আদিবাসীদের অস্তিত্বের জমিন যখন ভূমিদস্যু লুটেরাদের দখলে !

বিশেষ প্রতিনিধি: তুহিন সাহেব (ছদ্মনাম) একজন ব্যবসায়ী ও শৌখিন মানুষ। বিলাসবহুল বাড়ি আছে তার। এর বাইরে রয়েছে  বেশ কয়েকটি নার্সারী। এবার তিনি চান কৃষিভিত্তিক শিল্প নিমার্ণ করবেন। সে লক্ষ্যে তিনি নাটোর শহরতলীর কাছাকাছি একটি জায়গাও পছন্দ করে ফেললেন। জায়গাটি আদিবাসী এক পরিবারের। সেই পরিবারের প্রধান বৃদ্ধ মাকে ধর্ম মা এবং তার সন্তানদের ধর্ম ভাই বলে ঘনিষ্টতা তৈরী করে।
অশিক্ষিত, সহজ সরল  পুরো আদিবাসী পরিবারটার কাছে তিনি বিশ্বস্ত হয়ে উঠেন। পরে ধর্মভাইদের কৃষিফার্মে চাকরি দেওয়ার কথা বলে আদিবাসী পরিবারটির প্রথমে ২৮ শতাংশ জমি নামমাত্র মূল্য  কিনে নেয়। কিন্তু সে টাকাও তিনি পরিশোধ তো করেননি উল্টো আদিবাসী বৃদ্ধ মায়ের নাতির জন্য রাখা ৫ শতাংশ  জমিও তিনি দখল করে নিয়েছেন। এবার জমি কেনার জন্য আইনগত প্রস্তুতি শুরু করলেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানলেন জমিটি স্থানীয় এক আদিবাসীদের। যারা আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর  সদস্য।
তুহিন  সাহেবের আইনজীবী বিষয়টি জানার পর বললেন, এই জমি যেহেতু আদিবাসী নাগরিকের তাই এর ক্রয়প্রক্রিয়া সাধারণ নিয়মে হবে না; বরং এর জন্য আইনে বিশেষ বিধান রয়েছে। তুহিন সাহেব কিছুটা বিচলিত হলেন। এত শখ করেছেন জমিটি কেনার জন্য। তাই তিনি এখন জমিটি প্লট আকারে বাসা তৈরীর জন্য বিক্রির পাঁয়তারা শুরু করে। ইতিমধ্যে আদিবাসী পরিবারটি জানতে পারে তারা প্রতারণার শিকার হয়েছে।
১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে আদিবাসীদের জমি হস্তান্তরের বিশেষ নিয়ম দেয়া হয়েছে। ওই নিয়ম প্রতিপালন না করে কোনো জমি হস্তান্তর করা হলে তা আইনের দৃষ্টিতে বৈধ হস্তান্তর হবে না এবং হস্তান্তরগ্রহীতার পক্ষে কোনো অধিকার তৈরি করবে না। আদিবাসী বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে এবং তাদের সম্পত্তি হস্তান্তরে কী কী বিশেষ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে, আইনে তার বিস্তারিত বণর্না রয়েছে।
নাটোরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আদিবাসীদের ভূমি দখলের ঘটনা ঘটছে। তাদের জীবনে মূল অবলম্বনই হলো ভূমি। আর সেই জমি কিনা দখল হচ্ছে জোরজবরদস্তি করে, জাল দলিল দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে, হত্যা করে ও আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা কখনও কখনও আইনের আশ্রয় নিয়েছে, মামলাও করেছে। দীর্ঘদিন মামলা চালাতে গিয়ে অনেকে নিঃস্বও হয়েছেন।
আদিবাসীদের ভূমি লুটেরারা দখল করে নিচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রধান সমস্যাই এখন ভূমি। তাদের প্রতিদিন প্রতিরাত কাটে একটুকরো ভূমিকে নানা আক্রমণ আর দখল থেকে রক্ষা করার সংগ্রামে।
নাটোরের করোনার সবর্নাশের দিকে যখন গোয়েন্দা, প্রশাসন, সরকার, গণমাধ্যমের দৃষ্টি এই সুযোগে চলছে ভুমি বিক্রির  তৎপরতা। কেউ কি এগিয়ে আসবেন, নিরীহ এই জনগোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য।
