ঘন কুয়াশায় আকাশপথ, সড়ক-নৌপথ ও রেলপথ যোগাযোগে বিপর্যয়

বিশেষ (ঢাকা) প্রতিনিধি: দেশের অধিকাংশ এলাকা ঢেকে আছে ঘন কুয়াশার চাদরে। সুর্যের আলোকরশ্মি কুয়াশার ভারি আস্তরন ভেদ করে চরাচরে উজ্জ্বলতা ছড়াতে না ছড়াতেই সন্ধ্যা নামছে। দৃষ্টিসীমা হরণ করছে এই কুজ্ঝটিকার আবছায়া, সেই সাথে হাঁড়কাপানো শীত-শিরশিরে হিমেল হাওয়ায় মানুষের কাহিল দশা।
ফলে আকাশপথ,সড়ক-নৌপথ ও রেলপথ যোগাযোগে বিপর্যয় নেমে এসেছে। কোন ধরনের যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। গত কয়েকদিন ধরে কুয়াশার কারণে চলছে এই দৃশ্যপট।
গতকাল রবিবার নদী তীরবর্তী এলাকায় কোথাও কোথাও দৃষ্টিসীমা ১০ গজে নেমে আসে। সকালের দিকে বহু অঞ্চলে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ার দৃশ্যও অবলোকন করা গেছে। কুয়াশার কারণে দফায় দফায় বন্ধ থাকছে বিভিন্ন নৌপথ। অস্বস্তি সড়কপথেও।
কুয়াশার কারণে টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে গাড়ি চলছে ধীরগতিতে। এতে সেতুর দুই পাড়ে দেখা দিচ্ছে তীব্র যানজট। কুয়াশার কারণে গন্তব্যে যেতে দীর্ঘ সময় লাগছে। রেল চলাচলে শিডিউল বিঘ্নিত হচ্ছে। বিমানবন্দরগুলো থেকে ফ্লাইট উড্ডয়ন-অবতরণে সমস্যা চলছে। কুয়াশার বিরূপ প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে নৌপথে। ফেরি চলাচল মাঝে মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। লন্ডভন্ড হয়ে গেছে বিমানের শিডিউল।
৭ ফ্লাইট গেল কলকাতায়, একটি মিয়ানমারে: ঘন কুয়াশায় রানওয়েতে ভিজিবিলিটি (দৃশ্যমানতা) কম থাকায় ঢাকার হজরত শাহজালাল রহ. আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৮টি ফ্লাইট নামতে না পেরে পাশের দেশ ভারতে এবং একটি ফ্লাইট মিয়ানমারে অবতরণ করেছে। একই কারণে আরও সাতটি ফ্লাইট দেরিতে ছেড়েছে বলে জানা গেছে। শাহজালাল থেকে দেরিতে ছেড়ে যাওয়া এয়ারলাইন্সগুলো হলো-ওমান এয়ার, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, কাতার এয়ারওয়েজ, ইমিরেটস, সৌদি এয়ারলাইনস, হিমালয় এয়ারলাইনস ও ফ্লাই দুবাই এয়ারলাইনস।
শাহজালাল বিমানবন্দরের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক উইং কমান্ডার শাহেদ আহমেদ খান এই তথ্য জানান। কুয়াশার কারণে বিমানবন্দরের রানওয়েতে ভিজিবিলিটি কম থাকার কারণে ফ্লাইটগুলো ঢাকায় নামতে না পেরে চট্টগ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। সেখানে সুবিধা করতে না পেরে পরে তারা কলকাতা বিমানবন্দরকে বেছে নেয়। এছাড়া একটি ফ্লাইট ইয়াঙ্গুনে যায়।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জানান, ফ্লাইটগুলোর পাইলট অবতরণের আগে রানওয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন না। কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকাগামী বাটিক এয়ার, কুয়েত থেকে আসা কুয়েত এয়ারওয়েজ, জাজিরা এয়ারওয়েজ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের দুবাই, বিমানের দাম্মাম, গালফ এয়ারের বাহরাইন ও সালাম এয়ারের মাস্কাট থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইট কলকাতা চলে যায়। পাশাপাশি এয়ার এশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকাগামী একটি ফ্লাইট উড্ডয়নের পর ২ ঘণ্টা উড়ে কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার বিষয়ে জানতে পারে। পরে মাঝ আকাশ থেকে ফ্লাইটটি কুয়ালালামপুর ফিরে যায়। পাশাপাশি সৌদির জেদ্দা থেকে ঢাকাগামী একটি ফ্লাইট তাদের যাত্রা বাতিল করেছে। এদিকে হিমেল হাওয়া আর ঘনকুয়াশায় সৈয়দপুর বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বিঘ্নিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত বৈরী আবহাওয়া কিংবা ঘন কুয়াশার কারণে পাইলট খালি চোখে রানওয়ে দেখতে না পারলে নিরাপদ অবতরণের জন্য বিমানবন্দরগুলোতে ইনস্ট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম বা আইএলএস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।