সভাপতির ক্ষমতার রোসানলে কর্তৃপক্ষ: শাহ্নেয়ামতুল্লাহ কলেজের ৩১৭ জন ডিগ্রী শিক্ষার্থীর ফরমপূরণে অনিশ্চয়তা

বিশেষ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রতিনিধি: চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শাহ নেয়ামতুল্লাহ কলেজের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. সাইদুর রহমানের ক্ষমতার অপব্যবহারের রোসানলে পড়ে কলেজের ৩১৭ জন ডিগ্রী পরীক্ষার্থীর ফরম পুরন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। প্রয়োজনীয় ফি দিয়ে ফরম পুরনের জন্য সকল কাগজপত্র শিক্ষার্থীরা জমা দিলেও কলেজের এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলনে সভাপতি চেকে স্বাক্ষর না করায় এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বোর্ড ফি জমা না দেয়া হলে, এবছর শাহনেয়ামতুল্লাহ কলেজের বিভিন্ন বিভাগের ডিগ্রী পরীক্ষার্থীদের ফরম পুরন হবেনা এবং ওইসব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
কলেজের আভ্যন্তরীন বিষয়কে কেন্দ্র করে সভাপতি মো. সাইদুর রহমান এতগুলো শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন নিয়ে খেলা করছেন বলেও অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
বিষয়টি নিয়ে গভর্নিং বডির অন্যান্য সদস্যদের অবহিত করা হলেও কোন মাথাব্যথা নেই তাঁদের। বার বার বিষয়টি নিয়ে সভাপতির সাথে যোগাযোগ করা হলেও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে বেকায়দায় ফেলার জন্যই ইচ্ছাকৃত ও স্বেচ্ছাচারিতা করে এমনটা করছেন এবং শিক্ষার্থীদের এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নানা টালবাহানা করে বেড়াচ্ছেন সভাপতি বলেও অভিযোগ কলেজ কর্তৃপক্ষের।
জানা গেছে, এবছর শাহ নেয়ামতুল্লাহ কলেজের ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের বি.এ কোর্সে ৮২ জন, বি.এস.এস কোর্সে ১৭৪ জন, বি.এস.সি কোর্সে ৩৩ জন এবং বি.বি.এস কোর্সে ২৮ জনসহ মোট ৩১৭জন শিক্ষার্থী ফরম পুরন করার জন্য কলেজের নিয়ম মোতাবেক শিক্ষার্থীরা ফরম পুরণের টাকা কলেজ এ্যাকাউন্টে জমা দেয় এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ ফরম পুরন করেন। সকল শিক্ষার্থীর টাকা কলেজ এ্যাকাউন্টে জমা হলে সেই টাকা থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত ফি জমা দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা উত্তোলনের জন্য (৩,৬০,০১৪) চেক স্বাক্ষর করে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র স্বাক্ষরের জন্য সভাপতির কাছে পাঠায় কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহা. হাকিকুল ইসলাম। কয়েকদিন থেকেই কলেজের অফিস সহকারীরা স্বাক্ষর করার জন্য ধর্ণা দিলেও এখন নয়, তখন, এখন হবেনা, এখনতো বাইরে আছি, পরে আসতে হবে, আমি এখন ব্যস্ত আছি, এসব নানা টালবাহানা করে শেষ পর্যন্ত চেক এবং অন্যান্য কাগজপত্রে স্বাক্ষর না করেই অজ্ঞাত কারনে তিনি গত ২৯ মে সকালে ঢাকা চলে যান। ফলে আরও জটিলতা সৃষ্টি হয়।
৩১ মে’র/২২ মধ্যে টাকা উত্তোলন না হলে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত দপ্তরে জমা না দিতে পারলে, সকল শিক্ষার্থীর ফরম পুরন স্থগিত থেকে যাবে। এই আশংকায় বার বার সভাপতির সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে সভাপতি একের পর এক অসংলগ্ন ও অযাচিত শর্ত আরোপ করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে। তাঁর এসব অবৈধ এবং অন্যায় শর্তে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রাজি না হওয়ায় সভাপতি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অধ্যক্ষ ও কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের সাথে নানা অত্যাচার ও অসাদাচরন করছেন। বিকল্প উপায়ে কলেজের অন্য এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করে বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্য সভাপতিকে বলা হলেও তিনি সেটাতেও বাধা দেন। ফলে শাহনেয়ামতুল্লাহ কলেজের ডিগ্রী পরীক্ষার্থীদের ফরমপুরনসহ কলেজের অন্যান্য কার্যক্রম চালানো নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা এবং বেকায়দায় পড়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ।
