মাথা উঁচু করা শিক্ষক ছিলেন শহীদ ড. শামসুজ্জোহা

রাবি প্রতিনিধি: রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন, ’চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির/ জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর..’ দিয়ে বেশ কয়েক বছর আগে আনিসুল হক প্রথম আলোতে ’বন্দী, জেগে আছে?’ শিরোনামে একটি লেখা লিখে শিক্ষক সমাজের বিবেককে অল্প হলেও নাড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।
শিক্ষকেরা হলেন জাতির বিবেক। সেই বিবেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবে, খুলে দেবে একেকটা বন্ধ দরজা। কিন্তু বন্ধ দরজায় যদি তালা দেওয়া হয় তাহলে সে বিবেক কথা বলতে পারে না। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, বিবেকের দরজায় তালার সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি তালার সাইজও বাড়ছে।
শিক্ষকেরা এখন জাতির বিবেক না হয়ে নিজেদের বিবেক হয়ে যাচ্ছে। সে বিবেক এতটাই দূর্বল যে একেকটি ধমকেই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা নড়বড়ে বিবেক আবার একত্রিত হয়ে শক্তি অর্জন করে ইচ্ছে মতো অপকর্ম করে যাচ্ছে। কর্তাব্যক্তিদের আবার এসব নড়বড়ে বিবেক খুবই পছন্দের। আর নড়বড়ে বিবেকের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ আদমজী জুটমিলে পরিণত হয়েছে বা হতে যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়, পদ্মা, হলমার্ক, শেয়ারবাজারসহ নানা সংবাদে মনটা যখন ভারাক্রান্ত তখন বছর কয়েক আগে শাহবাগ যেন এক আশার আলো দেখালো। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল শাহবাগের প্রতিবাদী মুখগুলোর দিকে তাকালে বায়ান্ন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবাদী মুখগুলোর যেমন নেই বয়সের ভেদাভেদ, তেমনি নেই শিক্ষিত-অশিক্ষিতের শ্রেণীভেদ। এ যেন এক অভূতময় মিলনমেলা! এখানে দাঁড়ালে ’৬৯-এর পদধ্বনি শোনা যায়। বাতাসে শহীদ ড. জোহার রক্তের গন্ধ পাওয়া যায়। ’৬৯-এর এ মাসেই রচিত হয়েছিল আমাদের ঠিকানা-পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। সেদিনও রাবির ক্যাম্পাসে প্রতিবাদী ছাত্র-শিক্ষকের মোহ-মোহ গানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল। বুলেটের আওয়াজ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল গানের শব্দে।
কবির কথায় ফিরি। চিত্ত যদি ভয়শূন্য হয়, বিবেক যদি অন্যায়ের প্রশ্রয় না দেয় মাথা আপনাআপনিই উঁচু হয়ে যায়। এমনি মাথা উঁচু করা শিক্ষক ছিলেন ড. শহীদ শামসুজ্জোহা।
তিনি ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারীর গণ-আন্দোলনে পাকসেনাদের হাত থেকে তাঁর প্রাণপ্রিয় ছাত্রদের বাঁচাতে নিজে বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বুকে গুলি নিয়েছিলেন ভয়শূন্য চিত্তে। মৃত্যুর একদিন আগে ড. জোহা ছাত্রদের এক প্রতিবাদ সভায় বলেছিলেন, ’কোন ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে।’ তাঁর এই সাহসী উক্তিতেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অগণতান্ত্রিক শক্তি বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সাহসী হয়।
এ মহান শিক্ষকের মৃত্যু দিবসকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর ’শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করে এবং রসায়ন বিভাগ জোহা স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে। বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রতি তেমন কোনো সম্মান প্রদর্শন করা না হলেও রাস্ট্রীয়ভাবে সরকার শহীদ ড. শামসুজ্জোহাকে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য স্বাধীনতা পদক-২০০৮ পুরস্কার প্রদান করে।
