অটোফেজি ও রোযা: একটি পর্যালোচনা
নিজস্ব প্রতিবেদক: সাওম আরবি শব্দ সাওম অর্থ বিরত রাখা, বারন করা বা ফিরিয়া রাখা, সাওম এর বহু বচন সিয়াম, রোযা ফারসি শব্দ, পবিত্র কুরআনে সাওম ও সিয়াম বলে উল্লেখ রয়েছে। আমাদের দেশে ফারসি শব্দ রোযা ব্যাপকভাবে প্রচলিত।
রোযার উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভ। ‘তাকওয়া’ অর্জনই হলো সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য।
তাকাওয়া আরবি শব্দ। এর অর্থ বাঁচা, মুক্তি ভয়ভীতি সতর্কতা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষার আল্লাহর ভয়ে-ভীতি হয়ে আল্লাহ নির্দেশিত ও রাসূল (সা.) প্রদর্শিত পথে সতর্কতার সহিত জীবন যাপন করা। রমযানের রোযা পালনের উদ্দেশ্য হলো মানুষের পশু প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে নৈতিকতা বা আত্মিক উন্নতি সাধন করা।
শরীরিক উপকারের জন্য রোযা পালনের কথা কুরআান হাদিস থেকে প্রমাণিত নয়। যদিও বর্তমানে রোযা প্রসঙ্গে আলোচনায় অটোফেজি প্রসঙ্গ চলে আসছে। প্রথমে সিয়াম নিয়ে কুরআন আর হাদিছ থেকে কিছু আয়াত ও আলোচনা একত্রিত করছি, পরে অটোফেজি নিয়ে আলোচনায় আসব।
সূরা বাকারাহ’র ১৮৩তম আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ (183)
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেজগারী অর্জন করতে পার।” (২: ১৮৩)
রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন: যে ব্যক্তি রোযা রেখে ও মিথ্যা কথা বলা, পরনিন্দা ও অন্যান্য পাপাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারল না তার পানাহার পরিত্যাগ করা আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (সহীহ্ বুখারী)।
সিয়াম সাধনা হলো সত্যিকার অর্থে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের সাধনা। এ সন্তুষ্টি অর্জন করা তখনই সম্ভব যখন তার দেহ ও আত্মা হবে তাওকওয়ার রঙে রঙিন। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, রোযা আমারই জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব।
আল্লামা আবু ওবায়েদের ব্যাখ্যায় বলেন,
রোযাকে বিশেষভাবে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করার কারণ, অন্যান্য ইবাদতে লোক দেখানোর সম্ভাবনা থাকে কিন্তু রোযাতে তা থাকে না, রোযা শুধু আল্লাহর জন্যই হয়।
ইমাম গাজ্জালী (রা.) বলেন, আখলাকে ইলাহী তথা আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে হলে প্রয়োজন মানুষের পশু প্রবৃত্তিকে পরিতথ্যাগ করে তাকওয়া তথা আহারে-ব্যবহারে চাল-চলনে কথাবার্তায় সতর্কতার সহিত জীবনযাপন করা।
রাসূল (সা.) বলেছেন, রোযা জান্নাম থেকে বাঁচার ঢালস্বরূপ যতক্ষণ না সে ঢাল বিনষ্ট করে ফেলে। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে বিনষ্ট হয় ইয়া রাসূলুল্লাহ! তিনি বলেন, মিথ্যা এবং পরনিন্দা দ্বারা, সিয়াম বিনষ্ট হয়। (বোখারী, তিরমিযি)
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে পাশব প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে, যারা সত্যিকারের ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করেন; তাদের জন্য সুসংবাদ হলো: সকল নেক কাজই দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত সওয়াব বৃদ্ধি করা হয়। আর রোযা এর থেকে স্বতন্ত্র। এর প্রতিদান আল্লাহ নিজেই দেবেন, তা হবে নিশ্চয়ই অফুরন্ত। (মুসলিম)
রোজা বা সিয়াম সাধনা আল্লাহর অন্যতম বিধান যা শুধু ইসলামের বিধান নয়, পূর্ববর্তী ধর্মগুলোতেও রোযার বিধান ছিল। যারা একমাস ধরে দিনের বেলায় সব ধরনের খাদ্য-দ্রব্য ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে দূরে থাকে, তারা অন্যের ধন-সম্পত্তির ব্যাপারে নিজের লোভ-লালসাকে দমন করতে সক্ষমতা লাভ করে। রোযা মানুষকে উদার হতে শেখায়। যারা একমাস ধরে ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করে তারা ক্ষুধার্তদের কষ্ট বুঝতে পারে এবং তাদের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে ও সহানুভূতিশীল হয়। রোযা গুনাহ বা পাপ বর্জনের পরিবেশ সৃষ্টি করে। বেশীরভাগ পাপ পেটপূজা ও ইন্দ্রিয় পরায়ণতা থেকেই জন্ম নেয়। রোযা এই দুই প্রবৃত্তিকে দমনে রেখে সমাজে দুর্নীতি ও পাপ হ্রাস করে এবং খোদাভীরুতা বা পরহেজগারিতা বাড়ায়।
কুরআন-হাদিসের এসব আলোচনা থেকে বুঝা যায়, রোযার মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া, পরহেজগারী অবলম্বন করা, পাপ বর্জনের পরিবেশ সৃষ্টি করা।
