয়া আমার রক্তের গ্রুপ ও পজেটিভ। দু-তিন বছর আগে একবার ব্লাড দিয়েছিলাম। আজ আবারও দেব, চলেন ব্লাড ব্যাংকে।’ যেই কথা সেই কাজ, বিএসসি কোর্সের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুর্শিদা মিরাকে সঙ্গে নিয়ে নিঃসঙ্কোচে ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে ফরম পূরণ করে জমা দিলেন। তার রক্ত পেয়ে আরেকটু স্বস্তির নিঃশ্বাস।
এরমধ্যে ফোন এলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোছা. সাথী আক্তারের। লোকেশন জিজ্ঞেস করে তিনিও হাজির হাসপাতালে। সাথী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বজন‘র সাধারণ সম্পাদক। গত ৫ মাসে প্রায় এক হাজার রোগীর রক্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছে সংগঠনটি। এদিন নানির রক্তদাতা সাথীর সহপাঠি মোছা. রোজিনা খাতুন। এবারই প্রথম তার রক্তদান হলেও রক্তদানের পর বেজায় খুশি রোজিনা। রক্তদান শেষে তারা রিকশাভাড়া নিতেও অসম্মতি জানিয়ে শুধু বললেন, ‘ভাইয়া এটা আমাদের দায়িত্ব’! কতখানি মানবসেবী মনোভাব হলে স্বেচ্ছায় রক্ত দেয়ার পর বলা যায়, রক্তদান তাদের দায়িত্ব! চতুর্থ ব্যাগ রক্তদাতা রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় হোসেন। প্রথমবার রক্ত দিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘ভাই, তিনমাস পর আবারও রক্ত দেব।’ তাকে পাঠিয়েছেন হিলফুল ফুজুল রক্তদান ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা শাফি মাহমুদ রনি। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত সংগঠনটি গ্রাম্য এলাকার রোগীদের ১২৭ ব্যাগ রক্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর বাড়ছে অসুস্থ জনগোষ্ঠির সংখ্যা। উদ্ভুত নতুন নতুন রোগ ও পুরাতন রোগের নতুন রূপ- দিন দিন বাড়াচ্ছে উদ্বিগ্নতা। যা পরবর্তী প্রজন্মের সুস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। তবে মুমূর্ষ রোগীর প্রাণ বাঁচাতে সর্বশেষ প্রচেষ্টা থাকে রক্তযোদ্ধাদেরও। একমাত্র রক্তাদাতারাই নির্দিধায় দেন ‘অমূল্য ঋণ’! তাদের স্মরণে প্রতিবছর ১৪ জুন ঘটা করে পালন করা হয় বিশ্ব রক্তদান দিবস। প্রতিবছর স্বেচ্ছায় রক্তদান হয় প্রায় ৮ কোটি ইউনিট। তবে এর মাত্র ৩৮ শতাংশ সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে, যেসব দেশে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ মানুষের বসবাস। অথচ এ রক্তদানের রয়েছে ঢের উপকারিতা।
মেডিকেল সাইন্সের মতে, ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়স্ক সুস্থ ব্যক্তি, যাদের ওজন ৪৫ বছরের ওপরে; তারা অনায়াসে রক্ত দিতে পারেন। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির শরীরে ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে। কিন্তু রক্ত দেয়া হয় ১০ ভাগের একভাগ, অর্থাৎ মাত্র ২৫০ থেকে ৪০০ মিলিলিটার। যা শরীরের ওপর তেমন কোনো প্রভাবই ফেলে না। যা তিন মাস পর পর দেয়া যায়।
শুধুমাত্র নির্দিষ্ট দিবসে সীমাবদ্ধ না থেকে, রক্তযোদ্ধাদের অপরিশোধিত ঋণের সংরক্ষণ করে তাদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করা উচিৎ বলে মনে করি। দেশে তাদের সব ধরণের চিকিৎসায় বিশেষ ছাড় দেয়া সময়ের দাবি। ‘ব্লাড ডোনেট কার্ড’ পদ্ধতি চালু করে রক্তাদাতাদের পরিচয় নিশ্চিত ও তাদের স্মরণীয় করে রাখা যেতে পারে। রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্বোগে সহজেই এটা করা সম্ভব। এতে একদিকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও রক্তদাতারা উৎসাহ পাবে, অন্যদিকে মুমূর্ষ রোগীদের সুস্থ করা সম্ভব হবে। যেমনটা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ঘুরে আসলেন বৃদ্ধা।
যদিও নিশ্চিত মৃত্যুর আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত নানির অপারেশন করতে অপারগতা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। অপারেশন বা সুস্থতা কোনোটিই যেহেতু সম্ভব না; সেহেতু নানি যে কয়দিন বাঁচেন, তাতেই খুশি থাকতে বললেন তারা। অবশ্য এতে বেশ অখুশি নানি। হাসপাতাল ছাড়ার সময়ও বারবার বলছিলেন, ‘মারা গেলে যাব, অপারেশনটা করে দাও। আমাকে বাসায় নিয়ে যেও না তোমরা।’ মানুষ কতটা শারীরিক জটিলতায় থাকলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চায়! কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যুর আশঙ্কায় স্বান্তনা ওষুধে বিদায় নিতে হলো। তবে রক্তদানের ফলে ভিন্নরোগের উপকার তো হয়েছেই নানির। জয় হোক মানবতার। রক্তযোদ্ধাদের স্যালুট! ঋণী রয়ে গেলাম নানি এবং রক্তযোদ্ধাদের কাছে!

লেখক: মো. আমানুল্লাহ আমান, সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠাতা, স্বপ্নবাজ (স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন), রাজশাহী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.