বিশেষ (ঢাকা) প্রতিনিধি: স্বাক্ষরিত হলো বহুল প্রত্যাশিত ঐতিহাসিক ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’। জাতি পেলো দেশ পরিচালনার নির্দেশনামূলক নতুন ‘অঙ্গীকারনামা’। ১৭ অক্টোবর তারিখটি ক্যালেন্ডারের পাতায় ‘ইতিহাস’-এর তালিকায় লিপিবদ্ধ হলো। এখন থেকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভার্ষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দিবসের মতোই ১৭ অক্টোবর তারিখে জুলাই জাতীয় সনদ দিবস হিসেবে পালিত হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সাড়ে ১৩ মাসের মাথায় জাতির ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দলিল ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ প্রণয়ন এবং স্বাক্ষরিত হলো। বাংলাদেশের আগামী দিনের পথচলায় তথা আইনের শাসন, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকারগুলোর ক্ষেত্রে এ সনদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
গতকাল শুক্রবার জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ স্বাক্ষর উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জাতীয় সংসদের দক্ষিণপ্লাজায় আয়োজিত এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাবৃন্দ, দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিদেশি কূটনীতিক, দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের উপস্থিতিতে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ এ স্বাক্ষর করে বিএনপি, জামায়াতসহ দেশের ২৫টি রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক জোট। মূলত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল ২৫টি হলেও বিভিন্ন জোট ও ফ্রন্ট মিলে এই দলের সংখ্যা অর্ধশতাধিক।
এ সময় সনদে নিজে স্বাক্ষর করে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নকারী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই সনদকে গণঅভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে অবিহিত করে এই সনদ স্বাক্ষরকে অভ্যুত্থানের ‘দ্বিতীয় অংশ’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
তিনি ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান সফলের পেছনে আত্মত্যাগকারীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ড. মোহাম্মদ ইউনূস বলেন, জাতি আজ এক নবজন্মের সন্ধিক্ষণে। এই ঐতিহাসিক পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের কারণে, বিশেষ করে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের কারণে।
সংবিধান ও সরকার পরিচালনায় এ সনদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের সুযোগে জাতি পুরোনো ও অপ্রয়োজনীয় আলোচনা বাদ দিয়ে নতুন বিষয়গুলোকে জাতীয় জীবনে নিয়ে এসেছে। এই পরিবর্তনের মূল বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সংবিধানের পরিবর্তন এবং সরকার পরিচালনার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়।
জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ স্বাক্ষরিত হবে ১৭ জুলাই এ জন্য গত কয়েক দিন ধরে প্রস্তুতি চলছিল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একদিন আগে সনদ প্রণয়নে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠক করেন। বৈঠকের আগে দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের কপি পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো কোনো দল জুলাই সনদে কিছু সংশোধনী আনার দাবি জানায়। শেষ মুহূর্তে সনদে কিছু সংশোধনী ও সংযোজন করা হয়। তারপরও কিছু দল সনদে স্বাক্ষর না করার কথা জানায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া কিছু ছাত্রের রাজনৈতিক দল এনসিপির জুলাই সনদের স্বাক্ষর না করাকে ‘রাজনৈতিক ভুল’ হিসেবে অবিহিত করেন।
তারা বলেন, জুলাই ঘোষণার সময়ও এই দলের কয়েকজন নেতা কক্সবাজার গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে এমন ভুল সিদ্ধান্ত দলটির ভবিষ্যত রাজনীতি অনিশ্চিত করে তুলবে এবং দলটির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত ভারত ও আওয়ামী লীগকে সুবিধা দেবে। আর বাম ধারার কয়েকটি দল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ প্রীতির কারণে জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার ঘোষণা দেয়। তবে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ তাকিয়ে ছিল জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের দিকে। দিনে হঠাৎ করে বৃষ্টির কারণে অনুষ্ঠান আয়োজনে কিছুটা বিঘ্ন ঘটে। এমনকি জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হলেও ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে রেওয়াজ অনুযায়ী কুরআন তিলাওয়াত করা হয়নি। তবে মাগরিবের নামাজের সময় অনুষ্ঠানের কার্যক্রম কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখা হয়। সকাল থেকেই অনুষ্ঠান স্থলে উৎসুক জনতার ভিড় বাড়তে থাকে। অসুস্থ জুলাই যোদ্ধাদের ব্যানারে কয়েক শ’ মানুষ সেখানে হাজির হয়ে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া করলেও তাদের সরিয়ে দেয়া হয়। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানস্থলে আসা শুরু করলে পাল্টে যায় গোটা দৃশ্য। দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ও হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইতিহাসের নুতন অধ্যায়ের সূচনা করেন।
জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামা: গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঐতিহাসিক ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ স্বাক্ষরিত হয়। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে জনগণের ত্যাগ ও রক্তদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রণীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এই সনদ বাস্তবায়নে মোট সাত দফা অঙ্গীকার করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া’-এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে অঙ্গীকারনামা শুরু হয়েছে।
প্রথম অঙ্গীকার হিসেবে বলা হয়েছে, জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য যে দীর্ঘ সংগ্রাম চলেছে, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান সেই লড়াইয়ের ঐতিহাসিক মোড়। হাজারো মানুষের জীবনদান ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সুযোগে প্রণীত জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে।
দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, জনগণ যেহেতু রাষ্ট্রের মালিক, তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে এই সনদ গ্রহণ করছে। তাই সনদটি সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা উপযুক্তভাবে সংযুক্ত করার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে।
তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদের বৈধতা বা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা হবে না; বরং এর প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
চতুর্থ অঙ্গীকার হিসেবে বলা হয়, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের জন্য জনগণের ১৬ বছরের সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হবে।
পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, গণঅভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকান্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব। (স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে জুলাই যোদ্ধাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ দফা সংশোধন করা হয়। এতে নতুন করে লেখা হয়, ‘শহীদ পরিবারকে এবং জুলাই আহতদের রাষ্ট্রীয় বীর, আহত জুলাই বীর যোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান যেমন: মাসিক ভাতা, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং শহীদ পরিবার ও আহত বীর যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করব)।
ষষ্ঠ দফায় সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ কাঠামো ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এসব বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় আইন, বিধি ও প্রবিধি সংশোধন বা নতুনভাবে প্রণয়ন করার অঙ্গীকার করা হয়েছে।
সপ্তম দফায় উল্লেখ করা হয়, জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেগুলো দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করবেÑ কোনো প্রকার বিলম্ব ছাড়াই।
জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫-এর ভিত্তি হচ্ছে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান, যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত। ওই সময়ে হাজার হাজার নাগরিক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দুঃশাসন, রাষ্ট্রীয় দমন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও সামাজিক অন্যায়-বঞ্চনার প্রতিবাদে সড়কে নেমেছিলেন। সেই আন্দোলনে সহস্রাধিক মানুষ নিহত হন (জাতিসংঘের অনুসন্ধানে এক হাজার ৪০০ জন) এবং ২০ হাজারের অধিক মানুষ আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেন। একপর্যায়ে চব্বিশের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে পালিয়ে যান এবং ভারতে আশ্রয় নেন।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশনের সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও অতিথিরা অংশগ্রহণ করেন। ২৫টি দলের নেতারা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন এবং সনদে স্বাক্ষর করেন।
স্বাক্ষরিত দলগুলো এবং দলের প্রতিনিধিরা হচ্ছেন:
১. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ;
২. বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার;
৩. বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ ও মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ;
৪. লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য নেয়ামূল বশির;
৫. খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের;
৬. রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম ও মিডিয়া সমন্বয়ক সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন;
৭. আমার বাংলাদেশ পাটির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ;
৮. নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার;
