গণহত্যা: স্মৃতিতে ভাস্বর ‘রাবি বধ্যভূমি’

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুক্তিকামী মানুষদের কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে-হিচড়ে নিয়ে আসা হতো পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে। রাতভর অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতন শেষে ক্যাম্পের কক্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হতো মুক্তি পিপাসুদের মৃত, অর্ধমৃত বা রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত জীবন্ত দেহ।
আর এই দেহগুলো ফেলে দেওয়া হতো আশপাশের কোনো ভাগাড়, জলাশয়, ডোবা কিংবা গর্তে। ঠিক এরকমই এক ইতিহাস রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমির।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হল থেকে পূর্বদিকে কিছুক্ষণ হাঁটলে দেখা যাবে ইটের তৈরী একটি লাল স্তম্ভ। ১৯৭১ সালে রাজশাহীসহ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, যুবক-যুবতী ও মধ্য বয়সী নারী-পুরুষদের ধরে এনে নির্যাতন করতো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। শত শত নিরাপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে নির্যাতন ও হত্যার পর জীবিত বা মৃত অবস্থায় গণকবর দেওয়া হতো।
পাক হানাদার বাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শহীদ শামসুজ্জোহা হলে। টানা ৯ মাস ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে এই হলকে ব্যবহার করে তারা। হলের করিডোর ও কক্ষে হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে বেধড়ক পেটানো হতো মুক্তি পিপাসু বাঙালিদের। তবুও তারা হার মানেনি। উচ্চারণ করেনি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। তাদের চোখে ছিলো বাঁচার স্বপ্ন, মুক্তির স্বপ্ন। শেষ পর্যন্ত বাঁচতে না পারলেও মুক্তি এসেছে ঠিকই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একে একে সন্ধান মিলতে থাকে গণকবর বা বদ্ধভূমির। এমন খবর শুনে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসে স্বজন হারা মানুষেরা পঁচা, গলিত, অর্ধগলিত বিকৃত দেহাবশেষ খুঁজে বের করেছেন। কেউ পরনের জামা, হাতের ঘড়ি-আংটি, শারীরিক গড়ন বা বৈশিষ্ট্য দেখে খোঁজার চেষ্টা করেছেন প্রিয়জনদের। স্বাধীনতার পর রাবির বধ্যভূমির এই গণকবরে স্মতিস্তম্ভ স্থাপনের জন্য মাটি খুঁড়তেই পাওয়া গিয়েছিল অসংখ্য মাথার খুলি ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কঙ্কাল। আজও সেগুলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে।
২০০০ সাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এম. সাইদুর রহমান খান বধ্যভূমির স্মৃতিফলকের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ২০০২ সালে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. রেদোয়ান আহমেদ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। বধ্যভূমির সমতল ভূমি থেকে ৪২ ফুট উঁচু এবং ৬ স্তর বিশিষ্ট একটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে।
স্তম্ভ ঘিরে একটি কংক্রিটের বেদি এবং বেদির মাঝখানে বড় একটি কূপ। স্তম্ভের গায়ের কালো ছাপ দেশের স্বাধীনতায় অবদান রাখা শহীদদের রক্ত শুকানো দাগের প্রতীক। অন্যদিকে কূপটিকে ‘মৃত্যুকূপ’ এর সঙ্গে তুলনা করা হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ অক্টোবর রাজশাহী মহানগরীর বালিয়াপুকুর এলাকা থেকে ধরে আনা হয় আব্দুল মান্নান নামের এক ব্যক্তিকে। তখন তার বয়স ছিল ২১ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জোহা হলে পাক সেনাদের নির্যাতনের বর্ণনা দেন তিনি।
আব্দুল মানানের ভাষ্যমতে, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য দিতে তাকে ধরে আনা হয়। তাদের সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে না পারায় প্লাস দিয়ে তার আঙ্গুলের নখ তুলে ফেলার চেষ্টা করা হয়। সেই ক্ষত এখনও তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। তার এক আত্মীয় মীর রহমতকেও সেদিন তুলে আনা হয়েছিল। বেয়নেটের খোঁচায় মীর রহমতের চোখ তুলে ফেলেছিল পাক বাহিনী।
তিনি আরও জানান, পাক সেনাদের নির্যাতনে এক সময় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে তার বস্ত্রহীন নিথর দেহকে মৃত ভেবে বধ্যভূমির সেই জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়। জ্ঞান ফেরার পর দেখেন চারপাশ পঁচা লাশের স্তুপ। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে নাকে আসছে পঁচা রক্ত ও দেহের ভ্যাপসা গন্ধ। সেখান থেকে বেঁচে ফিরে আসেন তিনি।
স্মৃতিস্তম্ভটি বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ১৯৭১ সালের ভয়াল দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়ার আহবান জানাচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজশাহী অঞ্চলের আশেপাশের অগণিত মানুষকে হত্যা করে এই জায়গাতে ফেলা হতো। তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আজকের সুন্দর বাংলাদেশ। প্রতি মুহূর্তে তাদের আত্মত্যাগ স্মরণ করার জন্য এ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ যতদিন বেঁচে থাকবে শহীদদের স্মৃতিও ততদিন বেঁচে থাকবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মো. মাসুদ রানা রাব্বানী / রাজশাহী। #

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.