নিজভূমিতে আদিবাসীরা পরিণত হয়েছে সংখ্যালঘু, এভাবেই উন্নয়নের নামে রাষ্ট্র আদিবাসীদের নিপীড়ন ও ভূমি হারানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। দেশজুড়ে আদিবাসীদের ‘আনপিপলিং’ করা হচ্ছে; এভাবে চললে বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী মানুষ থাকবে না, সংখ্যালঘু থেকে আদিবাসীরা হয়ে যাবে সংখ্যাশূন্য, তাদের তখন কেবল গবেষণা রিপোর্ট, আর্কাইভ বা প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে পাওয়া যাবে।
আদিবাসীরা গরিব/প্রান্তিক কিন্তু যেখানে তারা বাস করেন সেটা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। আর সেটাই আদিবাসীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখলবাজদের চোখ পড়ে এখানে, তারা তখন দখলের সব আয়োজন অব্যাহত রেখেছে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের জমিজমা প্রতিদিন দখল হয়ে যাচ্ছে সব মিলিয়ে পুরো বাংলাদেশে ভূমি নিয়ে যারপরনাই এক অমানবিক, নিষ্ঠুর আর রক্তাক্ত
অধ্যায় প্রতিনিয়ত রচিত হয়ে চলেছে। এর প্রতিকারের জন্য কেউ নেই, নেই কোনো প্রতিবিধান।
আমরা মনে করেছিলাম, ৫০ বছরে ভূ-রাজনীতির গতিপ্রকৃতি যেমন পাল্টেছে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, মন-রুচিও অনেক অনেক পাল্টেছে, তাই এখন প্রয়োজন আদিবাসীদের জমি সংরক্ষণ আইনের যথাযথা প্রয়োগ।
# আদিবাসীদের জমিজমা হস্তান্তরে বিশেষ নিয়ম:
আইনে আদিবাসীদের জমি হস্তান্তরের বিশেষ নিয়ম দেয়া হয়েছে। ওই নিয়ম প্রতিপালন না করে কোনো জমি হস্তান্তর করা হলে তা আইনের দৃষ্টিতে বৈধ হস্তান্তর হবে না এবং হস্তান্তরগ্রহীতার পক্ষে কোনো অধিকার তৈরি করবে না।।
# আদিবাসীদের সম্পত্তি আদিবাসীদের কাছেই হস্তান্তর করতে হবে:
২২ শ্রেণির উপজাতীয়দের জমিজমা হস্তান্তরের জন্য ১৯৫০ সালের অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-এর ৯৭ ধারায় বলা হয়েছে। ওই ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে কোনো আদিবাসী যদি তার সম্পত্তি অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করতে চায় তাহলে তাকে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত কোনো উপজাতির কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
# আদিবাসী ছাড়া অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করতে চাইলে:
৯৭ ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে যদি কোনো উপজাতি বা আদিবাসী রায়ত তার সম্পত্তি বা সম্পত্তির কোনো অংশ বিক্রি, দান, উইল বা অন্য কোনোভাবে কোনো আদিবাসী বা উপজাতি ছাড়া অন্য কোনো গোত্রের বা শ্রেণির কোনো ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করতে চায় তাহলে ওই আদিবাসী রায়তকে তার সম্পত্তি হস্তান্তরের অনুমতির জন্য রাজস্ব অফিসারের নিকট দরখাস্ত দাখিল করতে হবে। ওই দরখাস্ত পাওয়ার পর রাজস্ব অফিসার ১৯৫০ সালের অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-এর ৯০ ধারা এবং বতর্মানে প্রচলিত ১৯৮৪ সালের ভ‚মি সংস্কার অধ্যাদেশের বিধানাবলি বিবেচনা করে যদি যথাযথ মনে হয় তাহলে রাজস্ব অফিসার ওই আবেদনকারী উপজাতি বা আদিবাসী রায়তকে তার সম্পত্তি হস্তান্তর করার অনুমতি দেবেন।
