ভারতীয় সেনাবাহিনীর নতুন অ্যান্টি-ড্রোন অস্ত্র

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতের মিরাটে রিমাউন্ট ভেটেরিনারি কোর সেন্টার কোয়াডকপ্টার জাতীয় ড্রোন ধ্বংস করার কৌশল ও নজরদারিতে বাজপাখি ও ঈগলদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়ান নিউজের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
ভারতের সেনাবাহিনী জানায়, যুদ্ধক্ষেত্রে কোয়াডকপ্টার জাতীয় ছোট মনুষ্যবিহীন আকাশযান (ইউএভি) এখন সচরাচর ব্যবহৃত হচ্ছে। এবং এটি বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
প্রশিক্ষকের দস্তানায় বসে নির্দেশের অপেক্ষা করে কৃষ্ণ ঈগল। নির্দেশ পাওয়ামাত্রই ক্ষিপ্র বেগে উড়াল দেয় আকাশপানে। উড়তে উড়তে উঠে যায় আরও উঁচুতে। তারপর লক্ষ্য শনাক্ত করা মাত্রই তার দিকে ডাইভ করে নেমে আসে। ঈগলের আক্রমণে এভাবে মুহূর্তেই ভবলীলা সাঙ্গ হলো লক্ষ্যের– একটি দুর্ভাগা কোয়াডকপ্টার ড্রোনের। ধারালো নখরে পাকরাও করে ড্রোনটি নিয়ে নেমে আসে ঈগল। তারপর উড়াল দেয় আরও একবার, তার মিশনের বাকি অর্ধেক– ‘নজরদারি’ সম্পন্ন করতে।
প্রশিক্ষকের দস্তানায় বসে নির্দেশের অপেক্ষা করে কৃষ্ণ ঈগল।
(প্রশিক্ষকের দস্তানায় বসে নির্দেশের অপেক্ষা করে কৃষ্ণ ঈগল)
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথ যুদ্ধ প্রশিক্ষণ ‘ইয়ুধ আভয়াস’ বা ‘যুদ্ধাভ্যাস’ শীর্ষক মহড়ায় এ দৃশ্যের দেখা মেলে। এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের আউলিতে।
প্রশিক্ষণকালে এমন একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির রচনা করা হয়, যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে শত্রুবাহিনীর ড্রোন হামলা করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে মিত্র বাহিনীর প্রয়োজন শনাক্ত হওয়া ছাড়াই শত্রুর গতিবিধির ওপর ব্যাপক নজরদারি। আর সেজন্যই ব্যবহার করা হয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত শিকারি পাখির দলকে।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথ যুদ্ধ প্রশিক্ষণ 'ইয়ুধ আভয়াস' বা 'যুদ্ধাভ্যাস' শীর্ষক মহড়ায় এ দৃশ্যের দেখা মেলে।

দেশটির সামরিক বাহিনীর একটি সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য প্রিন্ট জানায়, প্রশিক্ষণকালে ঈগলগুলো কয়েকশ কোয়াডকপ্টার ড্রোন নামিয়ে আনতে সফল হয়, অধিকাংশক্ষেত্রেই এগুলো সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় তাদের আক্রমণে। আর এগুলো কোয়াডকপ্টার হওয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো ঈগল আহত হয়নি।
এসব পাখির বেশিরভাগই উদ্ধারকৃত। তাদের ফ্যালকন রেসকিউ অ্যান্ড রিহাবিটেশন সেন্টার থেকে আনা হয়। ২০২০ সাল থেকেই পাখিগুলোকে বিশেষ মিশনের জন্য প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। নজরদারির জন্য পাখিগুলোর মাথায় বসানো রয়েছে বিশেষ ধরনের ক্যামেরা। রয়েছে ভিডিও রেকর্ডের ব্যবস্থাও।
