সংসার ছেড়ে রাজপথে পাটকল শ্রমিকরা অনশনের তৃতীয় দিন

খুলনা ব্যুরো:  সংসার-মিল ছেড়ে তিন’দিন তিন’রাত রাজপথে কাটালো দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকরা। খুলনা-যশোর অঞ্চলের নয়টি পাটকলের শ্রমিকরা পাঁচটি প্যান্ডেলে জড়ে হয়ে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এ প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করেছে। কবে নাগাদ এ কর্মসূচির ইতি ঘটবে তার কোন হিসাব নেই।
খালিশপুরের দৌলতপুর ও স্টার জুট মিলের শ্রমিকরা বিআইডিসি রোডে, প্লাটিনাম, ক্রিসেন্ট ও খালিশপুর জুট মিলের শ্রমিকরা স্ব স্ব মিলের সামনে এবং আটরা শিল্পাঞ্চলের আলিম ও ইষ্টার্ণ জুট মিলের শ্রমিকরা ইষ্টার্ণ গেটে একটি প্যান্ডেল করে আমরণ অনশন শুরু করেছে। শুধুমাত্র নওয়াপাড়ার রাজবাধের জেজেআই ও কার্পেটিং জুট মিলের শ্রমিকরা আন্দোলনের সাথে একাত্ম থাকলেও মিলের উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে।
পাটখাতে প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ, বকেয়া মজুরী- বেতন পরিশোধ, জাতীয় মজুরী ও উৎপাদনশীলতা কমিশনের রোয়েদাদ ২০১৫ কার্যকর, অবসর প্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের পিএফ ও গ্র্যাচুইটির অর্থ পরিশোধ, চাকুরীচ্যুত শ্রমিক-কর্মচারীদের পূর্নবহাল সহ ১১ দফা দাবিতে পাটখাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, বকেয়া মজুরী ও বেতন পরিশোধসহ ১১ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে দ্বিতীয় দফায় এ অনশন কর্মসূচি শুরু হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে এ কর্মসূচি চলছে।
গত ১০ থেকে ১৩ ডিসেম্বর অনশন কর্মসূচি স্থগিত করার পর যখন সর্বশেষ ২৬ ডিসেম্বর বাস্তবায়ন হয়নি তখন শ্রমিক নেতারা ঢাকা থেকে স্ব স্ব মিল এলাকায় ফিরে ২৮ ডিসেম্বর গেট সভা করে ২৯ ডিসেম্বর দুপুর থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
কর্মসূচিতে সব শ্রমিক না আসলেও অধিকাংশই কাথা-বালিশ, লেপ-তোষক, কম্বল নিয়ে অনশনস্থলে শামিল হয়েছেন। এমন কিছু শ্রমিকের সাথে গতকাল সোমবার ( ৩০ ডিসেম্বর)  কথা হলে তারা তাদের ক্ষোভের কথা জানান। কেউ কেউ বলেন, জুট মিলে চাকরী করতে এসে ভুল করেছি। একই মিলে চাকরী করে একই বাজার করে যখন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে শ্রমিকদের বিশাল তারতম্য দেখা যায় তখন আর স্ত্রী-স্তানদের মুখ দেখানো যায় না।
আটরার ইষ্টার্ণ জুট মিলের শেখ আজিবর রহমান বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, এখন আর তাদের যাওয়ার কোন জায়গা নেই। একই মিলের আতিয়ার শেখ বলেন, অর্থাভাবে তার একটি মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। একটি প্রতিবন্ধী ভাই আর বৃদ্ধ পিতার সমন্বয়ে তার পরিবারের পাঁচজন সদস্যের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি।
একদিকে কাজ নেই অপরদিকে অনশন কর্মসূচিতে শুধু তিনি একাই নন, পরিবারের সবাইকেই অভুক্ত থাকতে হচ্ছে। দোকান থেকে বাকীতে বাজার করতে হচ্ছে। রুহুল আমিন নামের অপর শ্রমিক বলেন, মিলের উৎপাদিত পণ্য ঠিকই বিক্রি হয় কিন্তু শ্রমিকদের মজুরী হয়না। বিক্রিত টাকা কই যায় সে প্রশ্নও করেন তিনি।
মিলের প্রায় ৫০% শ্রমিক ব্যাংকের ডেভিট কার্ড বন্ধক রেখে টাকা এনে তা দিয়ে সংসার চালাচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। অনেকের সন্তানদেরই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
আলিম জুট মিলের শ্রমিক মো: আলতাফ হোসেন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, পানি বাদে সব কিছুই তার কিনে সংসার চালাতে হয়। ছয় সপ্তাহ ধরে মজুরী পাচ্ছেন না তিনি। মো: হাবিবুর রহমান নামের এক শ্রমিক রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলো ধংসের জন্য বিজেএমসিকে দায়ী করেন। আতিয়ার শেখ নামের এক শ্রমিক বলেন, ছয়জনের সংসারে তিনি একাই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
ইষ্টার্ণেও মো: নজরুল ইসলাম বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, মজুরী বকেয়া থাকায় দোকান থেকে বাকী দেয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। মো: ইলিয়াস বলেন, স্কুলেও ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করতে চায় না। টাকা না দেওয়ায় ফলাফল দিতে চায়না।
এ অবস্থায় চতুর্মুখি সংকটের মধ্যে রয়েছেন তারা। মো: মহসীন হাওলাদার বলেন, বিগত কোরবানীর ঈদে শ^শুর বাড়ি থেকে পাওয়া একটি গরু বিক্রি করে তিনি সংসার চালাচ্ছেন।
এদিকে, অনশনের প্রথম দিনে রোববার রাতে খালিশপুর জুট মিলের এক শ্রমিক অসুস্থ হয়েছেন। আ: গনি(৫০) নামের ওই শ্রমিককে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
