ঈদুল আযহা আমাদের ত্যাগ, শান্তি, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দেয়

মোঃ মমতাজ আলী শান্ত: আনন্দ ও ত্যাগের অনন্য মহিমায় উদ্ভাসিত পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। পবিত্র এই দিনে আমরা কোরবানির মাধ্যমে তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকি। পাশাপাশি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জন এবং মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে সবার মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি করি।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর এক বিশেষ রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যেসব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন ।(সূরা আল হজ্ব ,আয়াতঃ ৩৪)।
মুসলিমদের অন্যতম বৃহৎ উৎসব কুরবানীর ঈদ-উল-আযহা বা কুরবানীর ঈদ। আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু হওয়া এ কুরবানীর মূল শিক্ষাই হল সকল প্রকার যুক্তি ও বুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর হুকুম আহকামের  প্রতি পূর্ণ আত্মসমার্পণ করা। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের নমুনাস্বরূপ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) নিজ প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-কে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে গিয়েছিলেন। আল্লাহর হুকুমের প্রতি অতিশয় আনুগত্যের কারণে আল্লাহ্তায়ালা তার এ কুরবানীকে কবুল করে নেন, এ ঘটনা আল্লাহর হুকুমের পূর্ণ আনুগত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।
ঈদুল আযহা বা ইয়াওমুন নাহর। আমাদের দেশের ভাষায় কুরবানী ঈদ। ঈদুল আযহার দিনের প্রধান আমল- কোরবানী । শরীয়তে কোরবানীর যে পন্থা ও পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে তার মূলসূত্র ‘মিল্লাতে ইবরাহীমী’তে বিদ্যমান ছিল। কুরআন মাজীদ ও সহীহ হাদীস থেকে তা স্পষ্ট জানা যায়। এজন্য কোরবানীকে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ নামে অভিহিত করা হয়।
কুরবানীর গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কুরআন ও হাদীস এ ব্যাপারে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় হাবীবকে লক্ষ করে বলেন-‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর।’ (সূরা কাওসার, আয়াতঃ ২)।
অবিশ্বাসী-মুশরিকরা তাদের উপাস্যদের উদ্দেশ্যে কুরবানী করে থাকে। তার প্রতিবাদ স্বরূপ এ আয়াতের মাধ্যমে মুসলিমদের আল্লাহর জন্য সালাত আদায়ের ও তার উদ্দেশ্যে কুরবানী করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। মুফাসসিরদের কারও কারও মতে, এ আয়াতে বিশেষভাবে ঈদ-উল-আযহার নামায ও নামায শেষে কুরবানীর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেন- ‘আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।’ (সূরা আল হজ্ব, আয়াতঃ ৩৬)।
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন-‘আর আমি তাঁর (ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবেহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী।” (সূরা সাফফাতঃ ১০৭)।
কুরবানীর সপক্ষে নিন্মোক্ত আয়াতটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “আমি এটা (তাঁর আদর্শ) পরবর্তীদের মধ্যে রেখেছি।” (সূরা সাফফাতঃ ১০৮)। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা পশু কুরবানীর বিধানটি ইবরাহীম (আঃ) এর পরবর্তী মানুষের জন্য রেখে দিয়েছেন।
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন- ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়। (সুনানু ইবনে মাজাহ)।
তিনি আরও বলেন- ‘যে ব্যক্তি প্রফুল্লচিত্তে কুরবানী আদায়ের নিয়তে কুরবানী করে, কিয়ামতের দিন তার এবং জাহান্নামের মধ্যে আড়াল সৃষ্টি হবে।’ (বায়হাকি) এটি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ যা ‘সুন্নাতে ইব্রাহীম’ হিসেবে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং সাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানী করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় মুসলিম উম্মাহ সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে।
এ ছাড়া মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত আদম (আঃ) হতে পৃথিবীর সব জাতিই কোনও-না-কোনও পদ্ধতিতে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয়বস্তু উৎসর্গ করেছেন। এ ইতিহাসের স্বীকৃতি প্রদান করে মহান আল্লাহ্তায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেনঃ-‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানীর এ বিশেষ রীতিপদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যেসব আল্লাহ্ তাদেরকে দান করেছেন’। (সূরা আল হজ আয়াতঃ ৩৪)
পবিত্র কোরআনের সুরা হজ্ব এর ৩৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে- ‘আল্লাহতায়ালার দরবারে কোরবানীর পশুর মাংস কিংবা রক্ত কিছুই পৌঁছায় না, বরং তোমাদের তাকওয়া তাঁর কাছে পৌঁছায়। এভাবেই তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যেন তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পারো-এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। আর সুসংবাদ দাও সৎকর্মপরায়ণদের।’
ঈদ-উল-আযহা আমাদের শান্তি, সহমর্মিতা, ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দেয়। সঞ্চারিত করে আত্মদান ও আত্মত্যাগের মানসিকতা। এ মর্ম অনুধাবন করে সমাজে শান্তি ও কল্যাণের পথ রচনা করতে আমাদের সংযম ও ত্যাগের মানসিকতায় উজ্জীবিত হতে হবে। কুরবানীর অন্যতম শিক্ষা দরিদ্র ও অনাথের সুখ-দুঃখে ভাগীদার হওয়া। ঈদুল আযহার নামাযে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সহাবস্থানের পাশাপাশি আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্র-ইয়াতিমের মধ্যে কুরবানীর গোশত বণ্টন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, আমাদের সম্পদে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার রয়েছে।
পবিত্র ঈদ-উল-আযহার আনন্দ ও ত্যাগের অনন্য মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক দেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবন। এই দিনে মানুষে মানুষে প্রীতি ও বন্ধনের যোগসূত্র আরও সুদৃঢ় হোক। আসুন, সবাই মিলে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করে সুস্থ ও সুন্দর জীবন গড়ি। সবাই ভালো থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, সুরক্ষিত থাকুন। দূরত্ব বজায় রেখে ঈদ জামাতসহ প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করি। মানুষে মানুষে মহামিলনের এই মহা-আনন্দের দিন উপলক্ষে আমি সবাইকে জানাই ঈদ মোবারক।
লেখকঃ  মোঃ মমতাজ আলী শান্ত, সমাজ সেবক ও তরুণ উদ্যেক্তা। ব্যাচেলর অফ বিজনেস স্টাডিজ  (বিবিএস- অনার্স) – ফার্স্ট ক্লাস, মাস্টারর্স ইন বিজনেস স্টাডিজ (এম বি এস) – ফার্স্ট ক্লাস, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.