যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ওপর হুমকি কি বেড়েছে?

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে গত বছরের ৬ জানুয়ারি হামলা চালায় ট্রাম্প সমর্থকরা। ঐ ঘটনার এক বছর পর দেশটির গণতন্ত্রের ওপর হুমকি এখন আরো বেড়েছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত হন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জয়ী হন ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন। কিন্তু নির্বাচনের আগেই ট্রাম্প ফল মানতে অনীহা দেখান। নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তোলেন। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি সামরিক শাসন জারি করতে পারেন—এমন আশঙ্কাও দেখা যায়।
নিয়ম অনুযায়ী ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেসের দুই কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট গণনা করে জো বাইডেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জয়ী ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে চেষ্টা চালান ডোনাল্ড ট্রাম্প। কলেজ ভোট গণনা যাতে না হয়, সেজন্য কয়েক জন রিপাবলিকান নেতা তার পক্ষে কংগ্রেসে আপত্তি জানান। একই দিন ট্রাম্প তার সমর্থকদের ওয়াশিংটনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে বলেন। দিনের শুরুতে হাজার হাজার ট্রাম্প সমর্থক ‘আমেরিকা বাঁচাও’ শীর্ষক বিক্ষোভে অংশ নেয়। ট্রাম্প ওই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। কংগ্রেসে অধিবেশন শুরুর ঘণ্টা খানেক পর ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালায় ট্রাম্প সমর্থকরা।
এ সময় মার্কিন আইনপ্রণেতাদের অনেকেই প্রাণ হারানোর শঙ্কায় পড়েন। সেদিন পুলিশ ও দাঙ্গাকারীদের মধ্যে সহিংসতায় কমপক্ষে পাঁচ জন নিহত হন। ক্যাপিটলে নজিরবিহীন হামলা ও সহিংসতার পর শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এরপর গত বছরের ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা নেন জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ২০০ বছরের বেশি সময়ের ধারাবাহিক গণতন্ত্র নিয়ে গর্ববোধ করে। কিন্তু সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার সমর্থকদের সহিংস আচরণে মার্কিন গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
গত বৃহস্পতিবার ঐ হামলার এক বছর পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ভাষণে তিনি বলেছেন, হামলাকারীরা ঐ দিন যুক্তরাষ্ট্রের গলায় ছুরি ধরেছিল। তার ভাষায়, ঐ দাঙ্গাবাজরা দেশের স্বার্থ নয়, কেবল এক জন ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা করতেই হামলা চালিয়েছিল। বাইডেন জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি মার্কিন গণতন্ত্রকে হত্যা করতে দেবেন না। আর মার্কিনিরা রাজনৈতিক সহিংসতাকে কোনোদিনই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে না।
তবে দ্য গার্ডিয়ানের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ঐ হামলার পর এখন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ওপর হুমকি অনেক বেড়েছে। কোন প্রেক্ষিতে ঐ সহিংস ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল, তার তীব্রতা কেমন ছিল তা অনেকেরই জানা আছে। ইতিমধ্যে ঐ দাঙ্গায় অংশ নেওয়া অনেকেরই বিচার হয়েছে। কিন্তু যারা এই সহিংস দাঙ্গার পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল, উসকানি দিয়েছিল—তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। বরং ক্ষমতা থেকে সরার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরুত্থান হয়েছে। রিপাবলিকান দলে তার প্রভাব আরো পাকাপোক্ত হয়েছে।
তিনি এবং তার মিত্রদের চলতি বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ পরিকল্পনা রয়েছে। রাজ্য আইনসভাগুলো নির্বাচন চুরির মেশিন তৈরি করছে! তাই সংক্ষেপে বলা যায়, ৬ জানুয়ারিতে ঐ ঘটনা শেষ হয়নি বরং শুরু হয়েছে। এখনো বেশির ভাগ রিপাবলিকান বিশ্বাস করেন গত নির্বাচনে তাদের সঙ্গে প্রতারণা হয়েছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, ৬৮ শতাংশ মার্কিনি মনে করেন ২০২০ সালের নির্বাচনে ব্যাপক হারে ভোট জালিয়াতির কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু ৬২ শতাংশ রিপাবলিকান এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। ৬০ শতাংশ মার্কিনির মতে, ক্যাপিটলে হামলার ঘটনায় ট্রাম্পের বড় দায় রয়েছে। কিন্তু ৭২ শতাংশ রিপাবলিকান মনে করেন ট্রাম্পের এক্ষেত্রে সামান্য বা কোনো দায় নেই। আর ৯ শতাংশ মার্কিনি মনে করেন ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে থাকার জন্য বলপ্রয়োগের বিষয়টি যুক্তিযুক্তি ছিল।
রাজনৈতিক এই বিচ্যুতি ঠেকাতে ‘বিল্ড ব্যাক বেটার অ্যাক্ট’ এর প্রচেষ্টা রিপাবলিকানরা আটকে দিয়েছে। ইতিমধ্যে যেসব রিপাবলিকান ৬ জানুয়ারির ঘটনার আগে ট্রাম্পকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন বা ঐ ঘটনার পর ট্রাম্পের সমালোচনা করেছিলেন—তারা আবারও ট্রাম্পের পেছনে ফিরে গেছেন।
কংগ্রেসের সিলেক্ট কমিটির তদন্ত এখন রিপাবলিকানদের বাধার মুখে পড়েছে। সত্যকে আড়াল করার এটি আরেকটি প্রচেষ্টা। কিছু অঙ্গরাজ্যে ভোটগ্রহণের নিয়মে বিধিনিষেধ বেড়েই চলেছে। নির্বাচনি অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড জোরালো হচ্ছে। এসব প্রেক্ষিত বিবেচনায় ভবিষ্যতে আরো রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়তে পারে।
একজন মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, যুক্তরাষ্ট্র গৃহযুদ্ধের খুব কাছাকাছি। আরেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, যুক্তরাষ্ট্রে হাঙ্গেরি স্টাইলের ‘প্রতিযোগিতামূলক কতৃ‌র্ত্ববাদ’ দেখা যেতে পারে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এমনভাবে জালিয়াতি হতে পারে যে—ডেমোক্র্যাটরা জিততে পারবে না। দ্য গার্ডিয়ানের ঐ সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, মার্কিন গণতন্ত্রের ভাঙন হতে পারে রক্তপাতহীন, নীরব এবং আরো বেশি অত্যাধুনিক ও জটিলভাবে।  #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.