ইউক্রেনে ১৯৩০-এর দশকে দুর্ভিক্ষে মারা যান লাখ লাখ মানুষ

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইউক্রেনে ১৯৩৩ সালের বসন্তকালে এমন এক দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, যাতে মারা যান লাখ লাখ মানুষ। সেই সময় এক স্কুলছাত্রী মারিয়া ভলকোভা। তার শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে মিশে আছে সেই ক্ষুধার অভিজ্ঞতা। 
মারিয়া ভলকোভা বলেন, আমার বয়স তখন তিন কী চার, কিন্তু তখনকার পরিস্থিতি এখনও আমার পুরোপুরি মনে আছে।
তখন আমার ঘরে খাওয়ার কিছু ছিল না। আমরা ঘরে ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করতাম, মা আমাকে কিছু একটা খেতে দিতে পারো?
তখন তিনি বলতেন, তুমি বাইরে গিয়ে চেরিগাছ থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে নিয়ে খাও না।
এই দুর্ভিক্ষ ছিল মানবসৃষ্ট। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন তখন দেশের গ্রামগুলোর ওপর তার কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দিচ্ছিলেন।
সেটি ছিল এক বিরাট কর্মসূচি। অতীতকাল থেকে সেখানকার কৃষকরা যেভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন এবং মুনাফা সৃষ্টিকারী কৃষিকাজ করে আসছিলেন, তা উচ্ছেদ করা হচ্ছিল।
জমি আর গবাদিপশু তখন রাষ্ট্র-পরিচালিত যৌথ খামারের অঙ্গীভূত করে নেওয়া হচ্ছিল। কেউ এর বিরোধিতা করলে তা নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছিল।
এতে ইউক্রেনের সমাজে একটা তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দেখা দিল ব্যাপক অনাহার।
মারিয়া বলেন, তারা দেখেছেন গ্রামগুলোর বয়স্ক মানুষ বা ছোট ছোট শিশুরা কীভাবে ব্যাগ হাতে নিয়ে খাবারের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা করত।
তিনি বলেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে— আমি কাঁদছিলাম আর মাকে বলছিলাম, মা ওই বাচ্চাগুলো আবার খাবার চাইতে এসেছে। মা বলতেন, আমি কীভাবে ওদেরকে কিছু দেব? দেখতে পাচ্ছ না আমরা নিজেরাই না খেয়ে আছি?
ক্রেমলিন ১৯৩২ সালে শস্যের ফলনের যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল, তা পূরণ হলো না।
কর্তৃপক্ষ তখন কমিউনিস্ট কর্মীদের পাঠিয়ে দিল খাদ্যশস্য বাজেয়াপ্ত করার জন্য। বাইরের বিশ্ব এ নিয়ে প্রায় কিছুই জানতে পারেনি।
কিন্তু গ্যারেথ জোনস নামে এক তরুণ ওয়েলশ সাংবাদিক প্রতিজ্ঞা করলেন, কী হচ্ছে তা খুঁজে বের করবেন। তিনি রুশ ভাষা জানতেন।
নানা কৌশলে তিনি মস্কোর বিদেশি সাংবাদিকদের ওপর আরোপিত কড়া নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে একটা ট্রেন ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষুধাপীড়িত এলাকায় চলে গেলেন। পরে তিনি এক রিপোর্টে লিখেছিলেন দুর্ভিক্ষের এ বিবরণ।
এতে তিনি লেখেন, প্রতিটি ছোট ছোট স্টেশনে ট্রেন থামছিল। ওই সময়টাতেই একজন লোক আমার দিকে এগিয়ে এলো কানে কানে জার্মান ভাষায় বললেন, ইংল্যান্ডের লোককে জানাও যে আমরা অনাহারে আছি। এর কিছু পরেই ঠিক করলাম, আমি ট্রেন থেকে নেমে পড়ব।
গ্যারেথ জোনস বলেন, আমি গ্রামগুলোতে ঢুকলাম। কয়েকটা কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছিল সেখানে যাওয়ার পথটার ওপর বরফ জমে ছিল।
প্রথম যার সঙ্গে দেখা হলো, তাতেই আমি দুর্যোগের আভাস পেলাম। এক নারী মাথা নিচু করে রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। তিনি বললেন, কোনো রুটি নেই। আমরা গত দুই মাস কোনো রুটি খাইনি। অনেক লোক এখানে মারা যাচ্ছেন।
ওই এলাকার শত শত কৃষকের মুখে আমি একই কথা শুনেছি। এটি ছিল মধ্যাঞ্চলীয় ব্ল্যাক আর্থ এলাকা। রাশিয়ার সবচেয়ে উর্বর অঞ্চলগুলোর একটি।
আমি গ্রামের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, রুটি নেই তা হলে আপনারা খাচ্ছেন কী? তিনি বললেন, এতদিন পর্যন্ত আমরা কিছু আলু খাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাদের যা মজুত ছিল তা শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু গরু-ছাগলের খাবার আছে।
