ময়মনসিংহের গৌরীপুরে ঐতিহাসিক ভবানীপুর জমিদারির ইতিকথা
বিশেষ (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি: কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুরের ভবানীপুর জমিদার বাড়ি। তবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে ঐতিহাসিক গ্রাম ভবানীপুর। এই গ্রামের সঙ্গে মিশে আছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি।
বোকাইনগর বাসাবাড়ির জমিদার লক্ষীনারায়ণ চৌধুরীর স্ত্রী ভবানী দেবীর নামে স্থানটির নাম হয় ভবানীপুর। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হওয়ার পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে তারা সবকিছু ফেলে কলকাতায় চলে যান। জমিদাররা বাড়িগুলো ফেলে যাওয়ার পর এগুলোর মালিকানা বদল হয়। পরে পাকিস্তান আমলে এই বাড়িগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছিল।
তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায় – মাঠ, পুকুর, ভিটা এখনো সেই স্মৃতি বহণ করে চলছে। তাছাড়া ময়মনসিংহ শহরে সতীশ লজ ও সতীশ ভিলা নামে দুটি বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। সতীশ লজ এখন এটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ময়মনসিংহ মহানগর ইউনিট কমান্ড অফিস ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভবানীপুর জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা ভৈরব চন্দ্র চৌধুরী:
বোকাইনগর বাসাবাড়ির জমিদার রুদ্র চন্দ্র চৌধুরীর দ্বিতীয় ছেলে ভৈরব চন্দ্র চৌধুরী বাবার মৃত্যুর পর বড় ভাই হর চন্দ্র চৌধুরী থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ায় এক আনা ছয় গন্ডা দুই কড়া দুই ক্রান্তি অংশের মালিক হন। বাসাবাড়ির পাশে যে অংশ তার বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট ছিল, তা অগুনে পুড়ে গেলে তিনি বাসাবাড়ি ছেড়ে বাংলা ১২৫৫ (ইংরেজি ১৮৪৯) সালে ভবানীপুর গ্রামে নূতন বাসভবন নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন।
বাসাবাড়ি থেকে পাঁচশ মিটার পশ্চিমে ভবানীপুর গ্রাম। ভবানীপুর জমিদার বাড়ির ইতিহাস জানতে গেলে ওঠে আসে বোকাইনগর বাসাবাড়ির জমিদার পরিবারের কথা। ভৈরব চন্দ্র চৌধুরীই ভবানীপুর জমিদারির গোড়াপত্তন করেন। তিনি জমিদারি পরিচালনায় নিপুণ ছিলেন। বুদ্ধি, চাতুর্য বা চাতুরী ও নীতি- কৌশলে তিনি নিজের বিষয়-সম্পত্তিতে উন্নতি করেছিলেন। তাই তার বড়ভাই হরচন্দ্র চৌধুরী থেকে তিনি ভিন্ন ছিলেন।
তিনি সাধারণ শিক্ষায় ও এলাকার উন্নতির জন্য অনেক অর্থ সহায়তা করতেন। জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্র কিশোর রায়চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ বইয়ে ভবানীপুর জমিদার বাড়ির সংক্ষিপ্ত বিবরণের কথা উল্লেখ রয়েছে।
জমিদার ভৈরব চন্দ্র চৌধুরীর সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো – ‘‘তাহার সৎকার্যে সন্তুষ্ট হইয়া তাৎকালিক জজ মিঃ ডবলিউ, ট্রিটটার ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে একখানি প্রশংসা পত্র প্রদান করেন। প্রশংসাপত্রের কিয়দংশ প্রদত্ত হইল: – I have much pleasure in writing that Babu Bhairab Chandra Chowdhury is an influential zemindar of this district and a gentleman of very good famaily and connection. He is a liberal supporter of whatever improvement are suggested for the benefit of the district. He also takes a warm interest in the cause of education and whatever may * * * * generally to improve the condition of his fellow country-men. He manages his estate remarkably well & C.’’