এব্যাপারে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাঃ হাকিকুল ইসলাম বলেন, এবছর শাহ নেয়ামতুল্লাহ কলেজের বিভিন্ন কোর্সে ৩১৭ জন ডিগ্রি পরীক্ষার্থী ফরম পুরণ করে। কলেজের নিয়ম মোতাবেক শিক্ষার্থীরা ফরম পুরণের টাকা কলেজ এ্যাকাউন্টে জমা দেয়। কলেজ এ্যাকাউন্টে জমাকৃত টাকা থেকে ৩ লক্ষ ৬০ হাজার ১৪ টাকা জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের নির্ধারিত ফি জমা দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা উত্তোলনের চেক স্বাক্ষর করে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র স্বাক্ষরের জন্য সভাপতির কাছে পাঠানো হয়। কয়েকদিন থেকেই কলেজের অফিস সহকারীরা স্বাক্ষর করার জন্য ধর্ণা দিলেও নানা টালবাহানা করে শেষ পর্যন্ত চেক এবং অন্যান্য কাগজপত্রে স্বাক্ষর না করেই সভাপতি ঢাকা চলে যান। ফলে জটিলতা সৃষ্টি হয়। টাকা উত্তোলন না হলে সকল শিক্ষার্থীর ফরম পুরন স্থগিত থেকে যাবে এই আশংকায় বার বার সভাপতির সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে সভাপতি একের পর এক অসংলগ্ন ও অযাচিত শর্ত দেন আমাকে।
এছাড়াও সভাপতি সকল কাগজপত্র নিয়ে ঢাকায় পাঠানোর জন্যও বলেন। তাঁর এসব অবৈধ এবং অন্যায় শর্তে রাজি না হওয়ায় সভাপতি ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানাভাবে আমার উপর অত্যাচার ও অসাদাচরন করছেন। বিকল্প উপায়ে কলেজের অন্য এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করে বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্য সভাপতিকে বলা হলেও তিনি সেটাতেও বাধা দিয়েছেন। উনাকে যখনই বলা হচ্ছে, তখনই তিনি আমার উপর দোষ চাপাচ্ছেন।
তিনি বলেন, কলেজের সকল ভালো মন্দের দায়িত্ব আমার উপর। কিন্তু আমাকে জোর করে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়ে সভাপতির মনমতো কাজ করতে বাধ্য করছেন সভাপতি। সভাপতি হওয়ার পর থেকে আমার পূর্বে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকারীদের দিয়ে নিজ পছন্দমত সকল কাজ ও অর্থ খরচ করেছেন, কলেজে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা, সারাদিন বসে থেকে কলেজের অর্থ খচর করে খাওয়া-দাওয়াসহ নিজ প্রয়োজনীয় সকল কাজ সম্পন্ন করেছেন। বলা যায়, অধ্যক্ষকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে নিজেই কলেজ পরিচালনা করেছেন নিজের মতো করে। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না, তাঁর আদেশমত খরচ করাও হচ্ছে না, সময়ে অসময়ে ভুড়িভোজও হচ্ছে না। তাঁর ইচ্ছামত তৈরী বৈধ-অবৈধ কাগজপত্রে স্বাক্ষরও পাচ্ছেন না।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আরও বলেন, সকল দায়িত্ব অধ্যক্ষের, কিন্তু কাজ করাবেন উনার মনমতো। বিষয়টি এমন যেন ‘পরের মাথায় কাঠাল ভেঙ্গে নিজ কাজ সফল করা’। ফলে সভাপতির মাথায় শুধুই এখন ষড়যন্ত্রের জাল বিছানোর ভাবনা। কি করে বিপাকে ফেলা যায় অধ্যক্ষসহ অন্যান্য শিক্ষক-কর্মচারীদের।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারী উনার এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন। আর এই সুযোগ নিয়ে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তাঁর (সভাপতি) নিজ পছন্দমত, যখন যেমন বলবেন, তখন তেমনইভাবে কাজ করতে হবে, সেটা ন্যায় হোক বা অন্যায়, সেটা করানোর চেস্টা করছেন। আমার সাথে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে একটা দ্ব›দ্ব বাঁধানোর ষড়যন্ত্র করছেন। আর আমি তাঁর ইচ্ছামতো না চলায়, বিভিন্নভাবে কলেজের কাজে বাধা সৃষ্টি করেছেন সভাপতি। আমাকে যে কোন উপায়ে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছেন।
