শেষ হলো শারদীয় দুর্গোৎসব তানোরে ৪টি পুজা মন্ডপের প্রতিমা মঙ্গলবারে স্থলে বুধবারে বিসর্জন

বিশেষ প্রতিনিধি: প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় দূর্গা পুজার উৎসব। বৃষ্টি অপেক্ষা করে চারদিকে ঢাকের বাজনার সঙ্গে নাচছিলেন হাজারো মানুষ। কেউ কেউ দেবীর উদ্দেশে দিচ্ছিলেন উলুধ্বনি, আবার কেউ কেউ মায়ের বিসর্জনে অশ্রুসিক্ত। এমন উৎসবমুখর পরিবেশে প্রতিমা বিসর্জন দিয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। এই বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হলো হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় আয়োজন শারদীয় দুর্গোৎসব।

আজ বুধবার ( ৯ই অক্টোবর) ২০১৯ইং বিকেল চারটার দিকে তানোর উপজেলার কেন্দ্রীয় শীবতলা পূজা কমিটি, গোল্লাপাড়া বাজার পুজা কমেটি, গোল্লাপাড়া গোসাই সমাধী সর্বজনীন দূর্গা মন্দির পুজা কমেটি ও কালীগঞ্জ হাট পুজা কমেটি। দশমীর দিন মঙ্গলবার ৮ অক্টোবর তানোর গোল্লাপাড়া ও কালীগঞ্জে হাটবার হওয়ায় তানোর উপজেলার এই ৪টি মন্দিরের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া সম্ভব হয়নি। তার স্থলে বুধবার এই চার পুজা মন্ডপ কমেটির নেতৃত্বে প্রতিমা বিসর্জনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। বিজয়া দশমীর সকালে মণ্ডপে মণ্ডপে সিঁদুর খেলার মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার দর্পণ বিসর্জন দেওয়া হয়। হিন্দু নারীরা দেবীর প্রতিমায় সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে নিজেরাও একে অন্যকে সিঁদুর পরান। এরপর থেকেই বেজে ওঠে বিদায়ের সুর।

বিসর্জনের উদ্দেশ্যে পিকআপ ভ্যানে করে রাজশাহীর তানোর উপজেলার কেন্দ্রীয় শীবতলা মন্দিরের পুজার প্রতিমা ও কালীগঞ্জ হাট মন্দিরের পুজার প্রতিমার শোভাযাত্রা বের হয়ে তানোর শীব নদীতে নিয়ে এসে বিসর্জন দেয়। অপর দিকে গোল্লাপাড়া বাজার পুজার প্রতিমা ও গোল্লাপাড়া গোসাই মন্দির পুজার প্রতিমা স্থানীয় পুকুরে বিসর্জন দেন ভক্তরা। এই বিজয়া শোভাযাত্রায় যোগ দিতে তানোর উপজেলার বিভিন্ন মন্দির ও পূজামণ্ডপ থেকে শোভাযাত্রা গুলো মন্দিরে মন্দিরে এসে জড়ো হয়।

এরপর গান-ঢাকের তালে তালে নাচতে থাকেন সবাই। বুধবার বিকেলে দিকে ২টি শোভাযাত্রা শীব নদীর উদ্দেশে রওনা হয়। আর একই সময়ে ২টি শোভাযাত্রা স্থানীয় পুকুরে দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে প্রতিমা নিয়ে ঢাকের তালের পাশাপাশি বলো ‘দুর্গা মা-ই কি, জয়’ স্লোগান দিতে দিতে স্বস্ব স্থানের দিকে এগিয়ে যান বিভিন্ন বয়সী ও শ্রেণী পেশার মানুষ।

প্রতিমা বহনকারী হাজারো দর্শক বিকেল চারটার মধ্যেই শীব নদীতে ও স্থানীয় পুকুরে এসে জমা হয়। এরপর পিকাব ভ্যান থেকে একে একে নদীর ঘাটে ও পুকুরে নিয়ে যাওয়া হয় প্রতিমা গুলো। প্রতিমা বিসর্জনের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী চারদিকে জল ছিটিয়ে এবং আরও অন্যান্য নিয়ম-রীতি মেনে কাঁধে করে প্রতিমা নৌকায় তোলা হয়। নৌকায় করে প্রতিমা মাঝ নদীতে ও পুকুরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনের সময় ঘাটে দাঁড়ানো হাজারো ভক্ত দেবী দুর্গার উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে নানা ধ্বনি দিতে থাকেন।

প্রতিমা বিসর্জনের বিষয়ে তানোর উপজেলা শীবতলা কেন্দ্রীয় মন্দিরের শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপনের পুরোহিত ওয়াসিম কুমার ক্রান্তি বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে স্বর্গলোক কৈলাস ছেড়ে মা’দূর্গা কন্যারূপে পৃথিবীতে আসেন। মা’ তার চার সন্তান লক্ষী, কার্তিক, সরস্বতী আর গণেশকে নিয়ে নির্দিষ্ট তিথি পর্যন্ত বাবার বাড়িতে অবস্থানের পর আবারও ফিরে যান দেবালয়ে। দেবীর অবস্থানকালে এই পাঁচদিন পৃথিবীর ভক্তরা ‘দেবী মা’-এর বন্দনা করেন।

এ বিষয়ে গোল্লাপাড়া গোসাই সমাধী সর্বজনীন দূর্গা মন্দির পুজা কমেটির সাধারণ সম্পাদক শ্রী. বিশ্বনাথ দাস বিটিসি নিউজকে জানান, আমরা এবার সাত্বিক পূজা করেছি। যে কারণে কোনো ধরনের মাদকের কোনো ছোঁয়া ছিল না পূজায়। ওই পূজা যারা করে তারা হলো তামসিক পূজা করে। সেখানে সব নারীকে মা ও বোনের চোখে দেখা হয় না