এ পদ্ধতিতে প্রযুক্তির মাধ্যমে পাইলটকে এক ধরনের বেতার তরঙ্গ পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে সহজেই রানওয়ের অবস্থান শনাক্ত করতে পারেন পাইলট। বর্তমানে দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়া কোনোটিতেই নেই বৈরী আবহাওয়ায় উড়োজাহাজ ওঠানামার এ প্রযুক্তি। যে তিনটি বিমানবন্দরে এ প্রযুক্তি আছে তাও পুরোনো। ফলে ঘন কুয়াশা কিংবা ঝড়-বৃষ্টির কারণে দৃষ্টিসীমা কমে এলেই বিঘ্নিত হয় উড়োজাহাজ চলাচল।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যে আইএলএস আছে, তার দৃষ্টিসীমা ৬০০ মিটার। শীতকালে ঘন কুয়াশায় প্রায়ই বিমানবন্দরের রানওয়েতে দৃষ্টিসীমা নেমে আসে ৫০ থেকে শূন্য মিটারে। ফলে পুরনো আইএলএস দিয়ে ফ্লাইট ওঠানামা করানোয় বিঘ্ন ঘটছে। কখনো কখনো উড়োজাহাজগুলোকে নিরাপদ অবতরণে পাঠানো হচ্ছে বিকল্প বিমানবন্দরে। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে এয়ারলাইন্সগুলো।
ঘন কুয়াশায় ১১ ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ, মাঝ পদ্মায় রাতভর আটকা ছয়টি ফেরি:এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে ফেরির মার্কিং লাইটের আলো অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে টানা ১১ ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। শনিবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বন্ধ ছিল ফেরি চলাচল। এসময় উভয় পাড়ে আটকে পড়ে শত শত যানবাহন। দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক শাহ মোহাম্মদ খালেদ নেওয়াজ জানান, রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘন কুয়াশার তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ফেরির মার্কিং লাইটের আলো অস্পষ্ট হয়ে যায়। এতে নৌ-দুর্ঘটনার আশঙ্কা দেখা দেয়। ফলে যাত্রী এবং যানবাহনের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় নৌ-দুর্ঘটনা এড়াতে সাময়িকভাবে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এসময় মাঝ নদীতে চারটি ফেরিকে নোঙর করে রাখা হয়। এদিকে, ঘন কুয়াশার কারণে রাত সাড়ে ৯টা থেকে আরিচা কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। মাঝ নদীতে নোঙর করে রাখা হয় দুইটি ফেরি। সকাল সাড়ে ৯ টায় ঘন কুয়াশার তীব্রতা কেটে গেলে পুনরায় ফেরি চলাচল শুরু হয় এই রুটে।
ঘন কুয়াশায় শিডিউল বিপর্যয়ে ট্রেন: কুয়াশার কারণে উত্তরাঞ্চলের তিনটি ট্রেন দেরি করে পৌঁছায় রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। এতে কিছুটা শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক মাসুদ সারওয়ার সাংবাদিকদের জানান, শনিবার রাতে রাজশাহী ছেড়ে আসা ধূমকেতু এক্সপ্রেস, নীলসাগর এক্সপ্রেস এবং একতা এক্সপ্রেস ঘন কুয়াশার কারণে ঢাকায় পৌঁছাতে দেরি করে। এতে তিনটি ট্রেন দুই ঘণ্টা দেরিতে ঢাকা স্টেশন ছেড়েছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ (ঢাকা) প্রতিনিধি মো: ফারুক আহম্মেদ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.