আরডিএ’র প্রকৌশলীকে অবৈধ নিয়োগ প্রদান, তিন কর্মকর্তাকে আদালতের তলব

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী উন্নয়ন কতৃপক্ষ (আরডিএ’র) সহকারী প্রকৌশলী শেখ কামরুজ্জানকে অবৈধ পন্থায় নিয়োগ পাওয়ে দেয়ার অভিযোগে ২০১১ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান, তৎকালীন আরডিএ’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুর রব জোয়ারদার ও শেখ কামরুজ্জানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
এ মামলায় বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) তাদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন রাজশাহী বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালত।আদালতে হাজির হয়েছিলেন দুদকের দায়ের করা মামলার তিন আসামী।
বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রতিবেদককে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের আইনজীবী বজলে তৌহিদ আল হাসান বাবলা।
তিনি বলেন, রাজশাহী বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালত থেকে মামলাটি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে গিয়েছিল। তারপর সেখান থেকে মামলাটি নাকচ করে দেয়া হয়। এরপর তারা সুপ্রিম কোর্টে আপিল বিভাগে যান।
সেখানে লিভ টু আপিল দায়ের করার পর চার সপ্তাহের একটি স্টে অর্ডার পান। পরবর্তীতে তারা আর কোনো প্রকারের স্টে অর্ডার পেতে ব্যর্থ হন। আজও রাজশাহীর বিজ্ঞ আদালত তাদের কাছে লিভ টু আপিলের সাটিফাইড কপি চান। কিন্তু তারা ওই সার্টিফাইড কপি না দিয়ে তাদের আইনজীবীর ইনফরমেশন স্লিপ প্রদান করেন।
তবে আদালত তাদের আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে লিভ টু আপিলের সার্টিফাইড কপি দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তানাহলে আদালত আগামী ধার্য তারিখের মধ্যেই চার্জ গঠনের কথাও জানিয়েছেন বলে জানান দুদকের এ আইনজীবী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৭ সালে আরডিএ’র প্রকৌশলী শেখ কামারুজ্জামান সহ সাবেক দুই কর্মকর্তার নামে দুদকে অভিযোগ করেন মো. ইকবাল হোসেন নামের আরএডি’র সাবেক এক  কর্মচারী।
পরবর্তীতে ২০১১ সালে দুদকের তদন্তে ঘটনার সত্যতা মেলে। ওই বছরেই তাদের নামে মামলা দায়ের করেন দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক আব্দুল করিম। নিয়মানুসারে  মামলাটির দায়ভার অর্পিত হয় তৎকালীন দুদকের উপ-পরিচালক আনোয়রুল ইসলামের ওপর। মামলাটি আনোয়ারুল ইসলাম চুড়ান্ত প্রতিবেদন সত্য (এফআরটি) বলে বিজ্ঞ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তবে ওই সময় অভিযোগকারী দুদক উপপরিচালকের প্রদেয় প্রতিবেদন প্রদানের কারণে তার বিরুদ্ধেই দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। ওই লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুণঃতদন্তের নির্দেশ দেন তৎকালীন দুদকের উপপরিচালক ফরিদুর রহমানকে।
পরে আদালত কর্তৃক মামলার চার্জশীট গৃহীত হয় ৫ এপ্রিল ২০১৮। এর আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের এ্যাপিলেট ডিভিশন থেকে চার সপ্তাহের একটি স্টে অর্ডার নেন আসামীরা। পরে তারা আবারো স্টে অর্ডার বর্ধিত করার জন্য আপিল করলে বিজ্ঞ আদালত তাদের সুপ্রিম কোর্টের এ্যাপিলিট ডিভিশনে আপিল করার পরামর্শ দেন। বর্তমানে রাজশাহী বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে ৫/২০১৬ (মেট্রো রাজ)  মামলাটি চলমান রয়েছে। এদিকে অভিযোগকারীর ভাষ্য, ২০১৮ সাল থেকে আজ অবধি বিজ্ঞ আদালত প্রতিটি ধার্য্য তারিখে বিবাদীদের লিভ টু আপিলের সার্টিফাইড কপি দাখিলের নির্দেশ প্রদান করলেও তারা তা আমলে না নিয়ে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করাচ্ছেন। যা আমি মনে করি, এসব তাদের চালাকি এবং আদালত অবমাননার সামিল।
উল্লেখ্য, শেখ কামরুজ্জামান ২০০৪ সালে রাউকের নিয়োগ পরীক্ষায় অকৃত কার্য হয়েও অর্থ ও ক্ষমতার বলে অবৈধ ভাবে নিয়োগের কারণে ২০১২ সালের ১৪ জানুয়ারি দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ওই মামলার ২০১৮ সালের চার্জশিটভূক্ত আসামী তিনি।
ফেল করেও এখনও বহাল তবিয়তে রাউকে স্বপদে চাকরি করছেন মানবিক বিভাগ থেকে পড়া শেখ কামরুজ্জামান।
এদিকে, রাউকের সহকারী প্রকৌশলী পদে তার অবৈধ নিয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দুদকের মামলা চলমান রয়েছে। তার নিয়োগ ও অনিয়মের চর্চা রাউক তথা নগর জুড়ে এখন হট টকে পরিণত হয়েছে।