ভৈরবচন্দ্রের হাতির হাল ও কামান:
ভৈরব চন্দ্র চৌধুরী অত্যন্ত তেজস্বী ও জেদি ছিলেন। অন্যকে পরাজিত করে নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করে গেছেন সবসময়। বুদ্ধি ও প্রতিভায় তিনি অধিকাংশ বিবাদে জয়লাভ করতেন। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা হতে বার্ণ কোম্পানি থেকে একটি বিশাল আকৃতির লাঙ্গল তৈরি করে আনিয়েছিলেন। এই লাঙ্গলে জমি চাষ করতে হতো হাতি দিয়ে। কোনো স্থানে সম্পত্তির অধিকার নিয়ে বিবাদ সৃষ্টি হলে ভৈরব চন্দ্র চৌধুরী তার সেই বিশাল লাঙ্গলে বড় ও শক্তিশালী হাতি সংযুক্ত করে ওই ভূমি চাষ করাতেন। এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখতে বহু লোক জড়ো হতো।
জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর বই থেকে হাতির হালচাষ সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো – ‘‘ভৈরবচন্দ্রের ‘হাতির হাল’ প্রসিদ্ধ ঘটনা বলিয়া লোক-সমাজে গল্পের বিষয় হইয়া রহিয়াছে। অদ্যাপি ওই হাল ভবানীপুরের বাটিতে আছে। তিনি দুইটি পিতলের কামান ক্রয় করিয়া আনিয়াছিলেন। দুর্গা পূজা ও দোল যাত্রা উৎসব উপলক্ষে ওই কামানের ধ্বনি করা হইত।’’
ক্রিয়েটিভ অ্যাসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাফেয়ার্স-এর যৌথ উদ্যোগে মোমেনসিং ও জাফরশাহী পরগনার প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য ২০২০ হতে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২৩ সালে গৌরীপুরের ঐতিহাসিক ভবানীপুর এলাকায় জরিপকালীন পুরাতন জেলাখানা মোড়ের বাসিন্দা মোঃ মমতাজ উদ্দিন (৮৫) বলেন, গৌরীপুরের ১২টি জমিদার বাড়ির মধ্যে ভবানীপুরে ছিল একটি জমিদার বাড়ি। বর্তমান প্রজন্ম জমিদারির সঠিক ইতিহাস কেউ জানে না।
তিনি জানান, তিনি শৈশবে ভবানীপুরের একটি বড়ই গাছে নিচে অযত্নে পড়ে থাকা হাতির হালটি দেখেছিলেন। এমনকী এটার উপর বসে খেলাধুলাও করেছেন। হাতির হালটি দেখতে অনেক বড় এবং লোহা দিয়ে বানানো ছিল। অনেকটা ঠেলাগাড়ির মতো দেখতে; তাছাড়া হাতির হালের সাথে চাকাও যুক্ত ছিল।
জমিদারির উন্নতি ও কীর্তি:
জমিদার ভৈরব চন্দ্র ক্রমে ক্রমে দু’একটি করে নূতন জমিদারি কিনতে থাকেন। তার সময়ে ভবানীপুরকে নান্দনিক ভাবে সাজিয়েছিলেন। বাড়ি আঙ্গিনা সুন্দর কারুকার্য করেছিলেন। বাসাবাড়ি থেকে আনা রাধামাধবের জন্য একটি সুন্দর মন্দির নির্মিত হয়েছিল। একটি সুবিশাল অট্টালিকার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন তিনি। কিন্তু এর কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। ওই সময় কয়েকটি দুর্ঘটনার ফলে ওই অট্টালিকার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি বলে জানা যায়।
ভৈরবচন্দ্র চৌধুরীর আদর্শ স্ত্রী জগদম্বা দেবী:
ভৈরব চন্দ্র চৌধুরী আমহাটির বাসিন্দা রাম কুমার রায়ের মেয়ে জগদম্বা দেবীকে বিয়ে করেন। সংসারে বিভিন্ন সময় বিপর্যয়, সুখ-দুঃখে যে ভাগ্য পরিবর্তনশীল তা জগদম্বা দেবীর জীবনী আলোচনা করলেই স্পষ্ট হয়। তিনি ছিলেন স্বামীর মতাদর্শের একজন আদর্শ রমনী। জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থে থেকে জগদম্বা দেবীর সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো – ‘‘সর্বগুণসম্পন্ন পুত্রগণের জননী হইয়াছিলেন। ধনে, ঐশ্বর্যে, সুখে, সৌভাগ্যে মর্তধামে স্বর্গসুখের অধিকারিণী হইয়াছিলেন। সেই জগদম্বা দেবীই শেষ জীবনে পতি-পুত্রহীনা আত্মীয়স্বজন-বিরহিতা, সংসার-তাপে দগ্ধ হইয়া, অসহায় অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করিয়াছিলেন। সুখের ইন্দ্রজাল যে এইরূপে বিনষ্ট হইবে, ইহা কে জানিত? জগদম্বা দেবীর ১৮টি সন্তান জন্মিয়াছিল। তন্মধ্যে চারি পুত্র ও দুই কন্যা ব্যতীত অন্যান্য পুত্রকন্যাগণ ভূমিষ্ঠ হইবার অল্পকাল পরেই ইহলোক হইতে অপসৃত হইয়াছিলেন।’’
বড় ছেলে উমেশ চন্দ্র:
ভৈরব চন্দ্র চৌধুরীর চার ছেলে হলেন – উমেশচন্দ্র, গিরিশচন্দ্র, গোলকচন্দ্র ও গোপালচন্দ্র। জ্যেষ্ঠ উমেশ চন্দ্র চৌধুরী দেখতে যেমন সুদর্শন তেমনি গুণী ছিলেন। বিদ্যা-বুদ্ধিতে তিনি সব জায়গায় সমাদৃত হয়েছিলেন। গোবিন্দসুন্দরী দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু হতভাগ্য সুন্দরী রমণী গোবিন্দসুন্দরীর কপালে সাংসারসুখ হয়নি। বিয়ের এক বছরের মধ্যে গোবিন্দসুন্দরীর জীবনসঙ্গী উমেশ চন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যু হয়।
ডা. গোলকচন্দ্ৰ চৌধুরী:
ভৈরব চন্দ্র চৌধুরীর তৃতীয় ছেলে গোলক চন্দ্র চৌধুরী বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ও শক্তিমান ছিলেন। ইংরেজি, বাংলা ও ফার্সিতে তিনি রীতিমতো শিক্ষালাভ করেছিলেন। চিকিৎসা বিষয়ে তার বেশি আসক্তি ছিল। বহু অর্থ ব্যয় করে ডাক্তারি বিষয়ক দুষ্প্রাপ্য ইংরেজি ভাষার বই সংগ্রহ করে পড়াশোনা করেছিলেন। অনেক সময় গরীব রোগী তার ওষুধে সুস্থ হয়েছেন। তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্ণর গোলক চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে আলাপের সময়ে তার চিকিৎসা বিষয়ে জ্ঞান দেখে খুব সন্তুষ্ট হন এবং একটি বহুমূল্যবান ও উন্নতমানের চিকিৎসা বিদ্যার বই উপহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
গোলকচন্দ্রের প্রতিভাপূর্ণ জীবন দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি। মাত্র ১৯ বছর বয়সে অবিবাহিত অবস্থায় বাংলা ১২৬১ (ইংরেজি ১৮৫৫) সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ছোট লাট সাহেবের প্রতিশ্রুত বইটি ভবানীপুরে পৌঁছেছিল।
