‘ হিন্দু নর-নারীর পাপ মোচনের যে কূপটি রানীশংকৈলে ’


সফিকুল ইসলাম শিল্পী, ঠাকুরগাঁও থেকে: ঠাকুরগাঁয়ের রানীশংকৈলে উপজেলার দেড়’শ বছরের পুরাতন গোরক্ষনাথ মন্দির জেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এখনও আকর্ষনীয়।

মন্দির এলাকায় অবস্থিত বৈচিত্রময় প্রস্তর নির্মিত আশ্চর্য কূপ ও তার পানি মহা পবিত্র জিনিস হিসাবে তাদের কাছে বিবেচিত।

প্রতি বছর এ পবিত্র কূপের পানিতে স্নান করে নিজেরা পুত-পবিত্র হওয়ার জন্য হাজার হাজার নরনারীর আগমন ঘটে।

জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে গোরকই নামে যে গ্রাম সেখানে রানীশংকৈলের ইতিহাসে একটি নাম গোরকই কুপ । হাজার নরনারী পাপ মোচনের পরেও এই কুপের পানি একটুও কমেনা বলে স্থানীয়রা বিটিসি নিউজকে জানিয়েছেন।

আর কুপটির নির্মাণ পদ্ধতিও বৈচিত্রময়। কুপটি পাথর দিয়ে বাধাঁনো যার ফলে স্থায়ীত্ব বেশ মজবুদ।শুধু এ কুপটি দেখার জন্য দূরদুরান্ত থেকে লোকজন চুটে আসে।

এই কুপের আসপাশ জুড়েই রয়েছে বিখ্যাত গোরক্ষনাথ মন্দির। কোনো কোনো ঐতিহাসিক গোরক্ষনাথকে নাথপন্থীদের ধর্মীয় নেতা মীননাথের শিষ্য বলে ধারণা করে থাকেন।

অনেকের মতে, এই গোরক্ষনাথ কোনো ব্যক্তি বিশেষের নাম নয়, গোরক্ষনাথ হলো নাথপন্থি সম্প্রদায়ের গুরুবা যোগীর উপাধি মাত্র। কেননা উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিম কামরূপসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে গোরক্ষনাথের নাম পাওয়া যায়।

এছাড়া নেপালেও বৌদ্ধযোগী হিসেবে একজন গোরক্ষনাথের অস্তিত্বের কথা ইতিহাসে উল্লেখ আছে। কোচবিহার রাজ সরকারের অনুমতিক্রমে খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লাহ আহমদ কর্তৃক সংকলিত ‘‘কোচবিহারের ইতিহাস, প্রথম খন্ড’’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, ‘‘গোরক্ষনাথ কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম না হইয়া নাথপন্থি সম্প্রদায়ের কোন গুরু বা যোগি বিশেষের একটি উপাধি হওয়াই অধিকতর সঙ্গত বলে অনুমতি পান।’’

কিন্তু গোরক্ষনাথ যে ধর্মীয় উপাধি মাত্র এই যুক্তি অনেক পন্ডিত মেনে নেননি। নাথ উপাধি হতে পারে, কিন্তু পুরো গোরক্ষনাথই উপাধি নয়। গোরক্ষনাথ যে একজন ব্যক্তি তাতে বোধহয় কোনো সন্দেহ নেই। ‘মহাযানী’ বৌদ্ধধর্ম পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের মধ্যে বিলীন হওয়ার পর যে সহজিয়া ধর্মমতের উদ্ভব হয় তার সঙ্গে হিন্দু যোগবাদের সংমিশ্রণের ফলে এই নাথধর্মের সৃষ্টি।‘‘বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিবর্তনের ফলে এক নতুন ধর্মের পত্তন হয় এবং সেটাই হচ্ছে মীননাথ প্রবর্তিত নাথ ধর্ম।

