হাটেও ক্রেতা-বিক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি মাশুল : পথে পথে চলছে চাঁদাবাজী, রংপুর বিভাগে শেষ মুহুর্তে জমে উঠেছে পশুর বেচাকেনা, দাম কম হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারি ও ব্যক্তি পর্যায়ের চাষীরা

রংপুর ব্যুরো:  ঈদ-উল আজহার ঠিক ৪ দিন আগেই রংপুর বিভাগে জমে উঠেছে পশু বেচাকেনার হাটগুলো। রাতদিন একাকার করে চলছে বেচাবিক্রি। বরাবরের মতো হাটগুলোতে  ক্রেতা-বিক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। পাশাপাশি পথে পথে চলছে পশুবাহি পরিবহনে বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজী। যদিও এবার পশুর দাম অপেক্ষাকৃত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যক্তি পর্যায় এবং খামার পর্যায়ে পশু লালনপালনকারীরা। এবারও এই অঞ্চলে কোরবানীর পশুর চাহিদার তুলনায় ১ লাখ পশু বেশি থাকার কথা জানিয়েছে বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তর।

রংপুর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের উপপরিচালক মোঃ হাবিবুর রহমান বিটিসি নিউজকে জানান, রংপুর বিভাগের আট জেলায়  কোরবানীর জন্য মোট পশুর চাহিদা ৮ লাখ ১০ হাজার ৬৭৫ টি। এর বিপরীতে এই অঞ্চলে পশু মজুদ আছে  ৯ লাখ ১১ হাজার ১৫১টি। এরমধ্যে গরু মহিষ ৫ লাখ ৮১ হাজার ২১৮ টি, ছাগল-ভেড়া ৩ লাখ ২৯ হাজার ৪৫৭ টি এবং অন্যান্য পশু আছে ৪৭৬ টি। এতে দেখা যায় কোরবানীর পশু উদ্বৃত্ত আছে ১ লাখ ৪৭৬ টি।

এই কর্মকর্তা আরও জানান, এই অঞ্চলে এবার ১ লাখ ২ হাজার ৫১৬ টি ছোটবড় খামার ও ব্যক্তি পর্যায়ে এসব গবাদিপশু লালনপালন হয়েছে। তিনি আরও জানান, এবারের বন্যায় রংপুর বিভাগের রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার ২৪টি উপজেলার ১৪৬ টি ইউনিয়নের ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৮ টি গবাদিপশু এবং ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮৪ টি হাঁস মুরগি বন্যা কবলিত হয়। এরমধ্যে ২৪ টি গবাদিপশু ও ৫৩ টি মুরগীর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যায় ৫টি গরু, ১৪৬ টি ছাগল ভেড়া ও ৫ হাজার ২৬৫ টি হারস মুরগি মারা যায়। এবার বন্যা কবলিক এলাকায় ৭ হাজার ২০০ একর চারণভূমিক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব মিলে প্রয় ২০ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয় এই বন্যায়। তিনি জানান, কোরবানীর আগ মুহুর্তে এই বন্যার কারণে গো খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় পশু উত্পাদনে খরচও বেড়ে যায়। এতে চাষীরা ঘরে গরু রাখতে চাইছেন না। বাাজরে পশুর আমদানি বেড়েছে। একারণে অপেক্ষাকৃত এবার দাম কম। সেকারণে যে হারে চাষীরা লাভবান হওয়ার কথা তা হচ্ছে না।

সরেজমিনে রংপুরের বড় বড় পশুবেচাকেনার তারাগঞ্জহাট, বদরগঞ্জহাট, বড়াইবাড়ীহাট, লালবাগহাট, বুড়িরহাট, চৌধুরানীহাট, নজিরেরহাট, নিসবেতগঞ্জহাট, পাওটানাহাট, কান্দিরহাট, দেউতিহাট, টেপামধুপুরহাট, মিঠাপুকুরহাট, বৈরাতিহাট, জায়গীয়হাট, শঠিবাড়ীহাট, বালুয়াহাট, মাদারগঞ্জহাট ও ভেন্ডাবাড়ীহাটসহ বিভাগের বিভিন্ন এলাকার বড়বড় হাট থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ১৫ দিন আগে থেকেই এবার হাটগুলোতে প্রচার গরুর আমদানি আছে। কিন্তু বেচাকেনা ছিল কম। ৭ দিন আগে পশু বেচাবিক্রি শুরু হয়েছে। এখন বিক্রি হচ্ছে বেশি। বড় বড় হাটগুলোতে প্রতিতিন প্রায় ৩ থেকে ৫ হাজার টি করে গরু ছাগল বিক্রি হচ্ছে।

তবে হাটগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছ থেকেই টোল আদায় করা হচ্ছে। নিয়মানুযায়ী শুধু ক্রেতার কাছ থেকে টোল তোলার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। হাটগুলোতে বিক্রেতাদের কাছ থেকে গরু প্রতি রশিদ ছাড়াই ১৫০ থেকে ৩০০ এবং ক্রেতাদের কাছ থেকে ৪০০ থেকে ৭০০টাকা এবং প্রতি ছাগলে বিক্রেতাদের কাছ থেকে ৫০ থেকে ১৫০ ও ক্রেতার কাছ থেকে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ইজারাদাররা অবৈধভাবে আদায় করছেন। শুধু ইজারাদাররাই নয়, গরু হাটে আনতে পথে পথে টাকা গুনতে হচ্ছে বিক্রেতাদের। মোড়ে মোড়ে পরিবহন আটকিয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন এবং মওসুমি চাঁদাবাজরা ধমক দিয়ে বিভিন্ন রেটের টাকা আদায় করছেন। ঝামেলা এড়াতে ক্রেতা-বিক্রেতারা বাধ্য হয়ে টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছেন।

