আমি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারের মেয়ে পপি বলছি

বিশেষ (নাটোর) প্রতিনিধি: আমি গর্বিত তিনি আমার পিতা। একাত্তরের একজন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, বিজয়ী বীর। তিনি যখন রণাঙ্গনে, তখনও আমার জন্ম হয় নি। ফলে তাঁর সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছি কম।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র’ কর্তৃপক্ষ ১৯৭১ সালের একটি ছবি প্রকাশ করে। ছবিতে আমার পিতা ছাড়াও চারজনকে দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে জীবিত দুইজনের মুখ থেকে শুনে ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই লেখাটি তৈরি করেছেন সাংবাদিক রেজাউল করিম খান।

নাটোর সদর থানার তেলকুপি গ্রামের আব্দুস সাত্তার ফকির পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৬৬ সালের ১১ মে। তখন তার বয়স ১৭ বছর। ট্রেনিং শেষে তাকে পাঠানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৭০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি ছুটি পেয়ে বাড়িতে আসেন।

১৯ ডিসেম্বর দেশে সাধারণ নির্বাচন শেষ হয়। নির্বাচনে পাকিস্তান গণপরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি আসন। অর্থাৎ তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় ক্ষমতা গ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করে।ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বিজয় উল্লাস করতে থাকে। কিন্তু অচিরেই সেই আনন্দ দুঃশ্চিনায় পরিণত হয়।

নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে চলতে থাকে আলাপ আলোচনা। ইত্যবসরে পাকিস্তানী সামরিকজান্তা পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে থাকে। এই সমস্ত খবর শুশে পূর্ব বাংলার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ছাত্ররা স্বাধীনতার ডাক দেয় এবং পূর্ব বাংলার মানচিত্র অঙ্কিত পতাকা উত্তোলন করে।

ঢাকা থেকে থানা, সর্বত্র শুরু হয় আন্দোলন। চলতে থাকে মিছিল-শ্লোগান। আব্দুস সাত্তারও ঘরে বসে থাকতে পারেন না। তিনিও যোগ দেন আন্দোলন-সংগ্রামে। তেলকুপি থেকে মিছিল নিয়ে আসেন নাটোর শহরে। মিছিল শুরু হয় ১৫ থেকে ২০ জনে, শেষ হয় আড়াই শ’ থেকে তিন শ’ জনে।

এমনই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে চলে আসে ৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধু হাজির হলেন রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে। মাঠ তখন জনসমুদ্র। জনগণ বাঁশের লাঠি হাতে নেতার নির্দেশ শোনার অপেক্ষায়। তিনি দিলেন তাঁর সেই ১৮ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণ। বললেন স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে। সভাশেষে লক্ষ মানুষের স্রোত ছড়িয়ে গেলো দেশের সর্বত্র। বস্তুত, ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল একটি অগ্নিমশাল, যার আলো পৌঁছে গিয়েছিল সমগ্র পূর্ব বাংলায়।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে নাটোর থেকে ঢাকায় গিয়েছিলেন তৎকালীন মাননীয় এমপি বাবু শংকর গোবিন্দ চৌধুরী, মাননীয় এমপি জনাব আশরাফুল ইসলাম, মাননীয় এম এন এ ডাঃ মোবারক হোসেন এবং জনাব সৈয়দ মোতাহার হোসেনসহ আরো বেশ কয়েকজন। নাটোরে ফিরে তাঁরা সেই গল্প সবিস্তারে বলেন স্থানীয় নেতাকর্মীদের।

এমনিতেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে নাটোরের জনগণের মাঝেও জাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী ৯ই মার্চ থেকে নাটোরে সংগ্রাম পরিষদ গঠন শুরু হয়। প্রথমে বাগাতিপাড়া এবং পরে নাটোর সদর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেকগুলো সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। প্রতিদিন শত শত মানুষের মিছিল হতে থাকে। আব্দুস সাত্তার ফকিরও সংগ্রাম কমিটির সদস্য হন। শুরু হয় যুদ্ধের প্রস্তুতি আর সামরিক প্রশিক্ষণ।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর আলোচনা ব্যর্থ হলে ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ঢাকাসহ কয়েকটি বড় শহরে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে গণহত্যা শুরু করে। এই খবর পরদিন সারাদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