নাথপন্থিদের ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে জানা যায় ‘প্রাচীন নাথপন্থিগণের মতে মহাপ্রলয়ের শেষে একমাত্র ‘অলেখ নিরঞ্জন’ই অবশিষ্ট থাকেন এবং সিদ্ধ নাথগুরুগণ নিরঞ্জনের স্বরূপ বলে কথিত হন’। বর্তমানে নাথপন্থি সম্প্রদায়ের আলাদা অস্তিত্ব নেই। পরে নাথ উপাধিধারী ব্যক্তিরা হিন্দু সমাজভুক্ত হয়ে কোনো প্রকারে তাদের প্রাচীন স্মৃতি রক্ষা করছেন মাত্র।

মন্দিরের উত্তর চত্বরে টিনের চাল বিশিষ্ট যে আশ্রম রয়েছে তার দরজায় একটি শিলালিপি বা ফলক ছিল। এই শিলালিপিটি বর্তমানে দিনাজপুর যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। প্রতিদিন বিভিন্ন এরাকার পর্যটকদের গোরক্ষনাথ মন্দিরে আসতে দেখা গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সনাতন ধর্মের লোকেরা প্রতিবছরই মন্দিরের মেলা করেন।

আবার স্থানীয় একজন ভক্তের মতে, এর পেছনে অর্থাৎ উত্তর দিকে পাষাণ বাঁধানো একটি চৌবাচ্চার মতো নিচু স্থানের মধ্যস্থলে বড় বড় কালো পাথরের খন্ড দিয়ে ঘেরা এক অলৌকিক ইদাঁরা বা কূয়ো আছে আর কূয়োর একেবারে নিচু অংশটুকুও পাথর দিয়ে বাঁধানো যার মাঝে একটি ছিদ্র আছে যা দিয়ে নিচ থেকে কুয়োতে পানি আসে।

কূয়োর চারপাশে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে অনেক লোক পূণ্যস্নান করেন। এ সময় হাজার মানুষের স্নানকরার পরেও কুয়োর পানি একেবারেই কমেনা।সে কারনে সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকেরএবং পর্যটকদের উপস্থিতি লক্ষণীয়।

মন্দিরের পিছনে একটি বৈচিত্রময় কূপ রয়েছে। পাথর দিয়ে তৈরী একটি ছোট চৌবাচ্চার মাঝে নীচু স্থানে ঐ কূপটি অবস্থিত। কূপটি বড় বড় কালো পাথরের খন্ড দ্বারা নির্মিত। এ কূপের একেবারে নীচু অংশটুকু পর্যন্ত পাথর দিয়ে বাঁধানো । এই কুপের মাঝখানে আছে একটি ছিদ্র। প্রতি বছরের ১৮ ফাল্গুন এ কূপের পানিতেস্নান উপলক্ষ্যে শীবযাত্রী মেলা বসে। উত্তারাঞ্চলের হাজার হাজার হিন্দু নরনারী পাপ-মোচনের জন্য এই কূপের পানি দিয়ে স্নানের উদ্দেশ্যে এখানে আসে।

কূপের পূর্ব দিকে একটি দরজা ও পশ্চিম দিকে অপর একটি দরজা রয়ছে। ওই দরজা দিয়ে আগতরা কুপের পানি নিয়ে স্নান করে থাকে। পুরষদের পাশাপাশি মহিলারাও শাপ-মোচনের জন্য এ কূপের পানিতে স্নান করে থাকে।

কথিত আছে, গোরক্ষনাথ ছিলেন নাথ পন্থীদের ধর্মীয় নেতা খীননাথের শিষ্য। নবম-দশম শতাব্দির মধ্যে ভাগে গোরক্ষনাথের আভির্ভাব ঘটে। তিনি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এখানে মন্দির স্থাপন করেন।

অলৌকিক ওই কূপটি সেই সময়ে নির্মিত বলে প্রবীনদের লোকদের ধারনা।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি সফিকুল ইসলাম শিল্পী। #

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.