তিন বোতল পানিতে ক্যান্সারের চিকিৎসা, সিভিল সার্জন বন্ধ করে দেওয়ার পর ও পুনরায় চালু !

বিশেষ (রংপুর) প্রতিনিধি: মাত্র তিন বোতল পানি দিয়ে মরণব্যাধি ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনার পল্লী চিকিৎসক আলতাবুর রহমান বাদশা।
এদিকে প্রায় ৮ মাস ধরে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ তদন্ত করে। তদন্ত শেষে পল্লী চিকিৎসক বাদশা ভুল চিকিৎসা দিয়ে আসছেন বলে তার চেম্বার ও গবেষণা কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া ভুল স্বীকার করে মুচলেকা দিয়ে কারাদণ্ড থেকে মুক্তি পেয়েছেন বাদশা।
মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) দুপুরে ভুয়া চিকিৎসক আলতাবুর রহমান বাদশার বাড়িতে গড়ে ওঠা চেম্বার ও গবেষণা কার্যালয় পরিদর্শন শেষে তা বন্ধ করে দেন লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায়। এ সময় সঙ্গে ছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার রায় অজয়।
এরপর গতকাল শনিবার (০৩ সেপ্টেম্বর) সকালে আবারও নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করেই গোপনে পুনঃরায় চালু করে তার চেম্বার।
স্থানীয়রা বলছেন, ভুয়া চিকিৎসক আলতাবুর রহমান বাদশা ভুল চিকিৎসা দিয়ে অনেক মানুষের জীবন নষ্ট করেছেন। তাই তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি না করে শুধু মুচলেকায় ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। কিন্ত শনিবার আবার সে গোপনে তার চিকিৎসা সেবা চালু করেছে।
এর আগে ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর দুপুরে উপজেলার কাকিনা ইউনিয়ন পরিষদের পাশে বাদশার বাড়িতে গড়ে ওঠা চেম্বার ও গবেষণা কার্যালয় পরিদর্শন করেন জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। এরপরই তার চিকিৎসা দেওয়া ঔষুধসহ বিভিন্ন সামগ্রী সংগ্রহ করে তারা। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ডাক্তার আব্দুল কাদের গনি, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্যানিটারি ইনসপেক্টর তোফাজ্জল হোসেন ও ডাক্তার সাইফুল ইসলামকে নিয়ে তদন্ত কমিটি করে ঔষুধসহ বিভিন্ন সামগ্রী ঢাকায় ল্যাবে পাঠানো হয়।
প্রায় ৮মাস তদন্ত শেষে তারা বলছে, সম্পূর্ণ ভুল উপায়ে চিকিৎসা দিয়ে আসছেন হোমিও চিকিৎসক বাদশা।  এছাড়াও তার কাছে প্রয়োজনীয় কাগজ চাইলে তিনি দিতে পারেননি। শুধু ২০০৯ সালের পল্লী চিকিৎসকের একটি কাগজ দিয়েছেন। ওই সময় তাকে ক্যানসার চিকিৎসা বন্ধ রাখতে বলা হলেও তিনি স্থানীয় প্রভাব দেখিয়ে চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন। এমনকি সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
জানা গেছে, জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়ন পরিষদের পাশে পল্লী চিকিৎসক আলতাবুর রহমান বাদশা গড়ে তোলেন চেম্বার ও গবেষণা কার্যালয়। ওই সময় থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা রোগীদের মরণব্যাধি ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের ভুল চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন। ক্যানসার চিকিৎসা করে রোগ থেকে মুক্তি পেতে অনেকে সর্বস্ব বিক্রি করে চিকিৎসার পেছনে ব্যয় করেন। কিন্তু কিছু দিন পর রোগী মারা যান। সম্প্রতি কাকিনা বাজারের ডক্টর সাহেদ আলী ক্যানসারে মারা যান। সেই রোগী পল্লী চিকিৎসক আলতাবুর রহমান বাদশার কাছে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। টাকা দিয়ে মাত্র তিন বোতল পানি দিয়েছিলেন বাদশা।
সাহেদ আলীর পরিবার জানায়, প্রায় ৩ মাস আগে পল্লী চিকিৎসক বাদশার কাছে চিকিৎসা নেওয়া হয়। পরে কিছু দিন ভালো থাকলেও পরে ডক্টর সাহেদ আলীর অবস্থা খারাপের দিকে যায়। উপায় না পেয়ে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ২ মাস চিকিৎসার পর মারা যান তিনি।
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে ভুয়া চিকিৎসক আলতাবুর রহমান বাদশার চেম্বার ও গবেষণা কার্যালয়ে যান লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায়। বাড়িতে চিকিৎসা দেওয়ার কারণে তার প্রতিষ্ঠান সিলগালা না করে বন্ধ করে দেন।
সিলেট থেকে আসা এক রোগী বলেন, ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে একটি নম্বরে ফোন দেই। তখন তিনি বলেন, ক্যানসার রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে তিনি বলেছেন, রোগ ভালো করে দেয়ার মালিক আল্লাহ। এই কথা শোনার পর প্রায় দুই বছর চিকিৎসা নিয়েছি। আমার রোগীর কোনো উন্নতি হচ্ছে না বরং খারাপের দিকে যাচ্ছে। চিকিৎসা বাবদ অনেক টাকা নষ্ট করেছি। তার চিকিৎসা নিয়ে প্রতারণার শিকার আমি। তাই তার বিচার দাবি করছি।
ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে চাইলে পল্লী চিকিৎসক বাদশা মিয়া প্রশাসনের অজুহাত দিয়ে সাংবাদিকের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না জানিয়ে বলেন, চিকিৎসা দিয়েছি, বাকিটা আল্লাহ ভরসা। চেম্বার সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় বন্ধ করে দিয়েছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ফোন আরেকজনকে দেন। তিনি বলেন, চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া এত সহজ না। চিকিৎসা না দিলে কি আমরা মরে যাব? বলে তিনি ফোন কেটে দেন।
কাকিনা ইউপি চেয়ারম্যান তাহির তাহু বলেন, আমি নিজেও জানতাম তিনি পল্লী চিকিৎসক। সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায়ের সঙ্গে গিয়ে জানতে পেরেছি, তিনি ক্যানসারের চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। তাই প্রসাশন বন্ধ করে দিয়েছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার রায় অজয় বিটিসি নিউজকে বলেন, দীর্ঘ দিন থেকে তদন্ত করে বোঝা গেছে, তারা ভুল চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে পল্লী চিকিৎসক বাদশা মিয়ার কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় বিটিসি নিউজকে বলেন, শুধুমাত্র পানি দিয়েই চিকিৎসা করে আসছিলেন তিনি। বিষয়টি জানার পরই আমরা তদন্ত করি। তার চিকিৎসার ঘটনাটি শুনলেও এর কোনো সাইন্টিফিক ভিত্তি নেই। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি যদি আবার চিকিৎসা চালু করেন, অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গোপনে চেম্বার চালুর কথা বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদক সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায়’কে মুঠোফোনে জানালে তিনি বলেন, এই মাত্র আপনার মাধ্যমে জানলাম। তিনি কোন ব্যাবস্থা নিবেন কি না এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ (রংপুর) প্রতিনিধি এস এম রাফাত হোসেন বাঁধন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.