রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড, বিভিন্ন কর্মকর্তাকে বিধি-বহির্ভুতভাবে প্রেষণে নিয়োগ, বাড়ছে অনিয়ম-দুর্নীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক:  ১৯৬১ সনের অডিন্যান্স মোতাবেক রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডসহ সকল শিক্ষাবোর্ড স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। তাই বোর্ডের চেয়ারম্যান ব্যতিত অন্য কর্মকর্তাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রেষণে নিয়োগ কিংবা পদায়নের নিয়ম নেই।

আবার ‘বিসিএস রিক্রুটমেন্ট রুল্স-১৯৮১’ অনুযায়ী- শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কেবল তফসীলভুক্ত পদসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা। কিন্তু বোর্ডের সচিবসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ শিক্ষা ক্যাডার থেকে প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং এগুলো তফসীলভুক্ত পদ নয়। অথচ ১৯৯০ সালের পর থেকে এই দুই ধরনের রুল্সকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বোর্ডের সচিবসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রেষণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা হচ্ছে।

এদিকে প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তা বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ পেয়ে শিক্ষাবোর্ডে বিভিন্ন সময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বলে অভিযোগ উঠেছে। তারা নিজেদের আখের গোছাতে বোর্ডের বিভিন্ন কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন।

শুধু তাই নয়; এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বোর্ডে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অবমূল্যায়ন, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের হয়রানি, দুর্ব্যবহার এবং বিভিন্ন বিতর্কিত কাজের মাধ্যমে বোর্ড তথা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র মোতাবেক চেয়ারম্যান ব্যতিত শিক্ষাবোর্ডের অন্য কোনো কর্মকর্তাকে প্রেষণে নিয়োগের আইনগত কোনো সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, কলেজ পরিদর্শক, উপ-পরিচালক (হিসাব ও নীরিক্ষা) এবং বিদ্যালয় পরিদর্শক বোর্ডের কর্মকর্তা পদসমূহে প্রেষণে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।

এদের মধ্যে বর্তমান সচিব অধ্যাপক ড. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন (ইসলামের ইতিহাস বিভাগ) দুই মাস আগে প্রেষণে নিয়োগ পেয়েছেন। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের পদটি বর্তমানে শূন্য। এখানে ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে দেবাশীষ রঞ্জন রায় দায়িত্ব পালন করছেন। কলেজ পরিদর্শক পদে গত বছরের ৩১ জুলাই থেকে অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান, উপ-পরিচালক (হিসাব ও নীরিক্ষা) পদে মো. বাদশা হোসেন (অর্থনীতি) ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে এবং দীর্ঘ ৬ বছর থেকে (৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ থেকে) বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক দেবাশীষ রঞ্জন রায় (ইতিহাস)।

রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত বিধি বহির্ভুত এসব কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের দাবিতে এর আগে শিক্ষা মন্ত্রীর নিকট বোর্ডের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে আবেদন করা হয়েছিল।

লিখিত ওই অভিযোগে বলা হয়, ১৯৬১ সনের অর্ডিন্যান্স (৩৩ নং আদেশ)এর ধারা ১২ (১), ১৪, ১৮ (XI) এবং সরকার ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক বিধি বিধানের ৭ (a) i, ii I iii  নং ধারায় (এস্টাব্লিশমেন্ট ম্যানুয়েল-২০০৯, Vol-2,  পৃষ্ঠা-৭৭৬) এবং সরকার কর্তৃক অনুমোদিত রেগুলেশন নং-SR65 এর ১ ও ২ নং ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, বোর্ড সমূহের চেয়ারম্যান ব্যতিত অন্যান্য সকল কর্মকর্তা বোর্ড কর্তৃক সরাসরি/পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণযোগ্য।

এমনকি Rules of Business-1996 এ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার শুধুমাত্র বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া, অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া নয়।

এছাড়া চলতি বছরের মার্চে রাজশাহী এডভোকেট বার সমিতির সদস্য মো. আবু আসলাম নামে এক আইনজীবী বাদি হয়ে রাজশাহীর সদর সিনিয়র জজ আদালতে প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষাবোর্ডের এসব কর্মকর্তাদের দ্রুত অপসারণ দাবিতে একটি অভিযোগ দায়ের করেন।

রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য কর্মকর্তা প্রেষণে বোর্ড সমূহে নিয়োগ বা পদায়ন দিচ্ছেন যা উল্লেখিত বিধি-বিধানের পরিপন্থি। এর ধরনের বিধি-বিধানের পরিপন্থি কাজ না করার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিভিন্ন সময় পরিপত্র ইস্যু করা হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক তা মানা হচ্ছে না, যা অনভিপ্রেত এবং বোর্ডের কর্মকর্তাদের অধিকারের ব্যত্যয়ও বটে।

কেননা, রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে চেয়ারম্যান ব্যতিত অন্যান্য সে সকল কর্মকর্তা প্রেষণে নিয়োগ/পদায়ন দেয়া হয় তাদের চেয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন লোক বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে এবং তারা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে। তাদেরকেই প্রধানত বোর্ডের সকল কাজ করতে হয়। অথচ বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তাদের কোন কৃতিত্ব দেয়া হয় না এমনকি সৃজনশীল ও গঠনমূলক কাজের সুযোগও দেয়া হয় না। কেউ যদি এমন কাজ করেনও তাকে মূল্যায়নও করা হয় না।

বোর্ডের আরেক কর্মকর্তা তিনিও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তা বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তাদের অবমূল্যায়ন, শিক্ষক, ছাত্র/ছাত্রী, অভিভাবকদের হয়রানি, দুর্ব্যবহার এবং বিভিন্ন সময় বিতর্কিত কাজের কারণে বোর্ড তথা সরকারের ভাবমূতি চরমভাবে ক্ষুণœ হয়।

এসব কর্মকর্তা পরবর্তীতে চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে অসুস্থ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে শিক্ষাবোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত করে শিক্ষাবোর্ডে সুশৃঙ্খল পরিবেশ বিনষ্ট করেন। এমনকি তারা দীর্ঘ দিন এসব পদে অবস্থান করায় বোর্ডে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এজন্য শিক্ষাবোর্ডে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং বিধি মোতাবেক শিক্ষা ক্যাডারদের এসব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার জোর দাবি জানান তারা।

এব্যাপারে জানতে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহা. মোকবুল হোসেনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।

তবে বোর্ডের সচিব অধ্যাপক ড. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় সব দিতে পারে। ওটা দেয়ার সুযোগ আছে।’ কোন নিয়মের ভিত্তিতে সুযোগ আছে বলছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আছে আছে, আপনি ভালো করে দেখেন আছে।’ উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, নির্ধারিত রুল্স আছে বলেই এসব পদে নিয়োগ দিয়েছে, রুল্স না থাকলে দিতে পারে? শুধু এক জায়গায় (শিক্ষাবোর্ড) না সব জায়গায় আছে। গভর্নমেন্ট (সরকার) ইচ্ছা করলে দিতে পারে।’

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি সাইদুর রহমান। #

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.