ক্ষুব্ধ, ব্যথিত, উন্মত্ত মানুষ ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকার সাথে পাবনা শহরে ১৩০জনের ২৫ নম্বর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি দল বাঙালি নিধন শুরু করে। কিন্তু বিপুল সংখ্যক জনতা তাদের প্রতিরোধ করে। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এতে অনেক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও আহত হয়।

এই খবর দিয়ে ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টারে সাহায্যের আবেদন জানানো হয়। তাদের সাহায্যার্থে মেজর রাজা আসলাম আরও সৈন্য ও ভারী অস্ত্রসহ পাবনা পৌঁছায়। কিন্তুু অবস্থা বেগতিক দেখে কেবল আহতদের নিয়ে রাজশাহীর দিকে রওনা দেয় ।

নাটোরের জনতা রাস্তায় প্রতিরোধ গড়েছে, এমন সংবাদ পেয়ে তারা ঈশ্বরদী বিমান বন্দরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দাশুড়িয়ায় জনতার প্রতিরোধের মুখে গ্রামের পথে ঢুকে পড়ে। উদ্দেশ্য ঈশ্বরদী বিমান বন্দরে পৌঁছানো। কিন্তু গোপালপুর রেলক্রসিংয়ের কাছে এসে দেখে সেখানে একটি ওয়াগন দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া আছে।

এদিকে হাজার হাজার জনতা লাঠি, সড়কি, বল্লম নিয়ে ওদের ঘিরে ফেলে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ওরা পূর্ব দিকে সরে গিয়ে ওয়ালিয়ার ময়না গ্রামে পৌঁছায়। চন্দনা নদী পার হতে না পেরে ৩০ মার্চ গ্রামের সৈয়দ আলী মোল্লার বাড়ি সংলগ্ন আমবাগানে আশ্রয় নেয় এবং নৈমুদ্দিনের বাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করে।

সেখান থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এই খবর দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আর নাটোর ও লালপুরের ছুটিতে থাকা ও অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনাসদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, তীরন্দাজ আাদিবাসীসহ সর্বস্তরের মানুষ ময়না গ্রামে গিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের ঘিরে ফেলেন। অন্যদের সাথে আব্দুস সাত্তার ফকিরও সেই যুদ্ধে অংশ নেন। শুরু হয় প্রাণপন প্রতিরোধ যুদ্ধ।

দীর্ঘ সময়ের এই অসম যুদ্ধে শহীদ হন অন্তত ৪০ জন বাঙালি। ইতিমধ্যে রাত নামে। থেমে যায় গুলির শব্দ। কিন্তু জনতা পিছু হঠে না। সাধারণ অস্ত্র নিয়ে গড়ে তোলা ওই প্রতিরোধের মুখে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথে পাকিস্তানী সেনাদের মধ্যে মেজর রাজা আসলাম ওরফে খাদেম হোসেন রাজাসহ সাতজন গমের জমিতে ধরা পড়ে। উত্তেজিত জনতা তাদের পিটিয়ে হত্যা করেন।

এপ্রিলের শুরুতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পূর্ণ শক্তি নিয়ে নাটোরে এসে অবস্থান নেয়। প্রথমেই তারা স্থানীয় অবাঙালিদের সহায়তায় খুঁজতে থাকে হিন্দু, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক, প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও পাকিস্তানবিরোধী যুবকদের। তারা বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে, নির্বিচারে হত্যা, লুট, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালিয়ে এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

ভীত-সন্ত্রস্থ মানুষ নাটোর ছেড়ে পালাতে থাকে। নেতারা আগেই নাটোর ছেড়েছিলেন। পরে যে যেভাবে পারে প্রত্যন্ত গ্রাম বা ভারতের দিকে যেতে থাকেন। ওই সময় আব্দুস সাত্তার পিপরুল ইউনিয়নের কুমুদবাটি গ্রামের আব্দুল করিম মন্ডলের বাড়িতে কয়েকদিন অবস্থান করেন।

একদিন পাকিস্তানী সৈন্যরা পাশের গ্রাম বাঁশিলায় হামলা করে। ওরা কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেয় আর গরু-ছাগল ধরে নিয়ে যায়। ওই সময় গ্রামে কোনো লোক ছিল না। পরদিনই তিনি বগুড়া হয়ে হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যান।