এরই মধ্যে প্রতিবেদকের কাছে রাউকের সহকারী প্রকৌশলী শেখ কারুজ্জামানের দুদক,গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের চিঠি, আদালত ও থানার নথিসহ তার অবৈধ নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যদি হাতে এসেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধ ভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত শেখ কামরুজ্জামান ১৯৯৩ সালে মানবিক বিভাগ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি পাস করেন। পরে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা পাস করেন। অথচ সহকারী প্রকৌশলী পদে চাকরির লিখিত পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়ে ছিলেন তারা সকলেই ছিলেন বিএসসি (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রিধারী যোগ্য প্রার্থী।
জানা গেছে, ওই পরীক্ষায় সুলতান মো. সাজ্জাদ, মোহা.কাজেম উদ্দিন, মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ, মো. শাহিন ইবনে রফিক ও এএমএম রাশেদুর রহমান পর্যায় ক্রমে উর্ত্তীণের তালিকায় অবস্থান করেন। অকৃতকার্য হন শেখ কামরুজ্জামান।
রাউক কর্তৃপক্ষ ‘অনিবার্য’ কারণ দেখিয়ে ২০০৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর উক্ত লিখিত পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করেন। এরপর মৌখিক পরীক্ষায় বিএসসি ডিগ্রীধারী সকল কৃতকার্যদের বাদ দিয়ে সহকরী প্রকৌশলী পদে শেখ কামরুজ্জামানকে চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হয়।
নিয়োগ সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৪ সালের ১৬ আগস্ট ১০টি পদের বিপরীতে ১১ জন জনবল নিয়োগে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
সহকারী প্রকৌশলী পদের শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য চাওয়া হয়-‘ফিজিক্যাল প্লানিং/টাউন প্লানিং/আরবান এন্ড রিজিওনাল প্লানিং/সিভিল ডিজাইন/ইলেকট্রিক এ মাষ্টার ডিগ্রি অথবা স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা অথবা সসিওলজি/ভূগোল/অর্থনীতিতে মাষ্টার ডিগ্রী এবং তৎসহ এমপিপি ডিগ্রী থাকিতে হইবে অথবা স্থাপত্য বিদ্যা পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রী অথবা সম্মানের ডিগ্রীসহ ২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকিতে হইবে’। একই সাথে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ৫নং শর্তে উল্লেখ করা হয়, ক্রমিক ১ থেকে ৭ নম্বর পদ গুলির জন্য লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীকে বাছাই করা হবে।
এসমস্ত শর্তাদি থাকার পরও শেখ কামরুজ্জামান সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) পদে আবেদন করেন। পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, লিখিত পরীক্ষায় পূর্ণমাণ ছিল ১০০। আর নূন্যতম পাস নম্বর ছিল ৩৩। এর মধ্যে শেখকামরুজ্জামান লিখিত পরীক্ষায় ২৪ নম্বর পেয়ে অকৃতকার্য হন তিনি। পরে লিখিত পরীক্ষা বাতিল করে অবৈধ ভাবে মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয় কামরুজ্জামানকে।
মৌখিক পরীক্ষায় কামরুজ্জামানকে সর্বোচ্চ ৬৬ নম্বর দিয়ে কৃতকার্য দেখানো হয়। ৭০% ছাড়পত্রের বিপরীতে তাকে সহকারী প্রকৌশলী পদে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতেবাদ পড়েন লিখিত পরীক্ষায় সাড়ে ৫৫ নম্বর প্রাপ্ত প্রথম স্থানের সুলতান মো. সাজ্জাদ হোসেন, দ্বিতীয় ৪৪ নম্বর প্রাপ্ত মো. কাজেম উদ্দীন সহ অন্যান্য যোগ্য প্রার্থীরা।
পর্যালোচনায় আরও জানা যায়, ওই নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি হিসেবে আরডিএ’র তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব হিসেবে তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন। তাদের বিধিবর্হি ভূত নিয়োগ কার্যের জন্য ২০০৫ সালের ২৭ জুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আকতারুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়।
পরবর্তীতে তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ১৭ জুলাই দুদকের রাজশাহী অঞ্চলের উপ-পরিচালক আব্দুল করিম শাহমখদুম থানায় মামলা করেন। এরপর দীর্ঘ আট বছর তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ১৪ জানুয়ারি দুদকের উপ-পরিচালক ফরিদুর রহমান আরডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রব জোয়ার্দার ও সহকারী প্রকৌশলী শেখ কামরুজ্জানকে অভিযুক্ত করে রাজশাহী বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন।
পরে তিন অভিযুক্ত সুপ্রীম কোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। ওই পিটিশনে তারা চার সপ্তাহের স্টে অর্ডার প্রাপ্ত হন। তবে পরবর্তীতে সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান আর কোনো স্টে অর্ডার পাননি।
ফলে তিনি সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে একটি আপিল করেন যার শুনানি এখন পর্যন্ত হয়নি।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি ইফতেখার আলম (বিশাল) / রাজশাহী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.