রাইসির চীন সফরে কী পেলো ইরান?

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: অতি সম্প্রতি শেষ হয়েছে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির তিন দিনের চীন সফর। তার সফরসঙ্গী ছিলেন অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও পরমাণু বিষয়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তার প্রতিনিধিদলের সদস্য নির্বাচনই ইঙ্গিত দিয়েছিল, দুই দেশের আলোচনায় কী কী ইস্যু প্রাধান্য পাবে। ২০টির মতো চুক্তি হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। আর্থিক মূল্যে তা কমপক্ষে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের। গত ২০ বছরে এই প্রথম কোনো ইরানি প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় সফরে গেলেন চীনে। রাইসির চীন সফর আরো বেশ কিছু কারণে তাৎপর্যপূর্ণ।
ইরানি নীতিনির্ধারকদের মতে, চীনের সঙ্গে করা ২৫ বছরের কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি মোতাবেক ইরান তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুফল ঘরে তুলতে পারছিল না। তাই রাইসি আটঘাট বেঁধে, চীনের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুতি নিয়ে, চীনের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা আদায়ের পরিকল্পনা নিয়ে চীনে যান। এ ছাড়া সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে চীন ক্রমাগত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলেছে। ইরান এতে উদ্বিগ্ন। কৌশলগত চুক্তি করে ‘বন্ধু’ হওয়া চীনের কাছ থেকে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে এই মাখামাখি প্রত্যাশা করেনি ইরান।
এদিকে গত ডিসেম্বরে শি জিনপিং সৌদি আরব সফরে গিয়ে এক যৌথ ঘোষণায় ‘শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি’ চালানোর জন্য ইরানের প্রতি আহ্বান জানান। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি মর্যাদাপূর্ণ নীতি অনুসরণ করতে এবং তাদের নিজস্ব ব্যাপারে নাক না গলানোরও আহ্বান জানানো হয়। এ ঘটনায় বিরক্ত হয় ইরান।
চীনের এ ধরনের কর্মকাণ্ড ও পদক্ষেপে ইরানের মধ্যে সংশয় ও সন্দেহ ছিল, মূলত রাইসি তার সফরের মাধ্যমে এগুলো দূর করতে চেয়েছেন। অন্যদিকে চীনও চেয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় ইস্যুতে তার পররাষ্ট্রনীতি ইরানের কাছে পুরোপুরি মেলে ধরতে। সবকিছু হিসাব করে ইরানের প্রেসিডেন্টকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় রাইসিকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। দুই দেশের পতাকা পাশাপাশি উড়িয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তরে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশেষ সম্মান জানানো হয়েছে রাইসিকে। রাইসির প্রতি বিশেষ সম্মান জানিয়ে চীন দেখাতে চেয়েছে যে, ইরানকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় চীন, মনে করে বন্ধু রাষ্ট্র। বিনিময়ে ইরানের বিশাল মজুতকৃত জ্বালানি তেলের অবিচ্ছিন্ন সরবরাহ চায় চীন। ২০২১ সালে করা অর্থনৈতিক চুক্তির আওতায় চীন দেশটির কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে জ্বালানি তেল কিনছে।
ইরান বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা করে সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, পারমাণবিক কার্যক্রম চালানোর নিশ্চয়তা; সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার অধিকারের ক্ষেত্রে চীনের অকুণ্ঠ সমর্থন।
এ ব্যাপারে শি জিনপিং বলেছেন, ইরানের ওপর থেকে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা যথার্থভাবে বাতিল করতে হবে। ইরানের সঙ্গে পরমাণু আলোচনা পুনরায় শুরু করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চীন গঠনমূলকভাবে অংশ নেবে আলোচনায়। ইরানের  নিজ অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষায় পূর্ণ সমর্থন পাবে চীনের তরফ থেকে। ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ, ইরানের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপের দঢ়ভাবে বিরোধিতা করবে চীন। ইরানের জন্য এ ধরনের নিশ্চয়তা স্বস্তির। শি জিনপিংকে ইরান সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
চীন ও ইরান জোর দিয়ে বলেছে, ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ইরানের অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করা এই চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ইকমার্স, কৃষি, পর্যটন, অটোমোবাইল শিল্প, খনিজ শিল্প, পরিবেশ সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণসহায়তা, প্রযুক্তি আদান-প্রদান, সংস্কৃতি ও খেলাধুলার বিষয়ে ভবিষ্যতে দুই দেশ একত্রে কাজ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, চীনের বেশ কয়েকটি বৃহৎ কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেছেন রাইসি। ক্রুড ওয়েলের বিনিময়ে পণ্য আমদানি, দক্ষিণ ইরানে একটি প্রাকৃতিক গ্যাস প্রকল্পে কাজ করা এবং তেলক্ষেত্রগুলোর উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
ইব্রাহিম রাইসির সফরের আগে চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পিপলস ডেইলিতে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লেখেন শি জিনপিং। সেখানে তিনি বলেন, ইরান ও চীন দুই দেশই মনে করে, আমেরিকার একতরফা ও সহিংস কর্মকাণ্ডের কারণে যেমন—অন্যায্য নিষেধাজ্ঞা, সারা বিশ্বের সংকট ও নিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী। ইরানকে পুরোনো বন্ধু দাবি করে তিনি বলেন, চুক্তির ফলে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বা আঞ্চলিক কারণে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালীকরণের প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। চীন নিরবিচ্ছিন্নভাবে ইরানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা ও দুই দেশের ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্ক অটুট রাখবে।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূরাজনীতি কেন্দ্রের গবেষক বিল ফিগুয়েরোয়া বলেন, রাইসির সফরের মাধ্যমে কোনো অন্তর্নিহিত উপাদানের, যা অর্থবহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক, তার কোনো পরিবর্তন হবে না। তার মতে, এর মধ্যে সবচেয়ে প্রধান হলো নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি। এ ছাড়া ইরানে অস্থিরতা ও আন্দোলন এবং অতীতের মতো ইরানের আইনি ব্যবস্থার কারণে চীনের ব্যবসায়ীদের সমস্যার মুখে পড়ার বিষয়টিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইরানে ব্যাবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগে হুয়াওয়ের মেং ওয়াংজুর গ্রেফতারের পর ব্যবসায়ীরা চীনে বিনিয়োগে একধরনের ভীতি অনুভব করে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান ও উপসাগরীয় দেশগুলো—দুটি পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক ভালো রাখতে চাইছে চীন। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ইরান ও চীন সম্পর্ক একেবারে যে মসৃণ পথে হাঁটবে না, তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.