মানুষের ক্ষোভের বিষয়টি আমিও বুঝতে পারি : শামীমা বেগম

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুক্তরাজ্য থেকে পালিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দিয়েছিলেন বলে স্বীকার করেছেন শামীমা বেগম।
তিনি বলেছেন, স্কুলে পড়ার সময় পালিয়ে আইএসে  যোগ দেওয়ায় আমার প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বিষয়টিও আমিও বুঝতে পারছি।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই বান্ধবীসহ যুক্তরাজ্য থেকে সিরিয়ায় পাড়ি জমান শামীমা। তারা তিনজনই ছিলেন বাংলাদেশি-অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রিন একাডেমির ছাত্রী। সিরিয়ায় পালিয়ে শামীমা বেগম ডাচ্ বংশোদ্ভূত আইএস জঙ্গি ইয়াগো রিদাইককে বিয়ে করেন।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের এক সাংবাদিক সিরিয়ার একটি শরণার্থীশিবিরে শামীমার সাক্ষাৎ পান। তখন তিনি যুক্তরাজ্যে ফেরার আকুতি জানিয়েছিলেন। এরই মধ্যে নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করে তাঁর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়।
বছর খানেকের বেশি সময় ধরে দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে শামীমা বলেছেন, আইএস সদস্যদের কাছ থেকে তিনি বিস্তারিত নির্দেশনা পেয়েছিলেন। তবে এতে তার নিজেরও কিছু পরিকল্পনা ছিল।
সর্বশেষ বিবিসির পডকাস্টে দেওয়া ‘দ্য শামীমা বেগম স্টোরি’ শীর্ষক এক সাক্ষাৎকারে শামীমা তার সিরিয়া-যাত্রার ঘটনা প্রথমবারের মতো বিস্তারিতভাবে বলেন শামীমা।
তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য ছেড়ে গিয়ে ‘স্বস্তি’ পেয়েছিলেন। যুক্তরাজ্য ত্যাগের পর আর কখনো এ দেশে ফিরবেন না বলে ভেবেছিলেন।
শামীমা বলেন, ‘আমি জানি, এখন মানুষ আমাকে নিজেদের নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার জন্য বিপদ ও ঝুঁকি হিসেবে দেখে। কিন্তু তারা আমাকে যেমনটি মনে করে, আমি তেমনটি নই।’
২০১৯ সালে আইএসের তথাকথিত ‘খেলাফত’ পরাজিত হওয়ার পর সিরিয়ার বিভিন্ন আটক ও আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা হাজারো নারী-পুরুষ, শিশুর মধ্যে শামীমা ছিলেন সবচেয়ে বেশি পরিচিতি। এসব কেন্দ্রে থাকা হাজারো মানুষ এমন সব দেশ থেকে সিরিয়ায় এসেছিলেন, যাদের আর ফেরত নিতে চায় না তাদের দেশ।
২৩ বছর বয়সী শামীমা এখন ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ফিরে পেতে ও লন্ডনে ফিরতে যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন।
শামীমা কি সিরিয়ায় পাচারের শিকার হয়েছিলেন নাকি আইএসের স্বেচ্ছাসেবক হতে দেশ ছেড়েছিলেন, ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে সেই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে।
গণহত্যা, অপহরণ ও শিরশ্ছেদের মতো নৃশংসতার জন্য কুখ্যাত আইএস। ২০১৫ সালে প্যারিসে ও ২০১৬ সালে ব্রাসেলসে হামলার জন্য এই গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীরা দায়ী বলে মনে করা হয়। ২০১৭ সালে লন্ডন ব্রিজ, ম্যানচেস্টার অ্যারেনাসহ যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন স্থানে হামলার দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছে সংগঠনটি।
জনসাধারণ তাকে ‘সম্ভাব্য বিপদ’ হিসেবে ভাবছে, এমনটি উপলব্ধি করেন উল্লেখ করে শামীমা বলেন, তিনি খারাপ মানুষ নন। একই সঙ্গে গণমাধ্যমে তাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তারও তিনি সমালোচনা করেন।
তার প্রতি সমাজের ক্ষোভ রয়েছে, এটা তিনি বুঝতে পারেন কি না, জানতে চাইলে শামীমা বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারি। কিন্তু আমি মনে করি না এ ক্ষোভ আমার প্রতি, এ ক্ষোভ আইএসআইএসের প্রতি।’
শামীমা আরও বলেন, ‘তারা যখনই আইএসআইএস নিয়ে চিন্তা করে, তখন তারা আমার কথা ভাবে। কারণ, গণমাধ্যমে আমাকে খুব বেশি উপস্থাপন করা হয়েছে।’
যুক্তরাজ্যের সাবেক শিশুবিষয়ক মন্ত্রী টিম লংটন বিবিসিকে বলেন, এখনো এটা স্পষ্ট নয়, শামীমা কেন কিশোর বয়সে আইএসে যোগ দিয়েছিলেন বা কোন জিনিস তার মগজধোলাই করেছে, তা পরিষ্কার হওয়া না গেলেও তিনি যখন প্রথম নিখোঁজ হন, তখন জনসাধারণের মধ্যে তার প্রতি যে সহানুভূতি ছিল, ক্রমেই তা ক্রোধে পরিণত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অনেকে এখন মনে করছেন, বোরকা ছেড়ে পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরে তিনি নাটক করছেন।
