নাটোরের ব্যতিক্রমী এক গ্রামের নাম কালিকাপুর : মা-বাবা অধিকার রক্ষায় একাট্টা গ্রামবাসী


নাটোর প্রতিনিধি: নাটোরের বনপাড়া পৌরসভার পশ্চিমে কালিকাপুর পশ্চিমপাড়া গ্রাম। অনেকটা নির্মল পরিবেশ গ্রামটি ঘিরে। চারিদিকে সবুজের হাতছানি। এই গ্রামের মাঝখানে রয়েছে একটি ঐতিহ্যবাহী পুকুর।

পুকুরটিকে গ্রামবাসীর সবাই ব্রিঞ্চির পুকুর নামেই চেনে। ব্রিটিশ শাসন আমলের প্রায় আট বিঘা আয়তনের পুকুরটির পানি যেমনটা স্বচ্ছ, তেমনি গ্রামের চারিদিকেও অনেকটা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। অথচ এই গ্রামটিতেই দুই মাস আগেও মাদকের উৎপাতে অতিষ্ঠ ছিলেন গ্রামবাসী। মাদকসেবী সন্তানদের অত্যাচারে অনেক পরিবার এখন প্রায় নিঃশ্ব।

মাদকসেবী সন্তানরা কখনো কখনো টাকার জন্য বাবা-মায়ের গায়েও হাত তুলতেন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন মাদকের সর্বনাশে গ্রাস হবে সবুজেঘেরা এই কালিকাপুর-এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে খেতে থাকে গ্রামবাসীর মাঝে।শেষে সকলে মিলে সিদ্ধান্ত বৈঠকে বসলেন। গঠন করলেন মাদক প্রতিরোধ কমিটি।

শুধু কমিটিতেই সীমাবদ্ধ রাখা হলো না। গ্রামের যুবকদের প্রতিদিন রাতজেগে পাহারা বাসানোরও দায়িত্ব দেওয়া হলো। পাশাপাশি পিতা-মাতার প্রতি সন্তানদের দায়িত্ব ও কতর্বগুলো ব্যানার, ফেস্টুনে লিখে গোটা গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে প্রতিটি বাড়িতে মাদকবিরোধী প্রচারণামূলক পোস্টার সাটিয়ে দেওয়া হলো। সেই থেকে গ্রামের মা-বাবা’র অধিকার রক্ষায় এবং মাদকের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধে নেমে পড়েছেন গ্রামবাসী।

গ্রামটিতে সরজেমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়ির সামনে টাঙ্গানো বা ঝুলানো আছে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের কি কি দায়িত্ব পালন করতে হবে, সেসব নির্দেশনা সংবলিত পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন।সেসবে লিখা রয়েছে, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সমাজে নিমোক্ত সামাজিক সদ্ধিান্ত গ্রহণ করা হয় এবং প্রত্যেক নাগরিককে তা অবহিত করা হয়। এ বিষয়ে কোনো আপোষ নয়।

এগুলো হলো-পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। শিশুকালে পিতা-মাতা যেমনভাবে আদর-যতœ করেছে ঠক তেমন। পিতা-মাতার সম্পৃর্ণ দায়-দায়িত্ব সন্তানকে বহন করতে হবে।পিতা-মাতার সাথে কোনোরুপ বাজে আচরণ বা গায়ে হাত তোলা যাবে না (পিতা-মাতা যতই খারাপ আচরণ করুক না কেন)। পিতা-মাতা বিচার প্রাথী হোক বা নাই হোক তাৎক্ষণিক ওই সন্তানের সর্বোচ্চ বিচার গ্রামের প্রধানরা করবেন।

সন্তানদের প্রতিও পিতা-মাতার কিছু দায়িত্ব তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রচারণা সামগ্রীতে। এর মধ্যে রয়েছে-পিতা-মাতার ওয়ারিশ বা স¤পদ বন্টনে কোনো প্রকার অনিয়ম কেউ করতে পারবে না। কোরআন, সুন্নাহ তথা পারায়েজ মোতাবেক হতে হবে। এর কোনো ব্যতয় হতে দেওয়া হবে না।