কলেজের শিক্ষার্থীদের ফরম পুরনে অর্থ উত্তোলন নিয়ে জটিলতা ও সময়ের মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ফি জমা দেয়ার বিষয়ে শাহনেয়ামতুল্লাহ কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য ডাঃ দুররুল হোদা’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কলেজের শিক্ষার্থীদের ফরমপুরনের অর্থ উত্তোলনে সভাপতির জটিলতা সৃষ্টি বিষয়ে আমার জানা নেই।
সভাপতির সাথে কথা বলে অবশ্যই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কলেজের এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়, এমন কাজ কোনভাবেই মেনে নেয়া যাবে না। এর সমাধান হতেই হবে। প্রয়োজনে নিজের অর্থ দিয়ে হলেও এই সমস্যার সমাধান করবো। শিক্ষার্থীদের এই সমস্যার সমাধান যে ভাবেই হোক আমরা করবো ইনশাল্লাহ বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, সম্ভবতঃ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরমপুরন এর টাকা জমা দেয়ার সময় বাড়িয়েছে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলে জানিয়েছেন কলেজ সভাপতি।
এব্যাপারে কলেজের ডিগ্রি কোর্সের ফরম পুরন আহবায়ক কমিটির আহবায়ক কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান শাহিন কাওসার বলেন, প্রয়োজনীয় কাজগপত্র নিয়ে কলেজের ডিগ্রি কোর্সের শিক্ষার্থীদের ফরম পুরন করা হয়েছে। শুধুমাত্র ফরম পুরন করার দায়িত্ব আহবায়ক কমিটির। আর্থিক জটিলতা নিয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, ফরম পুরনের অর্থের বিষয়টি অধ্যক্ষ ও সভাপতি নিয়ন্ত্রণ করেন। কোন জটিলতা সৃষ্টি করে যদি শিক্ষার্থীদের ফি সময়মত জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ে জমা না দেয়া হয়, তাহলে ফরমপুরনকারী শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারবে না এবং অপুরনীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। কলেজেরও সুনাম নস্ট হবে। শিক্ষার্থীদের দেয়া অর্থ শিক্ষার্থীদের কাজে ব্যয় হবে, এখানে অধ্যক্ষ বা সভাপতি যেই জটিলতার সৃষ্টি করুন না কেন? কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবেনা। অবশ্যই এই জটিলতার সমাধান হওয়া দরকার সময়ের মধ্যেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজ সংশ্লিষ্ট ও শিক্ষানুরাগীরা বলেন, দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠা হওয়া কলেজে অনেক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু বর্তমান সভাপতির মতো এমন স্বেচ্ছাচারী, অর্থলিপ্সু, ষড়যন্ত্রকারী সভাপতি কোনদিনই এই কলেজে আসেন নি। বিতর্কিত এই ব্যক্তি কলেজের সভাপতি হওয়ার পর থেকেই একটার পর একটা সমস্যা সৃষ্টি করেই চলেছেন। আর তাঁর পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত গভর্নিং বডির কোন সদস্যই তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলতে চাইছেন না। আগের গভর্ণিং বডির সদস্যও আছেন বর্তমান কমিটিতে। সবকিছু জেনেও নিজ স্বার্থ জলাঞ্জলি যাওয়ার ভয়ে তাঁরা কোন কথায় বলছেন না।
কলেজের আগের কমিটিতে থেকেও কলেজের অধ্যক্ষ মরহুম আনোয়ারুল ইসলামের সাথে থেকে সকল দূর্ণীতি-অনিয়মের সহায়তা করেছেন, সুবিধাও ভোগ করেছেন, বর্তমান সভাপতিকেও একইভাবে সহযোগিতা করছেন এসব সদস্যরা, সুবিধা ভোগ করার চেষ্টাও চালাচ্ছেন। এসব মানুষ উপরে নীতিকথা বললেও স্বার্থের জন্য সকল অন্যায় কাজ সমর্থণ করে চলেছেন। কলেজের এসব সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, এমনটায় আশা করছেন সচেতন মহল ও কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.