রাবি’র ক্যাম্পাস : মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি!

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি: করোনার এ দিনগুলোতে রাবির সবুজ ক্যাম্পাস দিন দিন যেন আরো ঝলমলে ও সবুজ হয়ে উঠছে। সবুজ কচি-কাঁচা পাতায় মোড়ানো দেবদারু গাছগুলো যেন রাজবাড়ীর দারোয়ানের মতো নিরবে-নিশব্দে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।  একদিকে যেমন বর্ষার পানি অন্যদিকে তেমনি মেঘ-সুর্য্যরে রোদ্রের মাখামাখিতে এদের খাবার-দাবার তৈরীতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। সোনালু, রঙ্গন, বকুল, জারুল, মহুয়া, কদমসহ নানা গাছ আজ ফুলে ফুলে ভরে আছে। সুনসান এ পরিবেশে এবং মহুয়ার মন মাতানো গন্ধে মৌমাছি, প্রজাপতিদের নাচা নাচি আরো বেড়ে গেছে। আম-কাঠালের রসালো ফলের গন্ধে পাখ-পাখালিদের কলরব, এসো দেখে যাও প্রকৃতি আমাদের জন্য কী সুন্দর খাবারের ব্যবস্থা করেছে। এক কথায় অপরুপ এক পরিবেশ বিরাজ করছে রাবির ক্যাম্পাসে।

এমনিতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সৌর্ন্দযের এক লীলাভূমি। ক্যাম্পাসের গাছপালা ঘেরা রাস্তাগুলো সুনসান ও নিরবতা বিরাজ করলেও পাখির কিচিমিচির আর পাখা ঝাপটানোর শব্দে চলাফেরা করাই দায়। ক্যাম্পাসের জলাশয় গুলোতে নতুন কিছু পাখিদের আনাগুনা বেড়েছে। যা অতীতে কখনও দেখা যায় নি। গত ১৮ই জুন সন্ধ্যার সময় ঝুম বৃষ্টিতে শহীদ হবিবুর রহমান ফুটবল মাঠ প্রায় হাটু পরিমাণ পানি জমে গেল। এরই মধ্যে চিরশত্রু শিয়াল-কুকুরের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল।

বড় বড় কোলা ব্যাঙ ঝোপঝড় থেকে বেরিয়ে এসে পানিতে সাঁতরাতে শুরু করল। আমরাও গাড়ী পর্যন্ত যেতে কাকভেজা হয়ে গেলাম। মাগরিবের আযানের সাথে সাথে একদল শিয়াল দ্বিতীয় বিজ্ঞান ভবনের পেছনের জঙ্গল থেকে বের হয়ে মুয়াজি¦নির সাথে গলা মিলানো শুরু করল। মুয়াজ্জিন বলে, আল্লাহু আকবর–। শিয়াল ডাকে, কি হুয়া–। সে এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা।

অন্যদিকে এর বিপরীত চিত্রে মনটা ভেঙ্গে যায়। ক্যাম্পাসে যারা দোকানপাঠ চালিয়ে, চা-বিস্কুট বিক্রি করে এবং গৃহস্থলীর কাজ করে সংসার চালাতো তাদের দিকে তাকানো যায় না। বন্ধের আগে ক্যাম্পাসে পরিকল্পনাহীন দোকান বা স্থাপনাগুলো ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এ ধরণের একটি ভাঙ্গা স্থাপনায় (দ্বিতীয় বিজ্ঞান ভবনের পশ্চিমে) চা দোকানি আয়নাল মাঝে মাঝে সকালের দিকে এসে উদাস মনে পাশের জলাশয়ের দিকে চেয়ে বসে থাকে। আমি একদিন কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই জিগ্যেস করল, স্যার ক্যাম্পাস কবে খুলবে? আর তো চলতে পারছি না! মনটা খারাপ হয়ে যায়। কারণ এদের একটা রানিং আয় ছিল এসব দোকান থেকে। করোনায় এদের দৈনন্দিন  জীবন ওলট-পালট করে দিয়েছে।