৯. জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ও মহাসচিব মোমিনুল আমিন;
১০. গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল;
১১. জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ও সিনিয়র সহসভাপতি তানিয়া রব;
১২. গণ অধিকার পরিষদের (জিওপি) সভাপতি নুরুল হক ও সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান;
১৩. বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ও রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য বহ্নিশিখা জামালী;
১৪. জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার লুৎফর রহমান;
১৫. ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম;
১৬. ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রফেসর আশরাফ আলী আকন ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান;
১৭. গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান;
১৮. জাকের পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম ভুইয়া ও গাজীপুর জেলা ছাত্র ফ্রন্টের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হাসান শেখ;
১৯. জাতীয় গণফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক আমিনুল হক টিপু বিশ্বাস ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মঞ্জুরুল আরেফিন লিটু বিশ্বাস;
২০. বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল মাজেদ আতহারী ও মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার;
২১. বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়্যারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব খন্দকার মিরাজুল ইসলাম;
২২. ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ রফিকুল ইসলাম (বাবলু) ও মহাসচিব মোহাম্মদ আবু ইউসুফ (সেলিম);
২৩. জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহসভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী ও মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী;
২৪. ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল কাদের ও মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী;
২৫. আমজনতার দলের সভাপতি কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক মো. তারেক রহমান।
আরো উপস্থিত ছিলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব শাইখুল হাদিস ড. গোলাম মুহিউদ্দিন ইকরাম, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির আমির আল্লামা সারওয়ার কামাল আজিজী, মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি আল্লাম আব্দুর রব ইউসুফী ও মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা অ্যাডভোকেট আব্দুর রকীব, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন ও মুফতি শারাফত হোসেন, খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন, নায়েবে আমির মাওলানা আহমাদ আলী কাসেমী।
অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদের নেতারা যাননি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুই পর্বে আলোচনা করে জুলাই সনদ তৈরি করেছে। প্রথম পর্বে ৩৩টি ও দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে তারা। জাতীয় পার্টিকে এই আলোচনায় রাখা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫২টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে। প্রেস উইং জানিয়েছে, অনুষ্ঠানে জুলাই শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান এবং শহীদ তাহির জামান প্রিয়র মা শামসী আরা বেগম মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পর দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আজকে ঐকমত্যে আমরা যেরকম সনদ করলাম, তেমনি রাজনীতির ব্যাপারেও, নির্বাচনের ব্যাপারেও আপনারা রাজনৈতিক নেতারা বসে একটি সনদ করেন, কীভাবে নির্বাচন করবেন। যেমন- তেমন করে নির্বাচন করলে তো আবার পুরোনো জায়গায় ফিরে যাওয়া। এত কিছু করে লাভটা কী হলো তাহলে? এই কথা লিখে আমার লাভ কি হলো? কথা লিখলাম, কথা মানলাম না। কাজের মধ্যে গিয়ে মানলাম না।
কাজেই আমার অনুরোধ, আপনারা আবার ঐকমত্য কমিশন বলেন, কমিটি বলেন, নিজেরা বসুন। নির্বাচনটা কীভাবে সুন্দরভাবে করবেন, উৎসবমুখর করবেন, ইতিহাসে স্মরণীয় করে ধরবেন।
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই সুর, যে সুর আজকে আমরা এখানে বাজালাম, সেই সুর নিয়ে আমরা নির্বাচনের দিকে যাব। ঐক্যের সুর। ঐক্যের সুর দিয়ে আমরা নির্বাচনের দিকে যাব। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে এবং এই ঐক্য যেন বজায় থাকে। এই সনদের মাধ্যমে আমরা আর একটা বড় কাজ করলাম। আমরা বর্বরতা থেকে সভ্যতায় আসলাম। আমরা এক বর্বর জগতে ছিলাম, যেখানে আইন-কানুন ছিল না। মানুষের ইচ্ছায় যা ইচ্ছা তা করতে পারত। এখন আমরা সভ্যতায় আসলাম এবং এমন সভ্যতা আমরা গড়ে তুলব, মানুষ বিস্ময় চোখে আমাদেরকে দেখবে। কাজেই সেটা এখন আমাদের পরবর্তী জীবন এই সনদ-পরবর্তী জীবন আমরা কীভাবে গঠন করব, তার উপর নির্ভর করবে।
