রাজশাহীতে অতিরিক্ত দামে চারা কিনায় পেঁয়াজের লাভ থেকে বঞ্চিত কৃষকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: চড়া দামে পেঁয়াজ বীজ কিনে চারা করেছিলেন কৃষক। জমিতে সেই চারা রোপণের পর ভাল পেঁয়াজও হয়েছে। রাজশাহীর কৃষকেরা ইতোমধ্যে পেঁয়াজ তুলতে শুরু করেছেন। কিন্তু বাজারে পেঁয়াজের দাম নিয়ে অখুশি কৃষক। বীজ-চারার জন্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পেঁয়াজ বিক্রি করে তাঁদের পোশাচ্ছে না। চাষিরা বলছেন, পেঁয়াজের লাভ চারায় খেয়ে ফেলছে।
বাংলাদেশ পেঁয়াজের উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন নয়। বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয় ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে। গতবছর অক্টোবরে পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়েছিল। আগের বছর একই সময় পেঁয়াজের দাম উঠেছিল ৩০০ টাকা পর্যন্ত। ফলে দেশেই পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে মনোযোগী হয়েছিল কৃষি বিভাগ। লাভের আশায় রাজশাহীর চাষিরা পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকেছিলেন। জমি থেকে পেঁয়াজ উঠছেও। কিন্তু এখন বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করতে গিয়ে তারা হতাশ।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, চলতি ২০২০-২১ মৌসুমে ১৭ হাজার ৯৯৩ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চাষ হয়েছে ১৮ হাজার ২৮৬ হেক্টর জমিতে। এর আগে ২০১৯-২০ মৌসুমে জেলায় ১৬ হাজার ৭৯১ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছিল। সে বছর পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৮২ হাজার ৭৯৯ মেট্রিক টন। এ বছর ফলন ভাল হয়েছে। তাই ৩ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনের আশা করছে কৃষি বিভাগ।
পেঁয়াজ চাষ বাড়াতে গত বছরের সেপ্টেম্বরের দিকে কৃষি কর্মকর্তারা রাজশাহীর গ্রামে গ্রামে গিয়ে চাষিদের সঙ্গে উঠান বৈঠক করেন। বিভিন্ন সমাবেশের মাধ্যমে তাদেরকে পেঁয়াজ চাষে উৎসাহ দেওয়া হয়। ফলে এবার চাষ বেশি হয়। জেলায় পেঁয়াজের চাহিদা ৬০ থেকে ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। এবার প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার টন পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা কৃষি বিভাগের।
উৎপাদন মোটামুটি ভাল হলেও খুশি নন চাষিরা। তারা জানিয়েছেন, আগের বছরের চেয়ে এবার চাষিদের বাড়তি দামে পেঁয়াজ বীজ কিনতে হয়েছিল। ২০১৯ সালেই প্রতি কেজি বীজ ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালে সেই বীজ তাঁদের চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা কেজি দরে কিনতে হয়েছে। বীজ থেকে যে চারা হয়েছে সেই চারাও বিক্রি হয়েছে চার হাজার টাকা মণ দরে। সেই চারা কিনেই তাঁদের চাষাবাদ শুরু করতে হয়েছিল। এখন যে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে তা বিক্রি করতে গিয়ে ভাল দাম পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বাবলু শেখ এবার পেঁয়াজ চাষ করেছেন ১৪ কাঠা জমিতে। জমি বাবলুর নিজের নয়, ইজারা নেয়া। শ্রমিকদের নিয়ে এই জমি থেকে পেঁয়াজ তুলছিলেন বাবলু। তিনি জানালেন, তাঁর জমিতে সাত মণ পেঁয়াজের চারা লেগেছিল। চারা কিনেছিলেন চার হাজার টাকা মণ দরে। বাজারে এখন নতুন পেঁয়াজ ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা মণ। জমিতে তাঁর ৬০ মণ পেঁয়াজ উৎপাদন হলেও লাভ হবে না।
বাবলু বলেন, ‘১০টা লেবার লিয়ি ভোর থিকি পিঁয়াজ তুলা শুরু করিছি। বেলা ১১টা বাজলিই কাম শেষ হোবি। লেবারপ্রতি আবার ২৫০ ট্যাকা গুণতি হোবি। পিঁয়াজ বেচি লাভ হোবি ক্যামনে? সাহার (সার), বিষের খরচ তো বাদই দিনু। ভাবিছুনু লাভ হোবি, কিছুই হোবি ন্যা। আমার মতোন যাঁর জমি ইজারা লিউয়া, তাঁর লাভ হোবি ন্যা। নিজের জমি হোলি খরচ উঠতি পারে।’
চকগুচর নওদাপাড়া গ্রামের কৃষক ওয়াজেদ আলীর জমির খরচ নেই। জামাতার জমি নিয়ে একবিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মুখেও হাসি ফোটেনি।
শ্রমিকদের নিয়ে জমিতে পেঁয়াজ তুলতে তুলতেই ওয়াজেদ আলী বললেন, ‘জাওত (জামাতার) এক বিঘি (বিঘা) জমি আমি লিসি। তাও খরচ তো ৫০ হাজার হয়ি গেল। লাভ আর হোবি কী!’
