বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকট দিঘলিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে,গাইনি চিকিৎসকের অভাবে গর্ভবতী ও প্রসূতি রোগীর চিকিৎসায় চরম সংকট এ জনপদের দেড় লক্ষ মানুষের

দিঘলিয়া (খুলনা) প্রতিনিধি: খুলনার দিঘলিয়া উপজেলাটি ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ২টি ইউনিয়ন খুলনা শহরের সাথে সংযুক্ত। বাকী ৪টি ইউনিয়ন (দিঘলিয়া, সেনহাটী, বারাকপুর, গাজীরহাট) খুলনা শহর থেকে একাধিক নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত। এ ৪টি ইউনিয়নে দেড় লক্ষাধিক লোকের বসবাস। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও জেলা শহরের সঙ্গে এ ইউনিয়ন ৪টি’র সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
এ ৪টি ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসা প্রদানের একমাত্র ভরসাস্থল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে সারা বছরই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকট লেগেই আছে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সৃষ্টি করা এ কৃত্রিম সংকটের কারণে এ এলাকার মানুষ সু-চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বছরের পর বছর এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকট লেগেই থাকে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে ১১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ থাকলেও নিয়মিত চিকিৎসা সেবা প্রদান করছেন মাত্র ১ জন চিকিৎসক। বাকী ১০ জনের মধ্যে ১ জন সপ্তাহে দুইদিন দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী দেখেন।
সপ্তাহের বাকী ৫ দিন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন। আরেকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পোস্টিং দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে থাকলেও তিনি প্রেষণে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন। দিঘলিয়া উপজেলার এ হাসপাতালটিতে গাইনী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকার কারণে গর্ভবতী এবং প্রসূতি রোগীদের চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
খুলনা মহানগরীর পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন আড়ংঘাটা ও যোগীপোল ইউনিয়ন খুলনা শহরমুখী হওয়ায় এবং এ উপজেলার আওতাভূক্ত বাকী ৪টি ইউনিয়ন যথাক্রমে দিঘলিয়া সদর, সেনহাটী, বারাকপুর এবং গাজীরহাট ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক লোক দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপর নির্ভরশীল। ৬টি ইউনিয়ন নিয়েই উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। দ্বীপ বেষ্টিত এ উপজেলার ৪ টি ইউনিয়নে বেসরকারিভাবে কোন হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক গড়ে উঠেনি। ৪টি ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ২টি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ১৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ১৯৯২ সালে ৬ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে ৩১ শয্যা নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৩ সালে ১৯ শয্যা বৃদ্ধি করে ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও এর কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে।
বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫০ শয্যার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকলেও জনবল সংকট, চিকিৎসক সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার আশঙ্কায় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি হতে রোগীদের অনীহা রয়েছে।
বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চরম সংকট বিরাজমান। ২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ৮ জন মেডিকেল অফিসার, ওয়ার্ড বয় এবং নার্স দিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামগ্রিক চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। হাসপাতালের দোতলায় ১টি অপারেশন থিয়েটার থাকলেও এ্যানেসথেশিষ্ট বা অচেতনবিদের অভাবে কোন অপারেশন করা হয় না। একজন এ্যানেসথেশিস্ট পোস্টিং থাকলেও তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (সংযুক্তিতে) কাজ করছেন।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রটিতে কোন গাইনী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকার কারণে এলাকার গর্ভবতী এবং প্রসূতি রোগীর চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই কোন ডেন্টাল সার্জন, অর্থোপেডিকস চিকিৎসক, রেডিওগ্রাফার। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে।
রোগী পরিবহনের জন্য ১টি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও ড্রাইভারের কোন পোস্টিং নেই। আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে নিয়োগকৃত একজনকে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি চালানো হচ্ছে। হাসপাতালটিতে আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন থাকলেও এটি পরিচালনার জন্য নেই কোনো প্রশিক্ষিত চিকিৎসক।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রটিতে গুরুতর রোগীদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় জরুরী বিভাগে আগত গুরুতর রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা (নদী পারাপার)’র কারণে গুরুতর রোগী এবং তাদের স্বজনদের মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পুরনো ভবনটির অবস্থা জরাজীর্ণ। ছাদের প্লাস্টার খসে পড়তে শুরু করেছে। ছাদের নীচের প্লাস্টার ঢালাইসহ ভেঙ্গে পড়ে পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের আসবাব পত্র নষ্ট হয়েছে। বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন অনেকে। ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এটি মেরামত কিংবা নতুন ভবন তৈরি করা খুবই জরুরী।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দ্বীপ বেষ্টিত এ উপজেলার কোথাও ব্যক্তি মালিকানাধীন হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক গড়ে উঠেনি। সংগত কারণেই এ উপজেলার দেড় লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসাস্থল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে বছরের পর বছর এ এলাকার মানুষ তাদের কাঙ্ক্ষিত সুচিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বহিঃর্বিভাগে প্রতিদিন ৪’শ থেকে ৫’শ রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভীড় জমায়। বহিঃর্বিভাগে আগত একাধিক রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সামগ্রিক সেবা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রাপ্তিতে এবং সাধারণ সেবা সম্পর্কে তাদের কোনো অভিযোগ নেই।
হাসপাতালটির সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয় হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও দিঘলিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ মারুফুল ইসলামের কাছে।
তিনি বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, সামগ্রিকভাবে হাসপাতালটি সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করে আমরা চিকিৎসকের কিছু শূন্যপদ পূরণ করেছি। বাকী শূন্যপদগুলো পূরণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এলাকার ভুক্তভোগীমহল ও বিজ্ঞমহলের অভিমত স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট উর্ধতনমহলের সৃষ্ট এ কৃত্রিম সংকট সরকারের গ্রামবাংলার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের পরিপন্থি। চিকিৎসকদের গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে আসতে হবে। সকল পেশাজীবিগণ যদি মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারে তবে দেশের চিকিৎসকগণ কেন শহরমুখি হন? কেন আজ গ্রাম বাংলার মানুষের স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়নে কোটি কোটি টাকার ভৌত অবকাঠামো অকারণে অব্যবহৃতভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে? জাতির এ খেসারত কে দেবে এটাই বিজ্ঞমহলের জিজ্ঞাসা স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সকল উর্ধতন মহলের কাছে। দিঘলিয়ার সকলমহল এ ব্যাপারে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দিঘলিয়ার সকল স্তরের জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, উপজেলা প্রশাসনসহ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সকল মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর দিঘলিয়া (খুলনা) প্রতিনিধি সৈয়দ আবুল কাসেম। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.