শিক্ষকেরা হলেন জাতির মেরুদন্ড। এঁরা চিত্তের স্বাধীনতা বজায় রেখে মাথা উঁচু করে কথা বলবেন এটা যেমন জাতি প্রত্যাশা করে, তেমনি অপছন্দ করে কারো চিত্ত দুর্নীতি বা অন্যায়ের কাছে পরাস্ত হলে অথবা পকেটে ঢুকে গেলে। কিন্তু বর্তমানে পকেটে ঢুকে যাওয়া বা পেটকাটা শিক্ষকের সংখ্যা এতটাই বেড়ে গেছে মেরুদন্ড আর সোজা থাকছে না।
আমরা যারা শিক্ষিত সমাজ বলে দাবিদার, আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে, প্রকৃতপক্ষে আমরা শিক্ষিত হতে পেরেছি, নাকি শিক্ষার আড়ালে ভন্ডামি-গুন্ডামি-মাস্তানি করে যাচ্ছি। আমাদের চরিত্র, ভাষা, আচার-আচরণ এবং চলাফেরা দিনের পর দিন যেন আরও হিংস্র ও বন্য টাইপের হয়ে যাচ্ছে।
গ্রাম এলাকায় গাজী খেলা নামে একটি খেলা আছে। খেলাটিতে মাটির ওপর অনেকগুলো ঘর এবং মাঝদিয়ে লম্বা একটি রেখা টানতে হয়। লম্বা রেখাকে শির বলা হয়। প্রতিটি দাগে একজন করে খেলোয়াড় দাঁড়িয়ে বাঁধা তৈরী করে, আর অন্য গ্রুপের খেলোয়াড়রা সে সব বাঁধা পেরিয়ে মূল ঘরে ফিরে আসলে এক গাজী হয়। গাজী খেলায় যখন খেলোয়াড়ের সংখ্যা বিজোড় হয় তখন একজনকে উভয় দলের হয়ে খেলতে হয়।
সবাই তাকে ’পেটকাটা খেলোয়াড়’ বলে। পেটকাটা খেলোয়াড়ের সুবিধে হলো দরোয়ানের মত পরাজিত দলের খেলোয়াড় হয়ে পাহারা দিতে হয় না, সে সব সময় জয়ী দলের হয়ে খেলে। জয়ী দলের হয়ে খেলা যে কত সুবিধে তা শুধু পেটকাটা খেলোয়াড় কেন আমাদের মন্ত্রী-এমপি-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে গ্রামের চৌকিদার পর্যন্ত বোঝে।
ড. জোহা এসবের উর্ধ্বে ছিলেন বলেই এখনও দল-বল নির্বিশেষে সবাই তাকে স্মরণ করে, হয়তো যুগ যুগ এ ধারা অব্যাহত থাকবে। তাই তো ১৮ই ফেব্রুয়ারীকে ’জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়েছিলেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধাক্ষ্য প্রফেসর ড. মোঃ ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস (প্রথম আলো ১৮ ফেব্রয়ারী, ২০০৮)। আমি মনে করি তাঁর এ আবেদন যথাযথ এবং সময়পোযগী। কারণ ড. জোহার আত্মত্যাগে কীভাবে বেগবান হয়েছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে অনেক আন্দোলন তা তুলে ধরা হয়েছে প্রফেসর সাইদুর রহমান খান স্যারের লেখাতে (যুগান্তর, ১৪ মার্চ ২০০৮)।
আমরা যতদূর জানতে পেরেছিলাম, কুদ্রতি-খোদা কমিশনে জাতীয় পর্যায়ে একটি দিবসকে ’জাতীয় শিক্ষক দিবস’ করার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু বর্তমানে যে শিক্ষানীতি চালু আছে সেখানেও এ ধরণের কোনো দিবস রাখা হয় নি, যা দুঃখজনক। যেহেতু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যু দিবস ১৮ ফেব্রুয়ারীকে ’শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। কাজেই এ দিবসটিকে ’জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হলে জাতি আনন্দে চিত্তে তা গ্রহণ করবে বলে বিশ্বাস করি। তাও যদি সম্ভব না হয় তবে ১৮ ফেব্রুয়ারিকে ’শিক্ষক দিবস’ হিসেবে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় পালন করার নির্দেশ দিতে পারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
পরিশষে বলতে চাই, যেহেতু রাস্ট্রীয়ভাবে ড. শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগকে মূল্যায়ন করা হয়েছে স্বাধীনতা পদক-২০০৮ প্রদান করে। তাই আমরা মনে করি, সরকার কোনো দাবির অপেক্ষা না করে ১৮ ফেব্রুয়ারীকে ’জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করবে। আমরা সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকলাম।
লেখক অধ্যাপক আসাবুল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর রাবি প্রতিনিধি মো: মুজাহিদ হোসেন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.