রমজানে কুরআন নাযিল হয়েছে, এ মাসে শবে কদরের রাত্রি রয়েছে ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা করা যেতে পারে। আমি একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনায় যেতে চাইছি।
সুরা বাকারার ১৮৪নং আয়াতটি উদ্ধৃতি করলাম।
أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (184)
“রোযা নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের জন্য ফরজ। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় ওই সংখ্যক রোযা রাখতে হবে। রোযা যাদের জন্য কষ্টদায়ক যেমন অতি বৃদ্ধদের জন্য, তারা অবশ্যই একজন অভাবগ্রস্তকে অন্নদান করবে।”
যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেশি সৎ কাজ করে, তা তার জন্য বেশী কল্যাণকর হয়। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে, তবে বুঝতে রোযা রাখাই তোমাদের জন্য বেশী কল্যাণকর। (২: ১৮৪)
এই আয়াতে একটি বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে, যদি আমাদের উপলব্ধিতে আসে তবে আমরা বুঝতে পারব রোযা আমাদের জন্য কল্যাণকর।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জাপানের বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি নিয়ে এলো মানবজাতীর মানসপটে এক নতুন উপলব্ধি যার নাম অটোফেজি।
প্রাণীকোষ কীভাবে নিজের উপাদানকে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে, এই গবেষণার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
প্রথম দিনে সুইডেনের কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী হিসেবে ওহশোমির নাম ঘোষণা করলো। পুরস্কার হিসেবে তিনি ৮ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার বা ৯ লাখ ৩৬ হাজার ডলার পাবেন।
নোবেল কমিটির মতে, ইয়োশিনোরির গবেষণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ক্যান্সার থেকে শুরু করে পারকিনসন্স পর্যন্ত রোগগুলোর ক্ষেত্রে শরীরে কী ধরনের পরিবর্তন হয় তা বুঝতে তার গবেষণাটি সহায়তা করে।
Autophagy কি? এবার তা বলি।
Autophagy শব্দটি একটি গ্রিক শব্দ। Auto অর্থ নিজে নিজে, এবং Phagy অর্থ খাওয়া। সুতরাং, অটোফেজি মানে নিজে নিজেকে খাওয়া।
না, মেডিক্যাল সাইন্স নিজের গোস্ত নিজেকে খেতে বলে না। শরীরের কোষগুলো বাহির থেকে কোনো খাবার না পেয়ে নিজেই যখন নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে, তখন মেডিক্যাল সাইন্সের ভাষায় তাকে অটোফেজি বলা হয়।আরেকটু সহজভাবে বলি।
আমাদের ঘরে যেমন ডাস্টবিন থাকে, অথবা আমাদের কম্পিউটারে যেমন রিসাইকেল বিন থাকে, তেমনি আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের মাঝেও একটি করে ডাস্টবিন আছে। সারা বছর শরীরের কোষগুলো খুব ব্যস্ত থাকার কারণে, ডাস্টবিন পরিষ্কার করার সময় পায় না। ফলে কোষগুলোতে অনেক আবর্জনা ও ময়লা জমে যায়।
শরীরের কোষগুলো যদি নিয়মিত তাদের ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে না পারে, তাহলে কোষগুলো একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে শরীরে বিভিন্ন প্রকারের রোগের উৎপন্ন করে। ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের মত অনেক বড় বড় রোগের শুরু হয় এখান থেকেই।
মানুষ যখন খালি পেটে থাকে, তখন শরীরের কোষগুলো অনেকটা বেকার হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা তো আর আমাদের মত অলস হয়ে বসে থাকে না, তাই প্রতিটি কোষ তার ভিতরের আবর্জনা ও ময়লাগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে। কোষগুলোর আমাদের মত আবর্জনা ফেলার জায়গা নেই বলে তারা নিজের আবর্জনা নিজেই খেয়ে ফেলে। মেডিক্যাল সাইন্সে এই পদ্ধতিকে বলা হয় অটোফেজি।
জাস্ট এ জিনিসটা আবিষ্কার করেই জাপানের ওশিনরি ওসুমি (Yoshinori Ohsumi) ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কারটা নিয়ে গেল।
স্পষ্টত মুসলমানরা রোযা রাখলে তাকে বলা হয় ‘সিয়াম’। খ্রিস্টানরা রোযা রাখলে তাকে বলা হয় ‘ফাস্টিং’। হিন্দু বা বৌদ্ধরা রোযা রাখলে তাকে বলা হয় ‘উপবাস’। বিপ্লবীরা রোযা রাখলে তাকে বলা হয় ‘অনশন’। আর, মেডিক্যাল সাইন্স রোযা রাখলে তাকে বলা হয় ‘অটোফেজি’।
সিয়াম বা ফাস্টিং, উপবাস, অনসন যে নামে বা পদ্ধতিতে পালন করা হোক না কেন অটোফেজি মানুষের উপলব্ধি আসার পর আধুনিক মানুষ রোযাকে অধিকতর কল্যাণকর হিসাবে বুঝতে পারছে। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.