রংপুরের শঠিবাড়ি হাটের ইজারাদার লালন বিটিসি নিউজকে জানান, আমরা রশিদ মুলে কেবল বিক্রেতাদের কাছ থেকে ৪০০ করে টাকা গ্রহন করছি। এর বেশি আমরা কোন টাকা উত্তোলন করছি না।

পীরগাছার দেউতিহাটে কথা হয় আব্দুল হাকিম নামে এক ব্যবসায়ীর সাথে। তিনি জানান, গত বছরের চেয়ে হাটে পশুর আমদানি বেশি।  আজ শুক্রবার পাওটানাহাটে গরু কিনতে আসা আব্দুস ছালাম বিটিসি নিউজকে জানান, তিনি দুপুর থেকে হাটে রয়েছেন। গরুর দাম সহনশীল পর্যায়ে আছে। লালবাগ হাটের স্থানীয় ব্যাপারী আনছার আলী জানান, হাট এখন জমে উঠেছে। তবে গরুর দাম কম।

এদিকে যেমন দামই হোক না কেন গরু ছেড়ে দিতে চাইছেন লালনপালনকারীরা। কারণ এবার গো খাদ্যের দাম বেড়েছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ধানের গুড়া ৩৮ কেজির বস্তা বিক্রি করা হচ্ছে ৩৮০ টাকা থেকে ৪০০ টাকায়, ৩৭ কেজি গমের ভুষির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২২০ টাকা থেকে ১হাজার ৪২০ টাকায়, গমের বস্তা চিকন ভুষি  ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি করা হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকায়। ডাবলি ১৫ কেজির বস্তা বিক্রি করা হচ্ছে ৬০০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকা, মুসর ডাবলি ৩০ কেজির বস্তা বিক্রি করা হচ্ছে ৮২০ টাকা থেকে ৯০০ টাকায়। চালের খুদি ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি করা হচ্ছে ৯০০ টাকা থেকে ৯৮০ টাকা, ভুট্টার গুড়া প্রতি ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি করা হচ্ছে ৯২০ টাকা থেকে ৯৬০ টাকা ও গরুর ফিড প্রতি ২৫ কেজির বস্তা বিক্রি করা হচ্ছে ৫৮০ টাকা থেকে ৯৩০ টাকায়।

রংপুরের কাউনিয়ার হারাগাছ মডেল কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক হারাগাছ আজিজুল ইসলাম দুলাল বিটিসি নিউজকে জানান, শিক্ষকতার পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য বছর পাঁচেক আগে রংপুরের লালবাগ হাট থেকে ২৪ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে একটি গাভি ক্রয় করি। সেই গাভি থেকে প্রথম দুই বছরে ২টি বাছুর হলেও সেটি তারা মারা যায়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেস সপ্তাহের এক সোমবার ওই গাভিটি থেকে জন্ম হয় একটি নুদনুদে বকনা বাছুরের। সোমবার জন্ম হওয়ার কারণে আমার মেয়ে আতিয়া আজিজা সেটির নাম দেয় সম্রাট। সেদিন থেকেই স¤্রাট নামে বড় হতে থাকে গরুটি। এখন স¤্রাটের বয়স আড়াই বছর পার হয়েছে। এখন ৩০ মনেরও বেশি গোশত হবে। গরুটিকে বড় করতে প্রতিদিনই প্রায় ৬০০ টাকা করে খরচ করতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু গরুটি বড় করতে এ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে আমার সাড়ে ৫ লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত দাম উঠেছে ৬ লাখ টাকায়। আশা ছিল আড়াই বছর লালনপালনের পর কমপক্ষে হলেও ৭ থেকে ৮ লাখ টাকায় গরুটি বিক্রি করবো। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি।

রংপুরের মাদারগঞ্জের বাসিন্দা পীরগঞ্জ প্রেসক্লাবের কোষাধ্যক্ষ সাংবাদিক আব্দুল হাকিম ডালিম বিটিসি নিউজকে জানান, প্রায় ৩ বছর ধরে একটি ষাঁড় আমি লালনপালন করি। এক মাস আগে থেকে রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন হাট এবং বিভিন্নভাবে দেনদরবার করছি বিক্রির জন্য কিন্তু হয় নি। বাধ্য হয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকায় ভাটারায় ৩০০ ফিট সাইফ নগর হাটে গরু নিয়ে এসেছি। এখানে ২ লাখ টাকার বেশি দাম বলছে না। গরুটি লালন পালন করতে আমার ২ লাখেরও বেশি টাকা খরচ হয়েছে। এবার গরুর দাম কম হওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছি। গরু লালন পালনের  ইচ্ছে মিটে গেছে আমার।

এদিকে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্রাচার্য বিটিসি নিউজকে জানান, গবাদিপশুর হাটে এবং পথে সব ধরনের চাঁদাবাজী বন্ধে পোশাকীর পাশাপাশি সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। কেউ চাঁদাবাজী করার চেস্টা করলে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে। এছাড়াও কোরবানীর হাটে জাল টাকা এবং মলম পার্টি চক্র সনাক্তে বিশেষ টিম কাজ করছে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর রংপুর ব্যুরো প্রধান সরকার মাজহারুল মান্নান। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.