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘তিনি নিজেকে এই জগাখিচুড়ির মধ্যে ফেলেছিলেন। এ থেকে তিনি কীভাবে বেরিয়ে আসবেন, তা তার ওপর নির্ভর করছে।’
শামীমার স্বীকারোক্তিমতে, বেথনাল গ্রিন থেকে আইএস-অধ্যুষিত সিরিয়ার রাক্কায় যেতে তিনি এবং আরও দুই কিশোরী নিজেরাই নানা বিষয়ে ব্যাপক খোঁজখবর নিয়েছিলেন। পাশাপাশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটির সদস্যরাও তাদের বিস্তৃত নির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করেছিল। অন্য দুই কিশোরীর মধ্যে একজন পরে মারা যায়, আরেকজন সিরিয়াতেই নিহত হন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শামীমা বলেন, ‘অনলাইনে মানুষজন আমাদের অনেক কিছু বলছিল। যেমন কী করতে হবে, কী করা যাবে না—এসব উপদেশ দিচ্ছিল। এর মধ্যে ছিল, ধরা পড়লে কী গল্প ফাঁদতে হবে তা-ও।’
শামীমা আরও বলেন, তারা নিজেরা যেসব বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল ভ্রমণ খরচ আর কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো টুকটাক তুর্কি ভাষা শেখা। আইএস-নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ায় প্রবেশের আগে সীমান্ত পাড়ি দিতে তাঁদের তুর্কি ভাষা জানা দরকার ছিল।
এই তিন তরুণীর পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করা আইনজীবী তাসনিম আকুঞ্জি বলেন, তিন কিশোরী দেশ ছাড়ার পর তিনি তাদের ঘরে রসিদ, ফোন বিল, খুদে বার্তা বা ই-মেইলের খোঁজে তল্লাশি চালিয়েছিলেন।
২০ বছরের অভিজ্ঞ এই ফৌজদারি আইনজীবী বলেন, ‘কিন্তু তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি, এই বয়সী কিশোরীদের ক্ষেত্রে যা অস্বাভাবিক ছিল।
এত অল্প বয়সে তথ্যপ্রমাণ না রাখার এমন দক্ষতা আইনজীবী তাসনিম কখনো দেখেননি। তিনি বলেন, তারা যাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তাদের প্রতি এই কিশোরীদের অগাধ বিশ্বাস ছিল। এ কারণে তাঁদের দেওয়া পরামর্শ সতর্কতার সঙ্গে তারা অনুসরণ করেন।
এই আইনজীবী আরও বলেন, শামীমার ঘরে একটুকরা কাগজ মিলেছিল, যা ছিল বাজারের ফর্দ। সেখানে ৭৫ পাউন্ডে একটি ফোন ও ৪ পাউন্ডে মোজা কেনা এবং ১০০ পাউন্ডের ট্যাক্সিভাড়া দেওয়ার বিষয়টি জানা যায়।
তবে শামীমা দাবি করেন, ওই কাগজ তার নয়। এটি আমিরা ফেলে গিয়েছিলেন। শামীমাসহ যে তিন কিশোরী আইএসে যোগ দিতে একসঙ্গে যুক্তরাজ্য ছেড়েছিলেন, তাদের মধ্যে আমিরাও ছিলেন। শামীমা বলেন, ‘আমরা যে পালিয়ে যাচ্ছি, সে ধরনের কোনো প্রমাণ যাতে না থাকে, তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু একজন বোকামি করল।’
শামীমা আরও বলেন, এ সফরে তারা বেশি জিনিস নিয়ে ব্যাগ ভারি না করার চেষ্টা করেন। অনলাইনে যেসব মানুষের সঙ্গে কথা হতো, তাদের প্রতি ইঙ্গিত করে শামীমা বলেন, ‘তারা বলত, খুব সুন্দর পোশাক নেবেন, যা আপনি আপনার স্বামীর জন্য পরবেন। কিন্তু কেন বলত, আমি জানি না। হয়তোবা তারা আইএস সদস্যদের বিয়ে করার বিষয়টি মাথায় রেখে এমনটা বলত।’
সিরিয়া-যাত্রার সময় শামীমা ৩০টির মতো মিন্ট অ্যায়োরা বার নিয়েছিলেন। শামীমা বলেন, তিনি জানতেন, এগুলো সিরিয়ায় পাওয়া যাবে না।
শামীমার স্কুলের সাবেক এক নারী সহপাঠী তাকে জানান, স্কুলে তিনি খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। চুপচাপ ধরনের মেয়ে ছিলেন। তার বন্ধুর সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা।
আইএসে যোগ দেওয়ার প্রসঙ্গে শামীমা আরও বলেন, ‘আমার পরিবার ভাবত, আমি দুর্বল প্রকৃতির। আমি যে এ ধরনের পাগলামি করতে পারব, এটা তাদের ধারণাতেই ছিল না।’
শামীমা বিবিসিকে বলেন, ‘আমি সব সময়ই নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করি। তাই গণমাধ্যমের কারণে আমার জীবন এখন অনেক কঠিন হয়ে উঠেছে। কেননা, আমি মোটেও মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পছন্দ করা মানুষ নই।’ (সূত্র: বিবিসি)। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.