ড. মুহাম্মদ বলেন, আমাদের যে সম্পদ আছে, যেটি আমরা ব্যবহার করতে পারিনি এ পর্যন্ত, আমি বারে বারে যেটার কথা উল্লেখ করিÑ এটি হলো বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগর আমাদেরই অঞ্চল, আমাদেরই বাংলাদেশের অংশ। কোনোদিন আমরা খেয়াল করে দেখিনি এই অংশে আমরা কী করি। এই অংশ অত্যন্ত সম্পদশালী অংশ। আমরা বলছি যে, এটি আমরা পূর্ণ ব্যবহার করতে চাই, সম্পদকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আমরা আর তর্ক-বিতর্কের মধ্যে থাকতে চাই না। সে জন্যই আজকে সনদ হলো। এই সনদ তর্ক-বিতর্কের অবসান করবে। আমরা নিয়মমতো চলে যাব। আমরা এখন নিয়ম মাফিক চলার জন্য তৈরি হয়েছি।
তিনি বলেন, আমি বারে বারে বলছি যে, আমরা যদি সমুদ্রবন্দর করে দিই, তাহলে সারা দুনিয়ার জাহাজ আমাদের বন্দরে ভিড়তে বাধ্য হবে। আমাদের পণ্য সিঙ্গাপুরে খালাস করে দিয়ে চলে যেতে হবে না। অন্য দেশের পণ্য সিঙ্গাপুরে খালাস করে দিয়ে যেতে হবে না। আমার দুয়ার পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারবে এবং অন্যান্য দেশের যারা সুযোগ দিতে পারবে না, তাদের পণ্য এখানে দেয়া যাবে। আমাদের এখান থেকে তারা নিয়ে যাবে। কাজেই একটি বিরাট সুযোগ।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের পরিকল্পনায় যদি আমরা মাতারবাড়ি, কক্সবাজার, মহেশখালী সবকিছু মিলিয়ে আমরা যদি একযোগে বন্দর উন্নত করি, তাহলে পুরো এলাকা নতুন সিঙ্গাপুরে পরিণত হবে। এটা নির্ঘাত। এটার থেকে কেউ বাইরে যেতে পারবে না এবং সব দেশের মানুষ এখানে আসবে। আমরা আমাদের অর্থনীতির অংশ হিসেবে আঞ্চলিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারি। আমরা নেপালে, ভুটানে, সেভেন সিস্টার্সে তাদের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি শুধু এই বন্দরের কারণে, এই যোগাযোগের কারণে। তারাও সমৃদ্ধ হবে, আমরাও সমৃদ্ধ হবো। কাজেই এই সুযোগগুলো আছে, যদি আমরা পথমত ঠিকমতো চলতে পারি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ এর অঙ্গীকারনামার ৫নং দফার পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে জুলাই বীর যোদ্ধাদের দাবির প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রয়োজনীয় জরুরি সংশোধন করা হয়েছে।
অঙ্গীকারনামার ৫নং দফার সংশোধিত ভাষ্যটি তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, গণঅভ্যুত্থানপূর্ব বাংলাদেশে ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান কালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত সকল হত্যাকান্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারকে এবং জুলাই আহতদের রাষ্ট্রীয় বীর, আহত জুলাই বীর যোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান যেমন: মাসিক ভাতা, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং শহীদ পরিবার ও আহত বীর যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।
কমিশনের সহ-সভাপতি জানান, কমিশন এই অঙ্গীকারনামা বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকারকে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে উপস্থাপন করবে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দল এবং ঐকমত্য কমিশনের কোনো মতপার্থক্য নেই।
তিনি বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি নয়। এ হচ্ছে নাগরিকের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর এবং রাষ্ট্রের একটি সামাজিক চুক্তি।
এ সময় কমিশনের সদস্যদের মধ্যে বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ, আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. মহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিভিন্ন সেক্টরে ব্যপক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে গত বছর তিন দফায় বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের লক্ষ্যে ১১টি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনগুলো বিভিন্ন সংস্কারের সুপারিশ করে। ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আলোচনার জন্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়।
এ কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ। ১৩ ফেব্রুয়ারি গঠনের পর ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে এ কমিশন প্রায় আট মাস ধরে তিন ধাপে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ প্রণয়ন করে। এর আগে ১৬ আগস্ট রাতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো পূর্ববর্তী খসড়ায় কিছু ত্রুটি থাকায়, তা সংশোধন করে নির্ভুল খসড়া প্রেরণ করা হয়। এরপর ২০ আগস্ট কমিশনের পক্ষ থেকে খসড়াটির ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর যেকোনো ধরনের মতামত প্রদানের সময় ২২ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সবার মতামত পর্যালোচনা করে এবং নির্ভুল আকারে জুলাই সনদ লিখিত আকারে চূড়ান্ত করে গত ১৪ অক্টোবর সনদের চূড়ান্ত কপি প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছে তুলে দেয়া হয়। অতঃপর ১৫ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শেষ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সর্বশেষ জুলাই যোদ্ধাদের দাবির প্রেক্ষিতে জুলাই জাতীয় সদন অঙ্গীকারনামায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ (ঢাকা) প্রতিনিধি মো: ফারুক আহম্মেদ। #