স্বাধীনতার ৫২ বছরেও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ও স্বীকৃতি মেলেনি “রক্তগৌরব”র শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের

রংপুর প্রতিনিধি: আজ ২৮ মার্চ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঁশের লাঠি আর তীর-ধনুক হাতে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করেছিলেন তৎকালীন বীর জনতা। সে সময় পাকিস্তানি সৈনিকদের বুলেটবিদ্ধ হয়ে শত শত লাশ আর রক্তের ঢেউ বয়ে যায় রংপুর ক্যান্টনমেন্ট লাগোয়া ঘাঘটনদীসহ পুরো এলাকা। তবুও লাশের মিছিল বেয়ে হাজারো কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে স্বাধীনতা আনার দৃঢ় প্রত্যয়। সেই দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রতীক হয়ে রংপুর মহানগরীর নিসবেতগঞ্জে দাঁড়িয়ে আছে ‘রক্ত গৌরব’।
ইতিহাস ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে সরেজমিনে জানা যায়,১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর রংপুর শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেপরোয়া মহড়া শুরু হয়। এরই মধ্যে চলতে থাকে জেলার প্রথম সারির আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে ক্যান্টনমেন্ট আর ইপিআর বাহিনীর কিছু বাঙালি সিপাহি ও অফিসারের গোপন যোগাযোগ। একপর্যায়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে অবাঙালি সৈন্যদের বন্দী করে ক্যান্টনমেন্ট দখল করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই পরিকল্পনা ও বাঙালি সৈন্যদের গোপনে সংগঠিত করার গুরু দায়িত্বটি পালন করেন রংপুর ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ এবং ওয়্যারলেস অপারেটর নুরুজ্জামান ও ইপিআর বাহিনীসহ ট্যাংক ডিভিশনের বাঙালি সৈন্যরা।
ধীরে ধীরে রংপুর উত্তপ্ত হতে থাকে। এর আগে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে বিক্ষুব্ধ মানুষের রোষানলে পড়েন তৎকালীন রংপুর ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত অবাঙালি আর্মি অফিসার আব্বাসী ও তার সাথে আরো কয়েকজন সৈনিক। ওই দিন নিসবেতগঞ্জের কাছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আমজাদের বাড়ির কিছু দূরে চৌধুরী বাড়ির একটি নিচু জমিতে জিপ গাড়ি ফেলে দিয়ে আর্মি অফিসার আব্বাসীকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে সাহেদ আলী। এই দুঃসাহসী অভিযানে আরো অংশ নেন আব্দুর রউফ, আব্দুল হান্নান, বাবুল বিশ্বাসসহ আরো অনেক সাহসী সন্তান। এরা আব্বাসীকে হত্যা করার পর অন্য সৈনিকদের কাছ থেকে পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র কেড়ে নেন। এই ঘটনার পর রংপুরে পাকিস্তান সৈন্যরা আরো মরিয়া হয়ে ওঠে। শুরু হয় নির্বিচারে নৃশংস হত্যা। লুণ্ঠিত অস্ত্র ফেরত না দিলে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয় ক্যান্টনমেন্ট থেকে।
এরপর বিকেলে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিক হোসেন, নুরুল হক, এম এন এ শেখ আজমাদ হোসেনসহ আব্দুর রউফের সহযোগিতায় অস্ত্রগুলো উদ্ধার করে ফেরত দেয়া হয়। সেদিন ছিল ২৪ মার্চ রাত। অস্ত্র উদ্ধার করে জমা দেয়ার পর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ক্যান্টনমেন্টের পাশের গ্রাম নিসবেতগঞ্জ, দামোদারপুরে পাকিস্তানের সেনারা লাগাতার হত্যাকাণ্ড শুরু করে। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। একই সাথে ৩২ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পরের দিন জুমার নামাজের সময় লাহিড়ীর হাটের কাছে একটি মাঠে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় এলাকার মানুষ আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিক্ষুব্ধ মানুষকে সংগঠিত করেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিদ্দিক হোসেন (মরহুম), আব্দুল গণি, তৈয়বুর রহমান (মরহুম), মজিবর রহমান, মুকুল মোস্তাফিজ (মরহুম), ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলাম গোলাপ, মুখতার ইলাহী (শহীদ), আব্দুল মান্নান, আবুল মনসুর, ইসহাক চৌধুরী, আব্দুল আউয়াল টুকু, ন্যাপ নেতা শামসুজ্জামান, কমিউনিস্ট নেতা ছয়ের উদ্দিনসহ আরো অনেকে।
রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ওয়্যারলেস অপারেটর নুরুজ্জামান কর্নেল ডা: এম হোসেনের সাথে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের গোপনে খবর দিতেন সব খবর। ট্যাংক ডিভিশন সৈন্যরা ছিলেন প্রায় সবাই বাঙালি। এদের সাথেও গোপন যোগাযোগ ছিল। এসব নিয়ে গোপন বৈঠকে বসতেন রংপুর শহরের কামাল কাছনায় সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম (মরহুম) অ্যাডভোকেট নেছার আহমেদের বাসায় এবং হেলিপ্যাড প্রাইমারি স্কুলে।
ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ২৮ মার্চ যে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করা হবে তা আগে থেকে পরিকল্পিত ছিল না। তবে এতটুকু আলোচনা ছিল যে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করা হবে। বিশেষত সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ ২৮ মার্চ ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ২৬ মার্চ ক্যান্টনমেন্টে খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদার মোল্লা মাস্টার সকালে শেখ আমজাদকে তার বাড়িতে এসে খবর দেন যদি বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে তাহলে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্যাংক ডিভিশন বেরিয়ে এসে অস্ত্রসহ বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ শুরু করবে। এ খবর পেয়ে আরো সাহসী হয়ে ওঠেন গ্রামবাসী।
ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, পাকিস্তানি সৈন্যরা এ খবর পেয়ে বাঙালি সৈন্যদের ২৭ মার্চ রাতে আটক রেখে অস্ত্র জমা নিয়ে রাত ৮টার দিকে ইপিআর ক্যাম্পে হামলা চালায় পাক সেনারা। এ খবর বাইরে আসামাত্রই গ্রামের হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ তীর-ধনুক, বল্লম, দা-কুড়াল আর বাঁশের লাঠি হাতে ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নিসবেতগঞ্জ হাট ও তার আশপাশ এলাকাসহ ঘাঘট নদীর তীর ঘেঁষে জমায়েত হতে থাকে। দুপুর হতে হতেই মিঠাপুকুর, বলদিপুকুর, বদরগঞ্জ, রানীপুকুর, মানজাইল, তামপাট, পালিচড়া, রামজীবন, বনগাঁও, বুড়িরহাট, হারাগাছ, গংগাচড়া, শ্যামপুর, দমদমা, লালবাগ, গনেশপুর, দামোদরপুর, দেওডোবা, পাঠানপাড়া, পাগলাপীর, তারাগঞ্জসহ অন্যান্য এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় জমা হতে থাকে। শুরু হয় সম্মুখ লড়াই।
মিঠাপুকুর অঞ্চলের উপজাতি সাঁওতাল তীরন্দাজ বাহিনী এই আক্রমণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার চেষ্টা করে। এমন সময় বৃষ্টির মতো ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসতে থাকে গুলি। লাশ আর রক্তের ঢেউয়ে ঘাঘট নদীর রঙ পাল্টে যায়। অনেক লাশ পাক সৈন্যরা মাটিতে পুঁতে ফেলে। সবচেয়ে বেশি শহীদের লাশ ক্যান্টনমেন্টের দীঘির পাড়ে পড়ে ছিল। এভাবে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায় রংপুরের মানুষ। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রংপুরের এই ঐতিহাসিক লড়াইয়ের স্থানটি পরিদর্শনে এসেছিলেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী জহুর আহাম্মদ চৌধুরী রংপুর সফরকালে নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমি পরিদর্শন করেন। মাত্র একটি গর্ত খনন করে ৯০টি গালিত লাশ ও কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছিল সে সময়। একই সাথে উদ্ধারকৃত মেয়েদের মাথার চুল, হাতের চুড়ি, ঘড়ি, আংটি, কাপড় ঢাকায় নিয়ে যান তিনি। এলাকাবাসী জানান, নিসবেতগঞ্জ ও সেনানিবাস সংলগ্ন বিশাল এলাকাটি ছিল বধ্যভূমি। এখনো মাটি খুঁড়লে আরো হাড় পাওয়া যাবে। এরপর আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম সিদ্দিক হোসেন স্থানীয় উদ্যোগে একটি ভিত্তি প্রস্তুর স্থাপন করেন। তারপর আর এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে। এর পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়।
ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কমিটির অন্যতম নেতা নাজমুল ইসলাম ডালিম, রফিকুল ইসলাম দুলাল, বেলাল মাস্টারসহ রসিকের হাজিরহাট মেট্রোপলিটন থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম দুলাল বলেন,মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই রংপুরবাসীর অসামান্য বীরত্ব আর ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে দিনটিকে রাষ্ট্রীয় ভাবে পালনের জন্য দীর্ঘদিনের দাবি তাদের।
তবে,আজ সকালে রক্ত গৌরবে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদনের শেষে রংপুরের জেলা প্রশাসক ড.চিত্রলেখা নাজনীন জানায়,দাবি করা হয়েছে তা শীঘ্রই তাদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা সহ স্থানীয় বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের দাবি গুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে কথা বলবেন।
স্বাধীনতার ৩০ বছর পর ১৯৯৯ সালে ‘রক্ত গৌরব’ নামে একটি স্মৃতিসসৌধ স্থাপিত হয়েছে অথচ, দেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে নিসবেতগঞ্জ এলাকার এক বধ্যভূমিতে একটি অংশ খনন করা হলে ৯০টি গলিত মরদেহ পাওয়া যায়। কিন্তু রংপুরের মানুষের সাহস ও আত্মত্যাগের রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পর আজও না মেলার কষ্ট বুকে চেপে স্থানীয়ভাবে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর দিনটি পালন করছে রংপুরবাসী
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর রংপুর প্রতিনিধি এস এম রাফাত হোসেন বাঁধন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.