যুবক আব্দুস সাত্তার প্রথমে পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট থানার মধুপুরে একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। এর পূর্বেই নওগাঁর আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল ৭৪ জন যোদ্ধা নিয়ে বালুরঘাটে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে বাঙ্গালীপুর,মধুপুর, কামাড়পাড়া,প্যারিলাসহ ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় বেশ কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালনা করেন।

ঐসব ক্যাম্প থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের শিলিগুড়ির পানিঘাটায় পাঠিয়ে দেয়া হতো। নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, বগুড়া, নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিলের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এইসব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

নাটোরের তৎকালীন ছাত্রনেতা নবাব সিরাজ-উজ-দৌলা কলেজের প্রথম বর্ষ বিকমের ছাত্র ও মহকুমা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন সেলিম চৌধুরী। ওই সময় সেলিম চেীধুরী বালুরঘাট বাঙ্গালীপুর ক্যম্পে উপস্থিত হন।

তিনি প্রথমে সেখানে ও পরে শিলিগুড়িতে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে প্রশিক্ষণ শেষে নওগাঁয় প্রবেশ করেন এবং সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোখলেসুর রহমান রাজার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন।

২৫শে অক্টোবর নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক দুঃখজনক ঘটনা। মান্দা উপজেলার মৈনম উচ্চবিদ্যালয়ে অবস্থিত রাজাকারদের শক্তিশালী ঘাঁটি ধ্বংসের লক্ষ্যে মোখলেসুর রহমান রাজা ও ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাঝরাতে ওই ক্যাম্পে হামলা চালায়।

সেলিম চৌধুরীও এই অপারেশনে অংশ নেন। ক্যাম্প আক্রমণের সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা এসে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সফল অভিযান শেষে মুক্তিবাহিনী তাদের শেল্টারে ফিরে গেলেও পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রক্তক্ষরণের কারণে অসম সাহসী সেলিম চৌধুরী আর ফিরতে পারেন নি।

আহত অবস্থায় তিনি পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। এরপর জিপের পেছনে বেঁধে নওগাঁ শহর ঘোরানোর ফলে তাঁর মৃত্যু হয়। পরবর্তীকালে সেলিম চৌধুরীর সাথে সাক্ষাতের ঘটনাটি মনে পড়লে আব্দুস সাত্তার অত্যন্ত বিমর্ষ হতেন।

আব্দুস সাত্তার কয়েকদিন ক্যাম্পে অবস্থানের পর ইনচার্জ তাকে গেরিলা যুদ্ধে যোগদানের জন্য আসা তরুণদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেন। সেখানে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তার সাথে যোগ দেন সাইফুল ইসলাম (জাফরপুর, আক্কেলপুর, জয়পুরহাট), খলিলুর রহমান (বলরামপুর, আক্কেলপুর, জয়পুরহাট), মোজাম্মেল হক(রানীনগর বাজার, নওগাঁ) ও মোজাহারুল ইসলাম দোগাছী, নওগাঁ) সহ আরও অনেকে।

এই পাঁচজন ওই সময় বালুরঘাটের বুড়িমা স্টুডিওতে একটি ছবি তোলেন, যা এর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। ওই ক্যাম্পে বাঙালি সেনা সদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, শ্রমিক, চাষি, দিনমজুর প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় এক শ’ মানুষের একটি গেরিলা দল গঠিত হয়। ক্যাম্পে যে রেশন দেয়া হতো তা মোটেই ভালো ছিল না।

চাল-ডাল ছিল অনেকটাই নিম্নমানের। কারও ভালো একসেট সার্ট-প্যান্ট ছিল না। অধিকাংশ সময় পরনে থাকতো লুঙ্গি আর গেঞ্জি। ট্রেনিংয়ের সময় হাফ প্যান্ট। পিটি করার উপযুক্ত একজোড়া কাপড়ের জুতাও জুটতো না। কিন্তু এইসব অভাব অভিযোগের কথা মনেই আসতো না। চিন্তা কেবল একটাই, কিভাবে দেশকে শত্রুমুক্ত করা যায়। যাই হোক, সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে আব্দুস সাত্তারদের দলটি দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

