নওগাঁয় বেড়েছে দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ব


নওগাঁ প্রতিনিধি: নওগাঁ মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ঋণের বিপরীতে ফাঁকা চেক গ্রহন ও পাওনা অর্থের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করে সমবায় আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘন করায় জেলা সমবায় অফিসে অভিযোগ করেছেন এক ভুক্তভোগী। গত বৃহস্পতিবার নওগাঁ শহরের চকএনায়েত মহল্লার মৃত তাছের আলীর ছেলে ভুক্তভোগী জামিনদার মিজানুর রহমান এ অভিযোগ করেন।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, নওগাঁ শহরের চকমুক্তার মহল্লার ওমর আলীর ছেলে মোস্তাক আহমেদ (মিজানুর রহমানের বন্ধু) পেশায় ইটভাটা ব্যবসায়ী। ব্যবসার প্রয়োজেন গত ১৩/১১/১৮ ইং তারিখে সদর উপজেলার ভবানীপুর এলাকার ‘নওগাঁ মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি:’ এর নিকট থেকে ১২ লাখ টাকা ঋণ নেয়। যার বিপরীতে সুদসহ ১৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। ঋন নেয়ার সময় ‘ডাচ বাংলা ব্যাংক হিসাব’ নম্বরের একটি ফাঁকা চেকের পাতা জমা দিয়ে মিজানুর রহমান জামিনদার হন। আমার বন্ধু নিয়মিত ঋণের ৮ লাখ ৫৩ হাজার ১০০ টাকা পরিশোধ করে এবং বাঁকী ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৯০০ টাকা পাওনা রয়েছে। ব্যবসায়ীক সমস্যা হওয়ায় বাঁকী টাকা পরিশোধ করতে বিলম্ব হয়। এতে ‘নওগাঁ মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি:’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানা আমার বিরুদ্ধে ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৯০০ টাকার বিপরীতে ১৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা ওই ফাঁকা চেকে লিখে চেক ডিজঅনার করে মামলা দায়ের করেন। যা সমবায় আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি জেলা সমবায় অফিসারের কাছে সুবিচার দাবী করেছেন।

‘জেলা সমবায় অফিস থেকে গত ০৩/০৯/১৯ ইং তারিখে এক স্মারকলিপির মাধ্যমে জেলার সকল বহুমুর্খী/ মাল্টিপারপাস/সঞ্চয় ও ঋণদান/সার্বিক গ্রাম/কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতি লি: ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ফাঁকা চেক, ডিড, স্ট্যাম্প গ্রহন না করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়, সমবায় সমিতির ঋণ বিতরণ না করা প্রসঙ্গে। ‘যা সমবায় সমিতির আইন ২০০২ (সংশোধিত আইন ২০০২ ও ২০১৩) এবং সমবায় সমিতির বিধিমালা ২০০৪ এর পরিপন্থি।’ উক্ত নির্দেশ অমান্যের দায়ে সমিতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

জানাগেছে, নিবন্ধিত অধিকাংশ সমবায় সমিতি আইন বর্হিভূতভাবে ফাঁকা চেকের বিপরীতে সদস্যদের মাঝে ঋণ বিতরণ করার কথা থাকলেও বেশি লাভের আশায় বাহিরে ঋণ বিতরণ করে। আবার অনিবন্ধিত কিছু সমিতি সাইবোর্ড লাগিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে। মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তারা বার্ষিক, মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক মেয়াদে এমনকি দিন হিসেবে চড়া সুদের ব্যবসা করছেন। কেউ ব্যাংকের ফাঁকা চেক ও জমির দলিল বন্ধক রেখে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করছেন। যা সমাজে দাদন ব্যবসা নামে পরিচিত পেয়েছে। এই দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। কেউ পরিবার নিয়ে দেউলিয়া হয়েছে এবং আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ব নিয়ে ইতোমধ্যে জেলায় কয়েকটি স্থানে মানববন্ধন করেছেন সচেতন মহল।

সাপাহার সদর উপজেলার করলডাঙ্গা (ডাঙ্গাপাড়া) গ্রামের মজিবর রহমান মন্ডল নামের এক দাদন ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে উপজেলার শিরন্টি গ্রামের সালেক নামের এক ক্ষুদ্র ঔষধ ব্যবসায়ী তার বশত বাড়ী, জমি জমা সম্পূর্ন শেষ করে সর্বশান্ত হয়ে গত ৪ বছর ধরে এলাকা ছেড়ে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে অন্যত্র জীবন যাপন করছেন। একই এলাকার মাদরাসার শিক্ষক নাসির উদ্দিন প্রয়োজেনর তাগিদে সুদের উপর টাকা নিয়ে সংসার জীবনের তার সব কিছু হারিয়ে এখন নিঃশ্ব জীবনযাপন করছেন।