# হস্তান্তর হতে হবে রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে:
৯৭ ধারার ৪ উপধারায় বলা হয়েছে আদিবাসীদের তার জমি হস্তান্তর করতে হলে রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে করতে হবে। যদি কোনো কারণে জমি রেজিস্ট্রেশনের আগেই কোনো আদিবাসীকে তার জমি হস্তান্তর করতে হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে দলিল মতে এবং হস্তান্তরের শতর্ অনুযায়ী রাজস্ব কমর্কতার্র কাছ থেকে লিখিত সম্মতি গ্রহণ করতে হবে।
# আদিবাসীদের জমি বন্ধকে বিশেষ নিয়ম:
৯৭ ধারার ৫ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো আদিবাসী তার জমি কেবল ‘সম্পূণর্ খাইখালাসি বন্ধক’ হিসাবে হস্তান্তর করতে পারবে।
সম্পূণর্ খাইখালাসি বন্ধকে বন্ধকগ্রহীতাকে সম্পত্তির দখল প্রদান করা হয়, বন্ধকের অথর্ ও তার সুদের পরিবতের্ বন্ধকগ্রহীতা বন্ধক-সম্পত্তির ভাড়া ও লাভগ্রহণ করেন, অথর্ পরিশোধে বন্ধকদাতা কোনো ব্যক্তিগত দায় গ্রহণ করেন না এবং বন্ধকগ্রহীতা সম্পত্তি খালাসের অধিকারহরণ কিংবা বিক্রয়ের মোকদ্দমা করতে পারেন না।
৯৭ ধারার ৬ উপধারায় বলা হয়েছে যে ওই খাইখালাসি বন্ধকের মেয়াদ সবোর্চ্চ ৭ (সাত) বছর পযর্ন্ত হবে এবং তা রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তবে যদি কোনো আদিবাসী কৃষি ঋণ প্রাপ্তির জন্য কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের কাছ থেকে অথবা কোনো সমবায় সমিতির কাছে ঋণ গ্রহণ করতে চান তাহলে উপযুর্ক্ত শতর্ প্রযোজ্য হবে না। অথার্ৎ এ ধরনের আথির্ক প্রতিষ্ঠান বা সমবায় সমিতি থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সম্পূণর্ খাইখালাসি বন্ধক ছাড়াও সম্পত্তি হস্তান্তর আইনে উল্লিখিত অন্য ধরনের বন্ধক রাখা যাবে।
# বিশেষ বিধান লঙ্ঘন করে জমি হস্তান্তরের ফল:
যদি কোনো আদিবাসী অত্র ধারার কোনো বিধান লঙ্ঘন করে সে তার জমি হস্তান্তর করে তাহলে ওই হস্তান্তর ‘বাতিল’ বলে গণ্য হবে। ৯৭ ধারার ৮ উপধারার (এ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যদি কোনো আদিবাসী রায়ত এই ধারার কোনো বিধান লঙ্ঘন করে তার কোনো সম্পত্তি বা সম্পত্তির কোনো অংশ হস্তান্তর করেন তাহলে রাজস্ব অফিসার নিজ উদ্যোগে বা উক্ত বে-আইনি হস্তান্তরের পক্ষে তার বরাবরে পেশকৃত কোনো দরখাস্তের ভিত্তিতে লিখিত আদেশের মাধ্যমে নোটিশ প্রদান করে ওই হস্তান্তরগ্রহীতাকে উচ্ছেদ করে দেবেন। তবে অবশ্যই হস্তান্তরগ্রহীতাকে এইরূপ উচ্ছেদের জন্য কারণ দশাের্নার সুযোগ দিতে হবে।
# আদিবাসীর জমি ফেরত দেয়ার প্রয়োজন হলে:
৯৭ ধারার ৮ উপধারার (বি) অনুচ্ছেদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে রাজস্ব কমর্কতার্ কোনো আদেশ দিলে অথবা কোনো আদিবাসীর জমি ফেরত দেয়ার প্রয়োজন হলে রাজস্ব কমর্কতার্ ওই আদিবাসীকে অথবা তার আইনগত উত্তরাধিকারীকে কিংবা
আমরা এখনো মনে করি বাংলাদেশ একটি বহু জাতির সম্মানজনক অংশীদারিত্বের রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হওয়ার স্বপ্নকে ধারণ করতে সক্ষম হবে।  আমরা চাই দেশে বসবাসকারী সব জাতির সমান মর্যাদার ভিত্তিতে নতুন করে রচিত হোক আগামীর সংবিধান।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ প্রতিনিধি মো. নাসিম উদ্দিন নাসিম। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.