। কিন্তু সাত্বিক পূজার ক্ষেত্রে এই যে এখানে যেসব নারীরা গান বা ঢাকের তালে নাচছে তাদের আমরা মা ও বোনের চোখে দেখি। এ কারণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই তাতে। আর আমরা আগামীর দিনগুলো যেনো সবার জীবনে সুষ্ঠু ভাবে কাটে সে প্রার্থনা মা’দুর্গার কাছে বিশেষ ভাবে করেছি। তাছাড়া এই ধরনের পূজায় নিজস্ব বলে কোনো বিষয় নেই।

বিসর্জন যাত্রায় তানোর হিন্দুপাড়ার শ্রী. বিনয় কুমার দাস বিটিসি নিউজকে বলেন, মা চলে যাচ্ছেন এটা যেমন আনন্দের বিষয় তেমনি কষ্টেরও। আনন্দের কারণ মা’র কারণে অনেক আশির্বাদ পেয়েছি নিজের ও সবার জন্য। আর মা দুর্গা চলে যাওয়ার মাধ্যমে ত্যাগের শিক্ষায় শিক্ষিত করে দিয়ে গেছেন আমাদেরকে। তাই আমরা হাসিমুখে আনন্দযাত্রার মাধ্যমে মাকে বিদায় দিচ্ছি।

ভক্ত শুভ্রত সরকার বলেন, মন ভালো নেই’ মা আসলেন, আবার দ্রুত চলে গেলেন। মায়ের জন্য খুব খারাপ লাগছে, আবার এক বছর পর দেখা মিলবে মায়ের।

প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন তানোর উপজেলা কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদ। এছাড়াও পূজা উদযাপন কমিটির নেতারা জানান, দর্পণ বিসর্জনের মাধ্যমে মূলত শুক্রবার দশমির দিন সকালেই দেবীর শাস্ত্রীয় বিসর্জন সম্পন্ন হয়। শনিবারে শুধু আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রা সহকারে দেবী দুর্গা ও অন্যান্য দেব-দেবীর বিসর্জন দেয়া হয়েছে।

উল্ল্যেখ্য: বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্যমতে এ বার দুর্গাপুজো হচ্ছে ৩১ হাজার ৩৯৮টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম বার পুজো হচ্ছে  ৪৮৩টিতে?  সব মিলিয়ে বিভিন্ন বিভাগে এ বার পুজোর মন্ডব ছিল, ঢাকা বিভাগে ৭,২৭১টি, চট্টগ্রামে ৪,৪৫৬টি, সিলেটে ২,৫৪৫টি, খুলনায় ৪,৯৩৬টি, রাজশাহীতে ৩,৫১২টি, রংপুরে ৫,৩০৫টি, বরিশালে ১,৭৮১টি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১,৬৩২টি। এর বাইরে পারিবারিক পুজোও রয়েছে কয়েক হাজার।

রাজধানীর ঢাকা মহানগরীর ২৩৪টি মণ্ডপের মধ্যে ৯টি ছিল সবচেয়ে বড় মণ্ডপ। এগুলো হলো- ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মঠ, কলাবাগান পূজামণ্ডপ, বনানীর মণ্ডপ, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, রমনা কালীমন্দির, উত্তরা সার্বজনীন পূজামণ্ডপ, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট সনাতন সমাজকল্যাণ সংঘ ও বসুন্ধরা সার্বজনীন পূজামণ্ডপ।

এ বার ২০১৯ সালে পুজোর সংখ্যা কেন বেড়েছে? বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলনকান্তি দত্তর যুক্তি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক সরকার সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়ে উৎসবে নিরাপত্তার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এটা তারই ফলশ্রুতি। তাঁর কথায়, শেখ হাসিনা সরকার মৌলবাদী জঙ্গিদের উচ্ছেদে যে ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েছেন, তার ফলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির যেমন উন্নতি হয়েছে, সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভাল হয়েছে। জঙ্গি হামলার শঙ্কা এখন অনেকটাই কমেছে, নেই বল্লেই চলে। তার পরেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি পুজো মণ্ডপে কঠোর পুলিশি পাহারার নির্দেশ দিয়েছেন। পুজো কমিটিগুলিকে কিছু আর্থিক সাহায্যও দিচ্ছে সরকার।

এ বিষয়ে তানোর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খায়রুল ইসলাম বিটিসি নিউজকে জানিয়েছেন, শারদীয় দূর্গা উৎসবে সারা দেশের আইনশৃংখলা বাহিনীর মতো আমরাও নাশকতার কোন আশঙ্কায় করিনি। তার পরেও যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের প্রশাসনের সকল সরকারি, আধা-সরকারী ও সায়ত্তশাসিত বাহিনী সদাসর্বদায় প্রস্তুত ছিল। তিনি আরো জানান, রাজশাহীর তানোর উপজেলায় ছোট বড় মিলে ৫৯টি পুজা মণ্ডপ ছিল। মঙ্গলবার দশমির দিন ৫৫টি মন্দিরের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। তবে শুক্রবার তানোর ও কালীগঞ্জে হটাবার হবার কারনে তানোর সদরের শিবতলা কেন্দ্রীয় মন্দির, গোল্লাপাড়া বাজার মন্দির, গোল্লাপাড়া গোসাই মন্দির ও কালীগঞ্জ হাট মন্দিরের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া সম্ভব হয়নি। তার স্থলে বুধবার ৯ই অক্টোবর ২০১৯ইং বিকেলে শান্তি পূর্ণ ভাবে বাকি প্রতিমা ৪টি তানোর শীবনদী ও স্থানীয় পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ প্রতিনিধি রুহুল আমীন খন্দকার। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.