মহাদেবপুর উপজেলার দেবীপুর গ্রামের ভুক্তভোগী আব্দুল কাদের বিটিসি নিউজকে বলেন, ফলের ব্যবসার জন্য উপজেলার বগের মোড়ে ‘কৃষি প্রগতি উন্নয়ন’ সমিতি থেকে ব্যাংকের একটি ফাঁকা চেক জমা দিয়ে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিই। প্রতিদিন ১ হাজার ৫শ টাকা করে ৩মাস কিস্তি দেয়ার পর ওই সমিতি উধাও হয়ে যায়। সমিতি উধাও হওয়ার আট মাস পর আমার নামে ৫লাখ টাকার চেকের মামলা দেয়া হয়। মামলায় উল্লেখ করা হয়- ওই সমিতির মালিক তানভীর ফেরদৌস ও আতিক আমাকে টাকা হাওলাদ দিয়েছে। মামলার পর থেকে আমি বিভিন্ন ভাবে হয়রানি শিকার হচিছ।

নওগাঁ সচেতন তরুন প্রজন্মের আহ্বায়ক শফিকুর রহমান মামুন বিটিসি নিউজকে বলেন, সারাদেশে দাদন ব্যবসা ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারন মানুষরা যখন অভাব অনটনের কারণে ঋণ নিয়ে উপকার পাওয়ার আশা করে, সেখানে এটা গলার কাটা হয়ে দেখা দিয়েছে। তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে নিষ্পেশিত করা হচ্ছে। অনেকে বাড়ি ঘর বিক্রি করে দেওলিয়া এবং আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিয়েছেন। এই দাদন ব্যবসায়ীরা এমনকি মা-বোনদের সম্ভ্রমহানী পর্যন্ত করেছেন।

তিনি আরো বলেন, নীতিমালার বাহিরে গিয়ে সমবায়গুলো সুদ ব্যবসা করছেন। ফাঁকা চেক নিয়ে তারা নিজেদের ইচ্ছেমত টাকার অঙ্ক বসিয়ে ডিজঅনার করে মামলা দিয়ে হয়রানি করেন। কিছু মহল তাদের ইন্ধন জুগিয়ে সুযোগ করে দিচ্ছেন। যার কারণে তারা অনিয়ন্ত্রিত ও অমানবিক হয়ে পড়েছে। এখান থেকে উত্তোরণে জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে, প্রশাসনকে এ ব্যাপারে মূর্খ ভূমিকা পালন করতে হবে। অচিরেই এদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবী জানান তিনি।

নওগাঁ মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানা বিটিসি নিউজকে বলেন, ঋণ নেয়ার সময় জামানত হিসেবে তারা তাদের চেকে টাকার অঙ্ক লিখে দিয়েছিলেন। যেহেতু তারা চেকে টাকার অঙ্ক লিখে দিয়েছেন, সেহেতু সেই পরিমাণ টাকার উপরই চেক ডিজঅনার করে মামলা দেয়া হয়েছে। যেহেতু কিছু টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, বাঁকী টাকা পাওয়া যাবে। আদালতের মাধ্যমে সেটা ফায়সালা করা হবে। তবে অভিযোগের বিষয়টি আমার জানা নেই।

নওগাঁ জেলা সমবায় অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) হোসেন শহীদ বিটিসি নিউজকে বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। তবে ফাঁকা চেক জমা নিয়ে ঋণ দেয়া আইনের পরিপন্থি। ইতোপূর্বে এসব বিষয়ে মাইকিং ও প্রচার এবং নোটিশ করা হয়েছে।

নওগাঁ জেলা প্রশাসক হারুন-অর-রশীদ বিটিসি নিউজকে বলেন, জেলার প্রায় সবখানেই কমবেশী দাদন ব্যবসা রয়েছে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। ফাঁকা চেক কিংবা জমির দলিলের বিনিময়ে কেউ প্রতারিত হলে, এ বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নওগাঁ প্রতিনিধি মো: আব্বাস আলী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.