ভৈরব চন্দ্র ও ছোট ছেলে গোপাল চন্দ্রের মৃত্যু:
বোকাইনগর বাসাবাড়ি ছেড়ে করে বাংলা ১২৫৫ (ইংরেজি ১৮৪৯) সালে ভবানীপুর গ্রামে আসার পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে দুই শোকে জমিদার ভৈরব চন্দ্র চৌধুরীর হৃদয় ভেঙ্গে যায়। শোকে তার জীবনের শৃঙ্খল ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শেষে মানসিক দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনার মধ্য দিয়ে ভৈরব চন্দ্র চৌধুরী বাংলা ২ আশ্বিন, ১২৬৫ (ইংরেজি ১৭ সেপ্টেম্ব, ১৮৫৮ ) সালে মৃত্যুবরণ করেন। পিতৃ বিয়োগের শোকে ছোট ছেলে গোপাল চন্দ্র চৌধুরী বাবার মৃত্যুর তিনদিন পর ইহলোক ত্যাগ করেন। ফলে একমাত্র গিরিশ চন্দ্র চৌধুরী ছাড়া ভবানীপুরের জমিদার বংশে আর কেউ ছিল না।
গিরিশ চন্দ্র চৌধুরী বহু টাকা ব্যয় করে দেশ-বিদেশের সহস্র লোক নিমন্ত্রণ করে বাবার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেন। বাবা ও ভাইদের মৃত্যুর শোকের মধ্যদিয়ে গিরিশ চন্দ্র জমিদারির হাল ধরেন। তিনি বয়সে নবীন হলেও জ্ঞানে ছিলেন প্রবীণের মতো।
রাজ বংশের শেষ সম্বল গিরিশচন্দ্রের মৃত্যু এবং দত্তক নেওয়ার অনুমতি:
গিরিশ চন্দ্র চৌধুরী কাশীনাথপুরের কৃপানাথ রায়ের মেয়ে বামাসুন্দরী দেবীকে বিয়ে করেন। পিতৃবিয়োগের দুই বছরের মধ্যে নব-দম্পতির সুখের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। গিরিশচন্দ্র চৌধুরী কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে ২৭ বছর বয়সে বাংলা ৩২ শ্রাবণ, ১২৬৭ (ইংরেজি আগস্ট মাসের ১৮৬০) সালে পরলোক গমন করেন। মর্মান্তিক ঘটনা কেড়ে নিলো শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশের পঞ্চম পুরুষ ও ভবানীপুরের জমিদার বংশের আলো জ্বালানোর শেষ সম্বলটুকু। জগদম্বা দেবীর আঠারো সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ে ছাড়া আর কেউ জীবিত রইল না। প্রথম মেয়ে শিবসুন্দরী দেবীর সঙ্গে আনন্দ চন্দ্ৰ সান্যাল এবং দ্বিতীয় মেয়ে শ্যামাসুন্দরী দেবীর সঙ্গে হরিনাথ লাহিড়ির বিয়ে হয়। গিরিশ চন্দ্রের অকাল মৃত্যুতে তার জমিদারি এলাকায় হাহাকার শুরু হয়েছিল। তার শোকাহত মা জগদম্বা দেবীর ও স্ত্রী বামাসুন্দরী দেবীর সামনে আসে জমিদারি রক্ষার চিন্তা। জমিদার গিরিশচন্দ্রের মৃত্যুর আগে স্ত্রী বামাসুন্দরী দেবীকে দত্তক নেওয়ার জলপিণ্ডের সংস্থান করতে অনুমতি দেওয়া এবং উইল করে সব সম্পত্তির কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা দিয়ে যান। এরপর ভবানীপুরে শুরু হয় বামাসুন্দরী দেবীর দত্তক নেওয়ার পালা।
মামলায় জড়িয়ে পড়েন দুই বিধবা স্ত্রী বামাসুন্দরী দেবী ও গোবিন্দসুন্দরী দেবী:
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.