এসব কাজের ব্যতয় হলে সামাজিকভাবে সাজা নিমোক্ত হতে পারে- সেগুলো হলো সমাজে তার সদস্য পদ স্থগিত বা বাতিল করা, সমাজ থেকে বহিস্কার করা, সামাজিক গোরস্থানে তার জানাযা না দেওয়া, ওই পরিবারের সঙ্গে কোনো স¤পর্ক না রাখা।বাসিন্দা একই এলাকার নারী আছমা খাতুন বলেন, ‘কিছুদিন আগেও গ্রামে চরম অস্থিরতা ছিলো। মাদক প্রতিরোধে গ্রামের যুবকরা রাতজেগে পাহারা বসায়। ফলে রাতেও কেউ মাদক বিক্রি করার সাহস পাচ্ছে না। এখন অনেক শান্তিতে বাস করছি আমরা। সবাই মিলে-মিশে একই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। খুব ভালো লাগছে।

মামুন অর রশিদ বিটিসি নিউজকে বলেন, মাস দুয়েক আগেও আমরা গ্রামবাসী মাদক সমস্যা নিয়ে জর্জরিত ছিলাম। মাদককে কেন্দ্র করে বাড়ি বাড়ি না দ্বন্দ্ব ফেসাত লেগেই থাকত। কখনো কখনো মাদকসেবী সন্তানরা ধরে বাবা-মাকেও নির্যাতন করত। আবার জমিজমা নিয়েও প্রায় বিরোধ লেগেই থাকত।

এসবের সমস্যা রোধে আমরা সবাই একজোট হয়ে গ্রামের সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এসব সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। এখন গ্রামে কেউ আর প্রক্যাশে মাদক সেবন করে মাতলামি করার সাহস পায় না। কেউ মাদক বিক্রি করছে খবর পেলেই তার বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। তারা এসে সেই মাদকসেবী বা বিক্রেতাকে ধরে নিয়ে যায়। এভাবে গত দুই মাসে অন্তত ৯ জনকে আমরা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।

মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক নান্নু সরকার বিটিসি নিউজকে বলেন, মাদকের কারণে অনেক পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। আবার মাদকসেবী সন্তানরা কখনো কখনো বাবা-মাকেও ধরে নির্যাতন করেছেন। এসব নিয়ে অতিষ্ঠ ছিলাম আমরা। কিন্তু এখন আমরা সবাই এই মাদকের বিরুদ্ধে এবং বাবা-মায়ের অধিকার আদায়ে একজোট হয়ে গেছি। কেউ আর এসব অপরাধ করে পার পেতে পারবে না। আমরা নিজেরাই প্রয়োজনে বিচার করে গ্রামছাড়া বা প্রশাসনের হাতে তুলে দিচ্ছি। কোনো অবাধ্য সন্তানকে গ্রামে থাকতে দেওয়া হবে না। যতক্ষণ না সে সংশোধন না হয়ে গ্রামে ফিরবে।’

মাদক প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ও বড়াইগ্রাম উপজেলা বণিক সমিতির সভাপতি ফজলুর রহমান তারেক বিটিসি নিউজকে বলেন, বাবা-মায়ের অধিকার আদায় এবং মাদক রোধে আমরা এখন সবাই একযোগে কাজ করে যাচ্ছি। গ্রামের মানুষও শান্তিতে আছেন। কেউ কোনো বিপদে-আপদে পড়লেও আমরা সবাই গিয়ে তার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। একটি আদর্শ গ্রাম প্রতিষ্টায় আমরা এ কাজ করে যাচ্ছি। প্রশাসনও আমাদের সহযোগিতা করছে।

জানতে চাইলে বড়াইগ্রাম থানার ওসি (তদন্ত) আব্দুর রহিম বিটিসি নিউজকে বলেন, ‘এই ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ভালো। এতে করে সমাজে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় থাকবে। গ্রামবাসী মাদক প্রতিরোধে যে যে উদ্যোগ নিবে আমরা সেসব উদ্যোগে সার্পোট দিব ..

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নাটোর প্রতিনিধি খান মামুন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.