রাবি প্রতিষ্ঠাতা জননেতা মাদার বখশ্ এর ৫৬তম মৃত্যুবার্ষিকী শুক্রবার


প্রেস বিজ্ঞপ্তি: আগামী শুক্রবার (২০ জানুয়ারি) অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদ সদস্য, মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্রতিষ্ঠাতা জননেতা মাদার বখশ্ এর ৫৬তম মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯৬৭ সালের এই দিনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করেছে রাজশাহী প্রেসক্লাব ও জননেতা আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদ।
কর্মসূচীর অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার (১৮ জানুয়ারি) সংগঠন দুটির উদ্যোগে নগরীর প্রায় ৫০ পরিবারের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী প্রেসক্লাব ও জননেতা আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদ সাইদুর রহমান।
কর্মসূচিতে সংগঠন দুটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. আসলাম-উদ-দৌলা, রাজশাহী প্রেসক্লাবের সহঃ সভাপতি আবু সালেহ মোহাম্মদ ফাত্তাহ, জননেতা আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদের সহঃ সভাপতি সালাউদ্দিন মিন্টু, প্রচার সম্পাদক সাংবাদিক আমানুল্লাহ আমানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া শুক্রবার (২০ জানুয়ারি) বেলা ৩টায় নগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্ট রাজশাহী প্রেসক্লাব চত্বরে এক স্মরণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিশিষ্ট কলামিস্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবু প্রশান্ত কুমার সাহা। এতে বিশিষ্টজনরা বক্তব্য রাখবেন।
উল্লেখ্য, মাদার বখশ ১৯০৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রাজশাহী জেলার নাটোর মহাকুমার (বর্তমানে জেলা) সিংড়া থানার স্থাপনদিঘি নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাজশাহীর গণমানুষের পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। দেশ নন্দিত সমাজসেবক ও উত্তরাঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম অগ্রদূত তিনি।
মাদার বখশ ১৯২২ সালে সিংড়ার চৌগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯২৪ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯২৬ সালে বিএ পাস করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে ইতিহাসে এমএ এবং কলকাতা রিপন কলেজ থেকে ১৯২৯ সালে বিএল সম্পন্ন করেন।
বৃহত্তর রাজশাহীর নওগাঁ জেলার পোরসার হাই মাদরাসায় এবং মুর্শিদাবাদের সালার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন তিনি। মাত্র দু’বছরের শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে তিনি ১৯৩৪ সালে রাজশাহী জজকোর্টে আইন পেশায় যোগ দেন। দরিদ্র বিচার প্রার্থীদের তিনি স্বল্প পয়সায় এবং কখনও বিনা পায়সায় আইনি সহায়তা দিতেন।
‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড এ ব্রত্যকে সামনে নিয়ে মাদার বখশ উত্তরবঙ্গের অবহেলিত-বঞ্চিত পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর মাঝে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছেন। ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি ৬ ভূবন মোহন পার্কে আরও একটি জনসভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে মাদার বখশ সরকারকে হুশিয়ার করে বলেছিলেন, ‘যদি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা না হয়, তবে উত্তরবঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবি করতে আমরা বাধ্য হব।’
মাদার বখশের এ বক্তব্যে সাড়া পড়ে দেশের সুধী মহলে। টনক নড়ে সরকারেরও। অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাস হয়। মাদার বখশের একান্ত প্রচেষ্টা আর অধিকার আদায়ে দৃঢ়তার কারণে ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তিনি রাজশাহীতে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
রাজশাহী কোর্ট একাডেমি (১৯৫৪ সালে সোবহানিয়া হাই স্কুল নামে প্রতিষ্ঠিত হয়) তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। লক্ষীপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় মাদার বখশের প্রচেষ্টাতেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৬০ সালে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর রাজশাহী মুসলিম হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এ স্কুল প্রতিষ্ঠায় তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজও স্থাপিত হয় মাদার বখশের অবদানে।
শিক্ষানুরাগী মাদার বখশ রাজশাহীতে একটি মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তাব করেছিলেন। তারই ফলশ্রæতিতে ১৯৪৯ সালে সর্বপ্রথম চিকিৎসা সেবাদানের নিমিত্তে একটি প্রাইভেট মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহীতে। এ স্কুলটি সরকার ১৯৫৫ সালে গ্রহণ করে।
এরপর ১৯৫৮ সালে এটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি তিনি সমাজসেবায়ও অনন্য অবদান রেখে গেছেন। মাদার বখশ ১৯৫০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৪ সালের ২২ জুন পর্যন্ত রাজশাহী পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আমলেই তৎকালীন রাজশাহী পৌর এলাকায় ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। মাদার বখশ তার সুষম উন্নয়ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে জনগণের ভালোবাসা অর্জন করেন। তিনিই রাজশাহী নিউ মার্কেটের রূপকার।
মাদার বখশ ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী নিউমার্কেট নির্মাণে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে সর্বপ্রথম রাজশাহী শহরে রিকশা চালু করেন এবং তিনিই প্রথম সুইপারদের রেশন ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। শাহ মখদুম ইনস্টিটিউট, মুসলিম গোরস্থান কমিটি, রিফ্যুজিদের বাসস্থান ব্যবস্থা, পদ্মার বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি উন্নয়ন কাজে মাদার বখশের অবদান জড়িয়ে আছে।
১৯৪৬ সালে তিনি আত্রাই, বাগমারা ও মান্দা থানা নির্বাচনী এলাকা থেকে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ আইন সভার সদস্য ছিলেন। ওই সময়ে সরকার উত্তরাঞ্চলের মানুষের প্রতি চরম বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরণ করতে থাকে।
এরই প্রতিবাদে মাদার বখশ প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেন। সততা, নিষ্ঠা, প্রতিভা আর মেধা দিয়ে তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দূরবস্থা দূরীকরণের লক্ষ্য নিয়ে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেন। অন্যায়-অবিচারের প্রতি সর্বদা সোচ্চার মাদার বখশ বিশিষ্ট রাজনীতিক সমাজসেবক হাজী লাল মোহাম্মদ সরদার এবং আইনবিদ খান বাহাদুর এমাদউদ্দিদের মৃত্যুও পরে তাদের শূন্যস্থান পূরণ করতে সক্ষম হন। নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা বলে তিনি মুসলিম লীগের একজন অন্যতম নীতিনির্ধারক হন।
নিরলস শ্রম সাধনা ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে তিনি জাতীয় জীবনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। ভাষা আন্দোলনের সময়েও মাদার বখশের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। তিনি তৎকালিন ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘যদি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া না হয়, তবে আমি আইন পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করব।’ ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় রফিক, সালাম, জব্বার নিহত হওয়ার পর মাদার বখশ এক সমাবেশে বলেছিলেন, ‘খুনী নূরুল আমিন সরকারের আইন পরিষদের একজন সদস্য হিসেবে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।’ তখন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা হয়েও মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুরে কথা বলা এবং ঘাতক নূরুল আমিনের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে সাহসিকতা ও সততা দেখিয়েছিলেন। আর এ কারণে মাত্র কয়েক দিন পর রাজশাহীর সংগ্রামী ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তিনিও কারারুদ্ধ হন। মাদার বখশ চির জাগরুক হয়ে থাকবেন রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের কাছে।
বার্তা প্রেরক আমানুল্লাহ আমান, প্রচার সম্পাদক, জননেতা আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদ, সদস্য, রাজশাহী প্রেসক্লাব। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.