চকগুচর গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, পেঁয়াজ চাষের জন্য ৯ কাঠা জমিই তিনি ইজারা নিয়েছিলেন আট হাজার টাকায়। সার, কীটনাশক আর শ্রমিক মিলে তার খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা। পেঁয়াজের চারা কিনেছিলেন ১৬ হাজার টাকায়। জাহাঙ্গীর বলেন, প্রতিমণ পেঁয়াজ উৎপাদনেই খরচ পড়েছে কমপক্ষে ১ হাজার ২০০ টাকা। বাজারে মণপ্রতি পেঁয়াজের দাম ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। তাই খরচ উঠেনি। বাড়তি দামে চারা কেনার কারণেই লোকসান হচ্ছে। প্রয়োজনের তাগিদে কিছু পেঁয়াজ তিনি বিক্রি করে দিলেও বাকিটা রেখে দাম বাড়ার অপেক্ষা করছেন। মাসখানের মধ্যে দাম বাড়লে ক্ষতি এড়ানো যাবে।
রাজশাহী মহানগর পাইকারী কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির অধীনে শহরের ২৫টি বাজারের ব্যবসায়ীরা আছেন। সংগঠনের সভাপতি ফাইজুল ইসলাম অত্র প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, আপাতত পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, ‘কেবল তো পেঁয়াজ উঠছে। এখনই খুব বেশি দাম বাড়বে না।’
ফাইজুল ইসলাম বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, তিন হাত ঘুরার পর কাঁচাবাজারে ক্রেতারা পেঁয়াজ কিনতে পারেন। চাষিরা প্রথমে স্থানীয় হাটে পেঁয়াজ বিক্রি করেন। সেই পেঁয়াজ আসে পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছে। পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতারা কিনে সাধারণ ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। রাজশাহীর মাস্টারপাড়া পাইকারী বাজারে নতুন পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা মণ দরে। চাষিরা হাটে যখন এই পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন তখন দাম আরও কম ছিল।
হাটের ক্রেতারাই পাইকারী আড়তে এনে পেঁয়াজ দিয়েছেন। আড়ত থেকে খুচরা বাজারে গিয়ে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে। চাষিরা কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৩ টাকা দরে বিক্রি করেছেন বলেও জানান তিনি। এই দামে পেঁয়াজ বিক্রি নিয়েই লোকসানের কথা জানাচ্ছেন চাষিরা।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কেজেএম আবদুল আউয়াল অত্র বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, ‘এবার লাভের আশায় হাট-বাজার থেকে চাষিরা অতিরিক্ত মূল্যে পেঁয়াজের চারা কিনেছিলেন। কৃষকের বীজতলা থেকেও চড়ামূল্য তারা চারা কেনেন। কিন্তু এখন পেঁয়াজ ওঠার সময় দাম কম। তাই কিছুদিন অপেক্ষা করে পেঁয়াজ বিক্রি করার জন্য আমরা চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছি। আমরা এই পরামর্শই দিয়ে থাকি।’ তিনি বলেন, ‘এবার জমিতে যখন পেঁয়াজ ছিল তখন বৃষ্টি হয়নি। আবহাওয়া ছিল ভাল। তাই বাড়িতে কিছুদিন পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলেও সমস্যা হবে না।’
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মোঃ মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.