তাদের ফ্যালকন রেসকিউ অ্যান্ড রিহাবিটেশন সেন্টার থেকে আনা হয়।
(তাদের ফ্যালকন রেসকিউ অ্যান্ড রিহাবিটেশন সেন্টার থেকে আনা হয়)
কারণ দিনে দিনে বড় আকারের কোয়াডকপ্টারের ব্যবহার বাড়ছে। আকাশে অনেক উঁচুতে উড়ে এসব হুমকি শনাক্ত করবে পাখিগুলো। রেকর্ড করা ভিডিও সম্প্রচারের ছোট এন্টেনাও বসানো হবে তাদের মাথায়। ফলে সেনারা সে ভিডিও দেখে শত্রুর বড় কোয়াডকপ্টার ভূপাতিত করার অন্য ব্যবস্থা নিতে পারবে। তবে আপাতত ভিডিও সম্প্রচারের ব্যবস্থা নেই, ধীরে ধীরে সেটি চালু করার লক্ষ্য হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর।
নজরদারিতে শিকারি পাখি ব্যবহার প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর অপর একটি সূত্র জানায়, শিকারি বাজ বা ঈগলের থাকে নিজস্ব এলাকা। তারা যখন পাখিদের কোনো অঞ্চলে মুক্ত করেন তখন তারা নিজেরাই নিজেদের এলাকা বেছে নেয় এবং তার ওপর চক্কর দিতে থাকে। এভাবে তারা ক্যামেরার মাধ্যমে বড় একটি এলাকার নজরদারিতে সাহায্য করে।
শিকারি বাজ বা ঈগলের থাকে নিজস্ব এলাকা।
(শিকারি বাজ বা ঈগলের থাকে নিজস্ব এলাকা)
প্রতিটি পাখির জন্য আছে একজন করে হ্যান্ডলার। তাদের কাজ পাখিগুলোর প্রাকৃতিক আচরণকে উৎসাহ দিয়ে সামরিক কাজে লাগানো। তবে এখনও পাখিগুলোর প্রশিক্ষণ চলমান এবং তাদের সামরিক কাজে মোতায়েন করা হয়নি বলে সূত্রটি উল্লেখ করে।
পারদর্শিতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পর সেনাবাহিনী পাখিগুলোকে অপারেশনে মোতায়েন করবে। রিমাউন্ট ভেটেরিনারি কোর সেন্টার দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সারমেয়দের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ আশা করছেন, ঈগল ও বাজ পাখিরাও প্রত্যাশিত সাফল্য পাবে।
প্রতিটি পাখির জন্য আছে একজন করে হ্যান্ডলার।
(প্রতিটি পাখির জন্য আছে একজন করে হ্যান্ডলার)
গত দুই দশক ধরে, বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হয়েছে ড্রোন প্রযুক্তি। আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা উভয় ধরনের মিশনেই অপরিহার্য এখন ইউএভি। ২০১৬ সালে প্রথম ড্রোন ধরাশায়ী করতে ঈগল ব্যবহার করে নেদারল্যান্ডস। দেশটি জানায়, উচ্চ প্রযুক্তির হুমকি শনাক্তে এটি নিম্ন প্রযুক্তির কার্যকরী সমাধান।
বিশ্বের অন্যান্য সেনাবাহিনীও শিকারি পাখিদের ড্রোন ভূপাতিত করতে ব্যবহার করছে। ভারতে সেনাবাহিনীর আগে এই উদ্যোগ নেয় তেলেঙ্গানার রাজ্য সরকার। ভিআইপি অনুষ্ঠানে অবৈধ ড্রোনের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর ঈগল প্রশিক্ষণ শুরু করে।
বিশ্বের অন্যান্য সেনাবাহিনীও শিকারি পাখিদের ড্রোন ভূপাতিত করতে ব্যবহার করছে।
(বিশ্বের অন্যান্য সেনাবাহিনীও শিকারি পাখিদের ড্রোন ভূপাতিত করতে ব্যবহার করছে)
ড্রোন প্রতিরোধী এই স্কোয়াডের নাম দেওয়া হয় ‘গারুদা স্কোয়াড’। তাদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয় তেলেঙ্গানার মৈনাবাদে অবস্থিত ইন্টিগ্রেটেড ইন্টেলিজেন্স ট্রেনিং একাডেমীতে।