গৃহবন্দী অবস্থার অবসাদ কাটাতে এবং গবেষণার কাজকে চালু রাখতে প্রায় প্রতিদিনই ক্যাম্পাসে আসা হয়। অনেকে এ কাজটি বাড়িতে বসেই করছেন। কিন্তু কেউ মনে শান্তি পাচ্ছেন না। আমরা না পারছি ছাত্র পড়াতে না পারছি গবেষণায় মন বসাতে। দৈনন্দিন জীবন-যাত্রায় আমাদের বিরাট ছন্দ-পতন ঘটেছে। ছাত্রছাত্রীদের কলোরবে যে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত থাকে তা বন্য পাখপাখালিদের দখলে। একই কি বলে পরিবেশের ভারসম্যতা? দিনের বেলায় প্যারিস রোডসহ অন্যান্য জায়গায় কিছু লোকের দেখা মিললেও সন্ধ্যার পর একেবারেই সুনসান হয়ে যায় ক্যাম্পাস। এই সুনাসান জায়গাগুলো আজ কুকুর-শেয়ালদের দখলে। রাবির ক্যাম্পাসে বেশ কিছু বেওয়ারিশ কুকুর আছে। এরা ৫-৬ টা দলে বিভক্ত। একেকটা দলে ৪-৫ টা করে কুকুর আছে।

এদের জোনও আলাদা। কাজলা গেটে, জোহা চত্বরে, স্টেডিয়াম গেট, মেডিক্যাল সেন্টারসহ নানা জায়গায় এদের দলবদ্ধ অবস্থান। ক্লান্ত ও জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে এরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে শুয়ে থাকে। খাদ্যাভাবে এরা এতই দূর্বল যে গাড়ীর আওয়াজে এরা সজাগ হয় না। মানুষের উচ্ছিষ্ট আর দোকানিদের ফেলে দেয়া খাবার খেয়ে এরা ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্ন রাখতো। কিন্তু এখন তাদের দেখার কেউ নেই। শুনেছি এদের জন্য একবেলা করে খাবার দেয়া হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

শরীরে ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য আমার তিন সন্তান প্রতিদিন প্রায় এক ঘন্টা ব্যায়াম করে বাসাতে। কিন্তু এতে তাদের শরীরের চাহিদা মিটলেও মনেরটা মেটে না। তাই প্রায় প্রতিদিন বিকেলে ক্যাম্পাসে এনে ফুটবল মাঠে ছেড়ে দিতে হয়।

চারজনের টিম গঠন করতে মাঝে মাঝে আমাকেও মাঠে নামতে হয়। সুবিধা হলো গাড়ী নিজেই ড্রাইভ করাতে ঘরে এবং বাইরে কোরানটাইন পরিবেশ থাকে। তারপরেও মনে সবসময় একটা আতঙ্ক থাকেই। পরবর্তীতে কে? আমরা এমন এক অজানা শত্রæর বিরুদ্ধে লড়ছি যা সর্বদা পরিবর্তিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আজও আদি করোনার স্বরুপ উদঘাটন করতে পারিনি।

এ দেশের মানুষের ভাতের অভাব, বস্ত্রের অভাব হলেও মা-বাবাকে কখনও অসম্মান করে না, ছেড়ে যায় না। করোনা আমাদের সামাজিক বন্ধনকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছে। আমরা অসুস্থ মা-বাবাকে জঙ্গলে রেখে আসছি, এদরে জানাজায় যেতে পারছি না-এ লজ্জা রাখি কোখায়! আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টির সেরা বানিয়ে কিছু স্বভাবজাত সৌন্দর্য তার মধ্যে দিয়েছে।
এই গুণগুলোর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল লজ্জা। মনে মনে বলি, হে আল্লাহ তুমি আমাদের রক্ষা করো, করোনাকে নিমূল করে দাও, লজ্জার হাত থেকে আমাদেরকে।
লেখক: ড.আসাবুল হক, অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.