জুন মাসের প্রথম দিকে তাঁরা নওগাঁর ধামুইরহাট থানার পাগলাদেওয়ান সীমান্তে পাকিস্তানী সৈন্যদের মুখোমুখি হয়। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে বেশিক্ষণ টিকতে না পারলেও একজন পাকিস্তানী অফিসার ও অপর কয়েকজনকে হত্যা করেন। এছাড়া ওদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিল।

ওই যুদ্ধে পাকিস্তানীরা মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হককে (জামালগঞ্জ, আক্কেলপুর, জয়পুরহাট) ধরে নিয়ে যায়। অপর সহযোদ্ধা আফজাল হোসেন (মুরাদপুর, নওগাঁ) গুলিবিদ্ধ হন। তাকে নিয়ে আব্দুস সাত্তার ও মেজাহারুল ইসলাম প্রায় দুই মাইল দূরে বালুরঘাট হাসপাতালে ভর্তি করান। পরের সপ্তাহে পতœীতলা থানার খড়মপুর, বিলঘড়িয়া, কুলপদপুর, মালাহার, লক্ষণপুর ও সনড়া এলাকায় বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন। ওইসব যুদ্ধে কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন রায় সিং। মাঝে মধ্যে নেতৃত্ব দিয়েছেন নওগাঁর শালুকা গ্রামের হাবিলদার নফরউদ্দিন।

এক পর্যায়ে যুদ্ধ শেষ হয়, পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে; রয়ে যায় তাদের অবর্ণনীয় ধ্বংসযজ্ঞের বেদনাদায়ক চিহ্ন। স্মৃতির জানালায় দেখি, লক্ষ শহীদের শোণিতধারা, বাতাসে ভেসে আসে নির্যাতিত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার আর্তনাদ। আর যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা দেখেছেন একটি নতুন দেশ; এইতো বড় শান্তনা।

কিন্তু স্বাধীনতার পরও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার ফকির বেশিদিন শান্তিতে বসবাস করতে পারেন নি। ১৯৭২ সালে তিনি যুবলীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮০ সালে পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হন।

২০০৪ সালে জেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে মৃত্যুকালীন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যার পর সেনাবাহিনী আব্দুস সাত্তারকে আটক করে।

আটকের পর প্রথমে নাটোর কানাইখালী আনসার ক্যাম্প ও পরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজ ক্যাম্পাসে তার ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। এক সময় মৃত ভেবে সেনাসদস্যরা তাকে পুকুরপাড়ে ফেলে রাখে।

সেখান থেকে অনেক কষ্টে বাড়ি ফেরা। এরপর অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে ২০১২ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদার তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার ফকির,
জন্ম: ৮ই মে, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু: ৪ঠা জানুয়ারি, ২০১২ খিস্টাব্দ।
পিতা: মৃত হাতেম আলী, মাতা: মৃত আবজান নেছা,
স্ত্রী: আলেয়া বেগম,
বড়ভাই মুক্তিযোদ্ধা আফছার ফকির।
শ্বাশুড়ি: হেমলতা,
বোন: মরিয়ম নেছা।
গ্রাম: তেলকুপী, উপজেলা: নাটোর সদর, জেলা: নাটোর।
বর্তমান ঠিকানা:-মহল্লা: লালবাজার, উপজেলা ও জেলা: নাটোর।
লাল মুক্তিবার্তা নম্বর: ৩০৪০১০০৭৪
বেসরকারি মুক্তিযোদ্ধা গেজেট নম্বর: ৪৪, তারিখ: ১৭ এপ্রিল, ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরিত সনদ নম্বর: ৪৪৪৩৯, তারিখ: ১ জুলাই, ২০০১ খ্রিস্টাব্দ।
সেক্টর নম্বর: ৭, সেক্টর অধিনায়ক মেজর নাজমুল হক। সেপ্টেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মেজর
নাজমুল হক নিহত হওয়ার পর লেঃ কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান সেক্টর অধিনায়কের দায়িত গ্রহণ
করেন। এই সেক্টরে ট্রুপস ছিল ২ হাজার ৩১০ জন সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর গেরিলা সদস্য ছিলেন
প্রায় সাড়ে ১২ হাজার।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ (নাটোর) প্রতিনিধি মো. নাসিম উদ্দিন নাসিম। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.