প্রথম মহাযুদ্ধকাল থেকেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয় ‘পিজন সার্ভিস’ বা ‘কবুতর বাহিনী’। এই বাহিনীর প্রশিক্ষিত বাহিনী মহাযুদ্ধের সময়ে জরুরি বার্তা বয়ে নিয়ে যেত।

প্রথম মহাযুদ্ধকাল থেকেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয় 'পিজন সার্ভিস' বা 'কবুতর বাহিনী'।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে পিজন সার্ভিসের একজন মেজর সেনাবাহিনীর কাছে পাখি থাকাকে বেসামরিক নাগরিকের হাতে বন্দুক থাকার সমতুল্য বলে কটাক্ষ করেন। কারণ, ততোদিনে উন্নত রেডিও প্রযুক্তির কল্যাণে ফুরিয়ে এসেছিল কবুতরের ডাক বহনের প্রয়োজন।
শুধু ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নয়, প্রাচীনকাল থেকেই যুদ্ধের সংবাদ ও কূটনৈতিক বার্তা আদান প্রদানে বাহক পাখিরা ছিল অপরিহার্য। বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই ছিল যার ব্যবহার। প্রথম মহাযুদ্ধকালে কবুতরের দিক নির্ণয়ের ক্ষমতা ও একটানা উড়তে পারার গুণের কারণে ব্যাপক ব্যবহার হয়। ব্রিটিশরা এদিক থেকে অগ্রণী হলেও পিছিয়ে ছিল না জার্মানরা।
শুধু ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নয়, প্রাচীনকাল থেকেই যুদ্ধের সংবাদ ও কূটনৈতিক বার্তা আদান প্রদানে বাহক পাখিরা ছিল অপরিহার্য।
(শুধু ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নয়, প্রাচীনকাল থেকেই যুদ্ধের সংবাদ ও কূটনৈতিক বার্তা আদান প্রদানে বাহক পাখিরা ছিল অপরিহার্য)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে চতুর জার্মানরা আরেক কাঠি সরেস পরিকল্পনা করে। মিত্র বাহিনী যে ধরনের কবুতর বেশি ব্যবহার করতো ঠিক সেই জাতের কবুতর ফ্রান্সে প্যারাসুটের সাহায্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। যাতে করে মিত্রবাহিনী নিজেদের কবুতর মনে করে, এগুলোর পায়ে যুদ্ধের গোপন বার্তা বেঁধে দিলে কবুতরগুলো সেসব নিয়ে জার্মানিতে ফিরে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর পূর্বসূরি সংস্থা ছিল ‘আমেরিকান অফিস অব স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিসেস’ (ওএসএস)। এই বাহিনীর চরদের প্রায়ই জাপানের দখলকৃত বার্মায় গোপন মিশনে পাঠানো হতো। তাদের কাছে থাকতো খাঁচা বন্দী কবুতর। মিশন পরিকল্পনামাফিক এগুচ্ছে কিনা তা জানাতে এই চরেরা গুপ্ত সাংকেতিক বার্তাবাহী কবুতরটি উড়িয়ে দিত।
মিশন পরিকল্পনামাফিক এগুচ্ছে কিনা তা জানাতে এই চরেরা গুপ্ত সাংকেতিক বার্তাবাহী কবুতরটি উড়িয়ে দিত।
(মিশন পরিকল্পনামাফিক এগুচ্ছে কিনা তা জানাতে এই চরেরা গুপ্ত সাংকেতিক বার্তাবাহী কবুতরটি উড়িয়ে দিত)
আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগেও যুদ্ধে পাখিদের প্রয়োজন বিলুপ্ত হয়নি। ছোট ছোট অ্যান্টি-ড্রোন ভূমিকায় তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া তার ইঙ্গিত দেয়। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.