তিনি আমাকে দেখালেন তারা কি খাচ্ছেন। এটা হচ্ছে এক ধরনের শক্ত বীট, যা গরুকে খাওয়ানো হয়। কিন্তু এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের আলু বা বীট— কোনোটাই নেই। তারা মারা যাচ্ছেন।
মারিয়ার মনে আছে যে কীভাবে কয়েক বছর ধরে এই অনাহারের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। বাগানে কোনো কিছু বোনার মতো শক্তি কারও ছিল না। সে বছর (১৯৩১) কোনো ফসল হয়নি।
ছেলেমেয়েরা কী করছে তার দিকে কেউ নজর দেয়নি। আমরা এত ক্ষুধার্ত ছিলাম যে মাটিতে গজায় এমন যে কোনো কিছু খেতাম। আমার মনে আছে, আমি একবার একটা আগাছা পেয়েছিলাম। সেটার গোড়াটা আমি খেতে গিয়ে দেখলাম, তা এতই তেতো যে, আমার মনে হলো— এটি হয়তো বিষাক্ত কিছু হতে পারে।
আমার মুখে বাদামি দাগ পড়ে গেল, কিন্তু তার পর ভালো লাগল। মনে হলো এটা হয়তো আমার জন্য উপকারী কিছু হবে, ওটা খেয়ে আমি খানিকটা জোর পেলাম। তার পর যা হলো, গ্রামের সব ছেলেমেয়ে এসে ওই আগাছাটা খুঁজতে লাগল।
মারিয়া ভলকোভার বাবা একপর্যায়ে তার বাইসাইকেলটা বিক্রি করে দিয়ে এক বালতি শস্য কিনলেন। কিন্তু সেই রাতেই সোভিয়েত গোপন পুলিশ এসে সেই শস্য বাজেয়াপ্ত করল। মারিয়ার বাবাকে গ্রেফতার করা হলো। তাকে জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো।
দুর্ভিক্ষে এক একটি পরিবারের সবাই মারা যাচ্ছিল। ছেলেমেয়েদের বাবা-মাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ছোট বাচ্চা আছে এমন মহিলা ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজছিল। তারা অনেকে আগাছা খাচ্ছিল।
জোনস তার বর্ণনায় লিখেছেন, তিনি নিজেও আগাছা খেয়েছেন। কিছু আগাছার শিকড় আমি নিজেও খেয়ে দেখেছি। দেখতাম বরফের ফাঁক দিয়ে আগের বছর গজানো আগাছার শুকনো ডালপালা বেরিয়ে আছে। একজন বুড়ো চাষি আমাকে থামাল। মাঠের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল— একসময় এই জায়গাটা ছিল খাঁটি সোনা। এখন সব আগাছায় ভরে গেছে।
আগে একসময় আমাদের ঘোড়া, গরু ও মুরগি ছিল। এখন আমরা ক্ষুধার জ্বালায় মারা যাচ্ছি। একসময় আমরা সারা দুনিয়ার খাবারের জোগান দিতাম। এখন ওরা সব নিয়ে গেছে। আমাদের আর কিছুই নেই। ওরা আমাদের মেরে ফেলছে।
তিনি আরও লিখেছেন— যেসব কৃষকের কুটিরে আমি ছিলাম, সেখানে খেতে দেওয়া হতো শুধু খুব ময়লা আর পানসে একটা স্যুপ। তাতে থাকত দু’এক টুকরো আলু। সেই কুটিরের ওপর মৃত্যুভয়ের ছায়া পড়েছিল। কারণ তাদের কাছে আগামী ফসল ওঠার আগে পর্যন্ত চলার মতো আলু অবশিষ্ট ছিল না।
আমি দক্ষিণের উদ্দেশে রওনা দিলাম। শুনলাম গ্রামবাসী বলছেন, এখানে তো অবস্থা খারাপ, লোক মারা যাচ্ছে। কিন্তু দক্ষিণের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ। তুমি পোলটাভা অঞ্চলে যাও, সেখানে দেখবে শত শত খালি কুঁড়েঘর।
পরিস্থিতি তখন এতই সঙ্গীন আকার নিয়েছিল যে, তখন মানুষ মানুষের মাংস খাচ্ছে— এমন খবরও পাওয়া গিয়েছিল। কিছু কৃষক চেষ্টা করেছিল শহর এলাকায় গিয়ে খাবার সন্ধানের। কিন্তু সেখানেও প্রায় কিছুই ছিল না।
মারিয়া ভলকোভা বরৈন, মাদের গ্রামে কোনো রুটি পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই আমার মা শহরে গিয়েছিলেন। তাকে সারারাত ধরে লাইন দিতে হতো রুটির জন্য। কপাল ভালো থাকলে সে এক টুকরো রুটি পেত।
মারিয়া বলছিলেন, একবার সম্ভবত ১৯৩২ সালের শীতে, মা পুরো এক সপ্তাহের জন্য বাড়ির বাইরে ছিলেন। তিনি প্রতি রাতে লাইন দিতেন। আর রুটির টুকরোগুলো জমাতো আমাদের জন্য।
খারকিভ শহরে গ্যারেথ জোনস দেখেছিলেন খাবারের জন্য মানুষ কত বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। (সূত্র: বিবিসি)। #   

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.