এদিকে গতকাল দ্বিতীয় দিনের অনশন চলাকালে বক্তৃতা করেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-ননসিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক মোঃ মুরাদ হোসেন, মোঃ সোহরাব হোসেন, সাহানা শারমিন, হুমায়ুন কবির খান, আবু দাউদ দ্বীন মোহাম্মদ, শ্রমিক নেতা কাওসার আলী মৃধা, মোঃ খলিলুর রহমান, সেলিম আকন, সেলিম শিকদার, মনিরুল ইসলাম শিকদার, মোঃ আবু হানিফ, সাহাজান সিরাজ মোঃ তরিকুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, আবু হানিফ, তবিবর রহমান, আলমগীর হোসেন, সিরাজুল ইসলাম লিয়াকত হোসেন, মো: আলাউদ্দিন, সাইফুল ইসলাম লিটু প্রমুখ।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনরত শ্রমিকদের গণ-অনশন কর্মসূচি চলাকালীন গতকাল সন্ধ্যায় গণশিল্পী ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, খুলনা জেলা কমিটির সভাপতি কমরেড মিনা মিজানুর রহমান খালিশপুর অঞ্চলে অনশনরত শ্রমিকদের সংহতি প্রকাশ করে বক্তৃতা ও দীর্ঘক্ষণ গণসংগীত পরিবেশন করেন।
শিল্পী মিনা মিজান অনশনরত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে মহান মে দিবসের কথা স্মরণ করে বলেন, বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের দাবি আদায়ের সংগ্রামে যে শিক্ষা শ্রমিক শ্রেণি ইতোপূর্বে কাজে লাগিয়েছেন তা আবার পাটকল শ্রমিকদের সেই শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। শিল্পী প্রথমেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির সংগীত ‘জাগো জাগো সর্বহারা’, তারপর ১৮৮৬’র ১লা মে ‘ও দুনিয়ার মজদুর এক হও’, ‘এই পতাকা শ্রমিকের রক্ত পতাকা’, ‘মিছিল চলছে জনতার’সহ শিল্পী বিভিন্ন গণসংগীত পরিবেশন করে অনশনরত শ্রমিকদের উজ্জীবিত করেন। শিল্পীর পরবর্তী কর্মসূচি আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আটরা শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের গণ-অনশনে।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের ১১ দফা  দাবির প্রতি পুনঃ সংহতি প্রকাশ করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ খুলনা মহানগর নেতৃবৃন্দ।
গতকাল সোমবার ইস্টার্ণ জুট মিল শ্রমিকদের আমরন অনশনের মঞ্চে গিয়ে এই সংহতি প্রকাশ করেন। খুলনা নগর ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সংহতি প্রকাশ করে বলেন, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-ননসিবিএ সংগ্রাম পরিষদের ডাকে মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন, বকেয়া মজুরি পরিশোধসহ ১১ দফা দাবি আদায়ে গত ২৩ নভেম্বর থেকে পাটকল শ্রমিকরা আন্দোলনে রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মজুরি না পেয়ে চরম অর্থ সংকটে রয়েছে তারা। পরিবার-পরিজনের মুখের আহার যোগাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে খেটে খাওয়া এইসব বঞ্চিত মানুষের। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা এই শ্রমিক ও তাদের পরিবারের দিকে তাকিয়ে অবিলম্বে পাটকল শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানান।
অবিলম্বে শ্রমিকদের সকল দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন এবং উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলন খুলনা মহানগর সভাপতি সভাপতি আলহাজ্ব মুফতী আমানুল্লাহ, নগর সেক্রেটারী শেখ মোঃ নাসির উদ্দিন, প্রশিক্ষণ সম্পাদক মুফতী ইসহাক ফরীদি, নির্বাহী সদস্য আলহাজ্ব মাওঃ সিরাজুল ইসলাম, ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন খুলনা মহানগর সভাপতি আলহাজ্ব জাহিদুল ইসলাম, সিনিয়র সহ সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, সাধারণ সম্পাদক গাজী মুরাদ হোসেন, ইশা ছাত্র আন্দোলন খুলনা মহানগর সহ সভাপতি আব্দুস সালাম জায়েফ, বিএল কলেজ সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন, ইসলামী আন্দোলন খানজাহান আলীর সেক্রেটারী মোঃ কামরুল ইসলাম, মোঃ আল আমিন, মোঃ জুয়েলসহ সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের সাথে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করায় তারা বাধ্য হয়ে পুনরায় ২৯ ডিসেম্বর থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেছেন। তাদের এই আন্দোলনের সাথে সংহতি জানাতে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, কেন্দ্রীয় সভাপতি ও স্কপ নেতা কামরুল আহসান গতকাল সকালে ঢাকা থেকে খুলনায় আমগন করেন।
তিনি বিকেল হতে পর্যায়ক্রমে ইষ্টার্ণ জুট মিলস গেট, খালিশপুর জুট মিলস গেট, ক্রিসেন্ট জুট মিলস গেট, প্লাটিনাম জুট মিলস গেটসহ সকল জুট মিলস গেটে অনশনরত শ্রমিকদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বক্তৃতা করেন।
এসময় তার সাথে ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির খুলনা মহানগর সভাপতি কমরেড শেখ মফিদুল ইসলাম, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য এস এম ফারুখ উল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির মহানগর নেতা হাফিজুর রহমান, পার্টি নেতা মোঃ হারুন, কুদ্দুস খান, আবুল বাশার, ছাত্র মৈত্রীর জেলা নেতা নাজমুল হোসেন বাবু প্রমুখ।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর খুলনা ব্যুরো প্রধান এইচ এম আলাউদ্দিন এবং মাশরুর মুর্শেদ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.